মাসুক আলতাফ চৌধুরী, কুমিল্লা
প্রকাশ : ০৫ জুলাই ২০২৫, ১২:০০ এএম
আপডেট : ০৫ জুলাই ২০২৫, ০৭:১২ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

মুরাদনগরে গোয়েন্দা ব্যর্থতাকেই বড় করে দেখছেন সবাই

তিনজনকে পিটিয়ে হত্যা
মুরাদনগরে গোয়েন্দা ব্যর্থতাকেই বড় করে দেখছেন সবাই

কুমিল্লার মুরাদনগর উপজেলার কড়ইবাড়ি ট্র্যাজেডির বড় কারণ পুলিশের গোয়েন্দা ব্যর্থতা—এমনটিই মনে করছেন সবাই। মোবাইল চুরির ঘটনায় দুদিন ধরে হামলা-মারধর এবং উত্তেজনার পরও আগে থেকে পুলিশ কোনো কার্যকর ব্যবস্থা নেয়নি। এলাকাবাসী জানান, পরিবারটি মাদক কারবারি, ৪০ বছর ধরে এমন ব্যবসা করে আসছে। তাদের বিরুদ্ধে কেউ কিছু বললেই মিথ্যা মামলা করে, ভয়ভীতি দেখায়। পুলিশের প্রশ্রয় ছাড়া এমনটি সম্ভব নয়।

মুরাদপুরের আকবরপুর ইউনিয়নের কড়ইবাড়ি গ্রামে মাদক কেনাবেচার অভিযোগ এনে গ্রামবাসী মিলে বৃহস্পতিবার সকালে পরিকল্পিকভাবে একই পরিবারের তিনজনকে পিটিয়ে হত্যা করে। নিহতরা হলেন কড়ইবাড়ি গ্রামের জুয়েল মিয়ার স্ত্রী রোকসানা আক্তার রুবি (৫৫), তার ছেলে রাসেল মিয়া (২৮), মেয়ে জোনাকি আক্তার (২৩)। কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিহত রুবির আরেক মেয়ে রুমা আক্তারের চিকিৎসা চলছে। তার অবস্থাও আশঙ্কাজনক।

গতকাল শুক্রবার বিকেলে কুমিল্লা মেডিকেলে তিনজনের ময়নাতদন্ত শেষে পরিবারের কাছে মরদেহ হস্তান্তর করে পুলিশ। পরে সন্ধ্যার পর স্থানীয় সামাজিক কবরস্থানে তাদের দাফন করা হয়। এর আগে গ্রামে কোনো মানুষ না থাকায় বাঙ্গুরা থানা-পুলিশের সহায়তায় গ্রাম পুলিশ তিনজনের খবর খোঁড়েন।

আকবপুর ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) সাবেক চেয়ারম্যান ও উপজেলা বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক শাহ আলম একই অভিমত ব্যক্ত করে বলেন, ‘পুলিশের বিরুদ্ধে কথা বলা যায় না। আমরা রাজনীতি করি, সব জেনে-বুঝেও কিছু বলতে পারছি না।’

স্থানীয়দের অনেকেই বলছেন, গত মঙ্গলবার মোবাইল চুরির ঘটনা ঘটল। রোকসানা আক্তার রুবির পরিবার বাচ্চু মেম্বার, শিক্ষক রুহুল আমীন ও তার ছেলেকে উল্টো দুই দফা মারধর করল। এ নিয়ে এলাকায় ক্ষোভ ফুঁসে উঠল, অথচ পুলিশ কিছুই টের পেল না। বুধবার এ ঘটনা নিয়ে বাজারে তিন রাস্তায় মাথায় ইউপি চেয়ারম্যান, মেম্বারসহ সবাই একত্রিত হলেন। তারা সিদ্ধান্ত নিলেন পরদিন সকালে তাদের বাড়ি গিয়ে হামলা করা হবে, পরিবারটিকে উচ্ছেদ করা হবে। তারপরও পুলিশ নীরব ছিল। কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। এসবই পুলিশের গোয়েন্দা ব্যর্থতা। বুধবার একত্রিত হওয়ার পর পুলিশ প্রস্তুত থাকলে বৃহস্পতিবার সকালে গণপিটুনির ঘটনা না-ও ঘটতে পারত।

সচেতন নাগরিক কমিটি কুমিল্লার সাবেক সভাপতি শাহ মো. আলমগীর খান বলেন, ‘মাদক কারবারির সঙ্গে পুলিশের একটা সখ্য থাকেই। পুলিশের প্রশ্রয় পেয়েই পরিবারটি এলাকায় এমন ভয়ানক হয়ে উঠেছে বলে মনে হয়। আর পুলিশ আগে থেকে ব্যবস্থা নিলে মব থামাতে পারত। এতে হত্যাকাণ্ডের হাত থেকে হয় তো রক্ষা পেত পরিবারটি।’

এ বিষয়ে পুলিশের কেউ কোনো কথা বলতে নারাজ। জেলা পুলিশের গোয়েন্দা শাখার পরিদর্শক (ডিআইও) মামুনুর রশীদ কালবেলাকে বলেন, ‘আমি এ বিষয়ে কোনো কথা বলতে পারি না। এটা আমার এখতিয়ার নয়।’ তবে পুলিশের গোয়েন্দা ব্যর্থতা রয়েছে—এমনটি মনে করেন না এ গোয়েন্দা কর্মকর্তা।

স্থানীয় বাসিন্দা ফয়সাল বলেন, ‘রুবির পরিবার ৪০ বছর ধরে মাদক কেনাবেচায় জড়িত। তাদের বিরুদ্ধে বহু মামলা। কিন্তু এভাবে তিনজনকে পিটিয়ে হত্যা করা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়।’

এদিকে কড়ইবাড়ি গ্রাম এখন আতঙ্কের নগরী। গ্রেপ্তার আতঙ্কে পুরুষশূন্য হয়ে পড়েছে পুরো গ্রাম। অধিকাংশ বাড়িঘরে তালা ঝুলছে। গ্রামের রাস্তাঘাট ফাঁকা। নারী-শিশুদের চোখে-মুখে আতঙ্ক। নৃশংস এ হত্যাকাণ্ডে সরাসরি উপস্থিত ছিলেন স্থানীয় দুই জনপ্রতিনিধি ইউপি চেয়ারম্যান শিমুল বিল্লাহ ও সদস্য বাচ্চু মিয়া। তারাও ঘটনার পর থেকে পলাতক। তবে গতকাল মোবাইল ফোনে চেয়ারম্যান শিমুল বিল্লাহর সঙ্গে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়। কালবেলাসহ স্থানীয় চারজন সাংবাদিক তার সঙ্গে কথা বলেন। শিমুল বিল্লাহ বলেন, ‘আমরা নিজেরাই হামলার শিকার হয়ে এলাকা ছাড়ি। পরে গ্রামের লোকজন উত্তেজিত হয়ে ঘটনা ঘটিয়েছে। এ হামলার সঙ্গে আমি জড়িত নই।’

তবে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের ইঙ্গিত করে নিহত রুবির আত্মীয় হানিফ মিয়া বলেন, ‘যারা মারল তারা সাধারণ লোক না। তারা চেয়ারে বসা লোকদের দেখেই সাহস পেয়েছে। ওরা (চেয়ারম্যান-মেম্বার) চুপ করে না থাকলে এমন হতো না।’

নিহত রাসেলের স্ত্রী মীম আক্তার বলেন, ‘বাড়ির সামনে ৮০ থেকে ৯০ জন লোক লাঠিসোটা নিয়ে আসে। প্রথমে তারা বাড়িতে ইট ছোড়ে, পরে ঢুকে পড়ে। আমার শাশুড়িকে প্রথমে মারতে মারতে উঠানে ফেলে রাখে। পাশের ঘর থেকে আমার দুই ননদ বের হলে তাদেরও পেটানো হয়। আমার বাপের বাড়ি ছিল আমার স্বামী রাসেল। হামলার ঘটনা জানতে পেরে মোটরসাইকেলে করে সে বাড়ির দিকে আসে। তাকেও গেটের সামনে পিটিয়ে ও কুপিয়ে হত্যা করা হয়। এ হামলা ও হত্যার নেতৃত্ব দিয়েছেন এলাকার বাছির নামে এক ব্যক্তি।’

স্থানীয় আরেক ব্যক্তি জানান, চেয়ারম্যান শিমুল বিল্লাহ আর মেম্বার বাচ্চু সামনে ছিলেন। কেউ কাউকে থামাননি। বরং লোকে বলেছে, ‘চেয়ারম্যান সাহেব আছেন, কিছু হবে না’। তারপর শুরু হয় পিটুনি।

এদিকে কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ফরেনসিক বিভাগ সূত্রে জানা যায়, গতকাল দুপুরে তিনজনের মরদেহের ময়নাতদন্ত শেষ হয়। পরে বিকেলে পুলিশ পরিবারের কাছে মরদেহ হস্তান্তর করে। পুলিশ বলছে, নির্মম ঘটনার শিকার পরিবারটির অন্য সদস্যদের ঘটনার পর থেকে খোঁজা হচ্ছিল। পরে বিকেলে নিহত রুবির মেয়ের জামাই মনির হোসেন হাসপাতাল থেকে তিনজনের মরদেহ বুঝে নেন। কালবেলাকে এসব তথ্য জানান বাঙ্গরা বাজার থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. মাহফুজুর রহমান। তিনি বলেন, বৃহস্পতিবার বিকেল থেকেই অভিযান চলছে। এখনো কাউকে গ্রেপ্তার করা হয়নি। এলাকায় অতিরিক্ত পুলিশ রয়েছে। পরিস্থিতি এখন স্বাভাবিক।

পুলিশ সুপার নজির আহমেদ খান বলেন, ঘটনাটি খুবই দুঃখজনক। তদন্ত চলছে। জড়িত কেউ ছাড় পাবে না। আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। নিহতদের পরিবার এখনো মামলা করেনি কেন, সেই প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমরা পরিবারকে সময় দিচ্ছি। চাই না তাদের ওপর কোনো চাপ তৈরি হোক। তারা মরদেহ বুঝে নিয়েছে। দাফন শেষেই মামলা করবে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, পরিবারের পুত্রবধূ নিহত রাসেলের স্ত্রী মীম আক্তার এলাকায় আছেন। বড় মেয়ে এবং নিহত রোকসানা আক্তার রুবির স্বামী জুয়েল মিয়া বৃহস্পতিবার ঘটনার পর সারাদিন গা ঢাকা দিয়ে ছিলেন। নিহত জোনাকি আক্তারের স্বামী মনির হোসেনও লোকচক্ষুর আড়ালে আছেন। পুলিশ তাদের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা চালায়। গতকাল সকালে পরিস্থিতি বুঝে তারাও যোগাযোগ করেন।

হামলায় আহত রুবির আরেক মেয়ে রুমা আক্তার (২৫) সংকটাপন্ন অবস্থায় কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে (কুমেক) চিকিৎসাধীন।

ঘটনাটি ন্যক্কারজনক আখ্যা দিয়ে ব্লাস্ট কুমিল্লার আইনজীবী শামীমা জাহান কালবেলাকে বলেন, ‘মেনে নিলাম তারা অত্যাচারী, মামলাবাজ ও মাদক কারবারি, তাই বলে মোবাইল চুরি বা এমন ঘটনা কেন্দ্র করে মব সৃষ্টি করে কাউকে পিটিয়ে মেরে ফেলা যায় না। যারা ঘটনা ঘটিয়েছে, তাদের চিহ্নিত করে অবশ্যই আইনের আওতায় আনতে হবে। মাদক কারবারি বলে হত্যাকাণ্ডের ঘটনা থেকে পার পাওয়া যাবে না।’

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

তিন দিন পর যুবকের মরদেহ ফেরত দিল বিএসএফ

ইন্টারনেট নিয়ে ঝগড়া, স্ত্রীকে মেরে থানায় গেলেন স্বামী

হোসেনী দালান থেকে তাজিয়া মিছিল শুরু

এমবাপ্পের বাইসাইকেল কিকে নাটকীয় জয় রিয়ালের

কক্সবাজারে সিসিএসের আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু

চোরকে চিনে ফেলায় ছুরিকাঘাত, আহত বৃদ্ধার মৃত্যু

আজ দেশে কত দামে স্বর্ণ বিক্রি হচ্ছে

ট্রাম্পের সঙ্গে বিরোধ, দল গঠন করে মাঠে নামলেন ইলন মাস্ক

বৃদ্ধাকে নিয়ে বিড়ম্বনায় হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ

তাসনিম জারার হাফ প্যান্ট পরা ভাইরাল ছবিটি সম্পাদিত 

১০

ঘুম থেকে উঠে লিটন দেখে ঘরে মা, বাইরে বাবার লাশ

১১

মুন্সীগঞ্জে দলিল লেখকপট্টিতে ভয়াবহ আগুন

১২

বিশেষ কারাগারে ভিআইপি বন্দিদের যে আক্ষেপ

১৩

আশুরার রাতে দেখা গেল আয়াতুল্লাহ খামেনিকে

১৪

ঘুম থেকে জেগে ওঠার পর যে দোয়া পড়তে বলেছেন নবীজি

১৫

রাজধানীতে কাভার্ডভ্যান চাপায় ২ পরিচ্ছন্নতা কর্মী নিহত

১৬

ব্রাশের আগে পানি পান করবেন কি না? কী বলছেন চিকিৎসকরা 

১৭

অভিযুক্তকে বাঁচাতে মানববন্ধন করতে বললেন তদন্ত কমিটির সদস্য 

১৮

ইয়েমেন থেকে এখনো হামলা হচ্ছে ইসরায়েলে

১৯

টানা ৪১ দিন জামাতে নামাজ পড়ে পুরস্কার পেল ১৭ কিশোর

২০
X