অনগ্রসর ও হতদরিদ্র জনগোষ্ঠীর আত্মকর্মসংস্থান সৃষ্টির লক্ষ্যে একটি বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণ প্রকল্প নিয়েছিল সমাজসেবা অধিদপ্তর। প্রকল্পের আওতায় বিভিন্ন বিষয়ে প্রশিক্ষণও দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু নানা অনিয়মে সেসব প্রশিক্ষণে তেমন সফলতা আসেনি। যে পরিমাণ কর্মসংস্থান এবং আর্থিক লাভের কথা বলা হয়েছিল, সফলতা তার ধারেকাছেও নেই। অথচ প্রশিক্ষণের নামে নেওয়া প্রকল্পের কাজ এবং খরচ দেখানো হয়েছে শতভাগ।
‘অনগ্রসর ও হতদরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য আত্মকর্মসংস্থানমূলক প্রশিক্ষণ’ প্রকল্পটির প্রভাব নিয়ে সম্প্রতি মূল্যায়ন প্রতিবেদন তৈরি করেছে বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ (আইএমইডি)। ওই প্রতিবেদনে আলোচ্য প্রকল্পের উদ্দেশ্য পূরণ না হওয়ার পাশাপাশি ব্যাপক অনিয়ম ও লুটপাটের প্রমাণ মিলেছে। ৪০ কোটি টাকা ব্যয়ে বাস্তবায়িত প্রকল্পে প্রশিক্ষণার্থীদের জন্য বরাদ্দকৃত অর্থ থেকে শুরু করে যন্ত্রপাতি, প্রশিক্ষণ কার্যক্রম—সব কিছুতেই দুর্নীতির তথ্য উঠে এসেছে। এমন ছোট একটি প্রকল্পে নানা অনিয়মের কারণে অডিট আপত্তি উঠেছে প্রায় ২০০টি।
আইএমইডির প্রতিবেদন পর্যালোচনায় দেখা গেছে, কাজ শেষে সমাজসেবা অধিদপ্তরের এই প্রকল্পকে শতভাগ সফল বলে দেখানো হয়েছে। খরচ এবং বাস্তবায়ন দেখানো হয়েছে প্রায় শতভাগ। কিন্তু মাঠপর্যায়ের বাস্তবতা ভয়াবহ। প্রশিক্ষণের মাধ্যমে কর্মসংস্থানের কথা বলা হলেও বাস্তবে ফল প্রায় শূন্য।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, আলোচ্য প্রকল্পের আওতায় কম্পিউটার প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে ২ হাজার ৬৪০ জনকে, কিন্তু কর্মসংস্থান হয়েছে মাত্র ১২১ জনের। ড্রাইভিং প্রশিক্ষণ নিয়েছেন ২ হাজার ৫৪৫ জন, কর্মসংস্থানে যুক্ত হয়েছেন মাত্র ৭২ জন। অর্থাৎ প্রকল্পের ব্যয় প্রশিক্ষণার্থীদের জীবনে কার্যত কোনো পরিবর্তন আনতে পারেনি। কিন্তু প্রশিক্ষণের নামে অর্থ ঠিকই ষোলোআনা খরচ হয়েছে।
প্রকল্পের আর্থিক অর্জনের চিত্র আরও করুণ। আর্থিক বিশ্লেষণে দেখা গেছে, প্রকল্পের আওতায় আর্থিক অর্জনের কথা বলা হয়েছিল ১ টাকায় আয় হবে ৯ টাকা ৬২ পয়সা। বাস্তবে দেখা গেছে, ১ টাকায় আয় হয়েছে মাত্র শূন্য দশমিক ৩৬ পয়সা। সম্ভাব্য উপকারিতা ধরা হয়েছিল প্রায় ৩৮৫ কোটি টাকা। অর্জিত হয়েছে মাত্র ১০ কোটি টাকার কিছু বেশি। সেটিও টেকসই নয় বলেও প্রতিবেদনে উঠে এসেছে।
প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, কিছু প্রশিক্ষণার্থী লাভবান হলেও বেশিরভাগের মতে, এই প্রশিক্ষণ তাদের তেমন কাজে আসেনি। প্রকল্পটি অনগ্রসর ও হতদরিদ্র জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়নের লক্ষ্য নিয়ে শুরু হলেও বাস্তবে স্কুল-কলেজ পড়ুয়া শিক্ষার্থী এবং সংশ্লিষ্ট সংস্থার পরিচিত ব্যক্তিরা প্রকল্পে অংশগ্রহণ করেছেন। এতে প্রকল্পের প্রকৃত লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য পূরণ হয়নি। প্রশিক্ষণটি ২০২২ সালের জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত চলমান ছিল এবং দুটি করে ব্যাচে পরিচালিত হয়।
প্রকল্পে ড্রাইভিং ও কম্পিউটার প্রশিক্ষণ দেওয়া হলেও কার্যক্রমের মান নিয়ে প্রশিক্ষণার্থীরা অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন। ড্রাইভিং প্রশিক্ষণ অধিকাংশ স্থানে ১০ থেকে ১৫ দিনের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল এবং এতে অংশগ্রহণকারীদের বেশিরভাগকে গাড়ি চালানোর সুযোগ না দিয়ে শুধু বাহ্যিক বর্ণনা শেখানো হয়। একইভাবে কম্পিউটার প্রশিক্ষণ ২১ দিনের নির্ধারিত সময়ের পরিবর্তে অনেক স্থানে ১৫ থেকে ১৮ দিনের মধ্যে শেষ করা হয়। প্রশিক্ষণের জন্য পর্যাপ্ত কম্পিউটার ও যন্ত্রাংশ ছিল না। কম্পিউটার প্রশিক্ষণে অপরিপক্ব শিক্ষক নিয়োগ দেওয়ার অভিযোগ পাওয়া গেছে।
প্রকল্প থেকে নোটবুক, কলম, নাশতা, এবং ভাতা প্রদানের কথা থাকলেও বেশিরভাগ প্রশিক্ষণার্থী এগুলো পাননি। কিছু স্থানে সীমিত ভাতা প্রদান করা হলেও তা প্রশিক্ষণার্থীদের জন্য পর্যাপ্ত ছিল না। প্রশিক্ষণ শেষে চাকরির সুযোগ সৃষ্টির জন্য কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি, যা প্রশিক্ষণার্থীদের হতাশ করেছে।
২০২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে শুরু হওয়া প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হয় লালমনিরহাট, জামালপুর, ভোলা ও পটুয়াখালী জেলার ২৫টি উপজেলায়। সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় ও নামসর্বস্ব বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা গ্লোবাল রুরাল এনভায়রনমেন্ট সোসাইটি (জিআরইএস) প্রকল্প বাস্তবায়ন করে।
প্রকল্পের মোট ব্যয় ছিল প্রায় ৪০ কোটি টাকা। প্রশিক্ষণ দেওয়া হয় ৫ হাজার ১৮৫ জন তরুণ-তরুণীকে। খাতা-কলমে এদের অনেককেই দেখানো হয়েছিল এতিম কিংবা স্কুল ড্রপআউট হিসেবে। কিন্তু বাস্তবে প্রশিক্ষণের আওতায় রাখা হয় কম্পিউটার, ড্রাইভিং এবং গ্রাফিক ডিজাইন, যা ছিল অনেকাংশে লোক দেখানো। ড্রাইভিং লাইসেন্স প্রাপ্তির জন্য প্রকল্প অফিস থেকে কোনো সহযোগিতা বা তথ্য প্রদান করা হয়নি।
প্রকল্পের প্রশিক্ষণে সফলতা না এলেও অনিয়ম-দুর্নীতি ঠিকই হয়েছে। ছোট এ প্রকল্পে ব্যাপক অনিয়ম-দুর্নীতির প্রমাণ মিলেছে আইএমইডির মূল্যায়ন প্রতিবেদনে। আইএমইডির প্রতিবেদন সূত্রে জানা গেছে, নানা অনিয়ম- দুর্নীতির জন্য মাত্র ৪০ কোটি টাকা ব্যয়ের আলোচ্য প্রকল্পে ১৯৬টি অডিট আপত্তি উঠেছে। প্রকল্প-সংশ্লিষ্টরা অডিট আপত্তির সঠিক জবাব দিতে না পারায় বেশিরভাগই নিষ্পত্তি হয়নি।
অডিট আপত্তির তথ্য অনুযায়ী, অতিরিক্ত প্রশিক্ষণার্থী, প্রশিক্ষকের সম্মানী, খাবার, যাতায়াত ভাতা, এমনকি জ্বালানির খরচ দেখিয়ে সরকারি অর্থ লোপাট করা হয়েছে। শুধুমাত্র অতিরিক্ত প্রশিক্ষণার্থী দেখিয়ে তুলে নেওয়া হয় ৮০ লাখ টাকার বেশি। ভুয়া খাবারের ব্যয় দেখিয়ে আরও সাড়ে ৭ লাখ টাকা, আয়কর কর্তনে অনিয়মে ২১ লাখ আর প্রকল্প শেষে ১ কোটি ৯৩ লাখ টাকার কম্পিউটার ও আসবাবপত্র উধাও হয়ে যায়। জ্বালানির ব্যয়ের নামে তোলা হয় আরও কয়েক লাখ টাকা। নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি ছাড়াই প্রশিক্ষক নিয়োগ দেখিয়ে তুলে নেওয়া হয়েছে সম্মানী বাবদ আরও অর্থ।
এদিকে, প্রকল্প শুরুর সময় বলা হয়েছিল প্রত্যেক প্রশিক্ষণার্থী ১০ হাজার টাকা করে ভাতা পাবেন। কিন্তু অনেকেই সেই টাকা পাননি। প্রশিক্ষণ শেষে সনদপত্র দেওয়ার কথা থাকলেও বেশিরভাগ প্রশিক্ষণার্থীকে সনদপত্র দেওয়া হয়নি। এমনকি সনদ দেওয়ার জন্য ১০০ টাকা করে নেওয়া হয়। কিন্তু সনদ না দিলেও সেই টাকা ফেরত দেওয়া হয়নি।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, আলোচ্য প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালকের (পিডি) দায়িত্ব পালন করেন সমাজসেবা অধিদপ্তরের দুজন কর্মকর্তা। প্রথমে পিডি ছিলেন হেলাল উদ্দিন ভূঁইয়া। পরবর্তী সময়ে দায়িত্ব পান স্বপন কুমার হালদার। প্রকল্প বাস্তবায়নে অনিয়মের বিষয় জানতে চাইলে স্বপন কুমার হালদার কালবেলাকে বলেন, ‘অনিয়মের বিষয়ে আমার জানা নেই। সঠিকভাবে প্রকল্প বাস্তবায়নে আমি সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছি। সব বিল-ভাউচার দেখেই বিল পরিশোধ করা হয়েছে। প্রশিক্ষণার্থী সবার জন্য সনদ তৈরি করা হয়েছিল, তার পরও তারা পায়নি এটা জানা নেই।’
তিনি বলেন, ‘আইএমইডির প্রতিবেদনে যে অডিট আপত্তির কথা বলা হয়েছে সেটা সঠিক নয়, এতগুলো অডিট আপত্তি ছিল না। আমার জানামতে ১৩টি অডিট আপত্তি ছিল, সেগুলো নিষ্পত্তির জন্য জবাব দেওয়া হয়েছে।’
মন্তব্য করুন