বিনামূল্যের পাঠ্যবই ছাপানোয় দুর্নীতি ও অনিয়মের অভিযোগে টালমাটাল জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি)। এবার প্রতিষ্ঠানটির ক্ষমতা খর্ব করতে বোর্ডের আইন সংশোধন করা হচ্ছে। ফলে প্রাথমিক স্তরের ১০ কোটি বই ছাপার দায়িত্ব সরাসরি পাবে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর (ডিপিই)। এতে সরকারের ৩০ থেকে ৩৫ কোটি টাকা সাশ্রয়ের পাশাপাশি পাঠ্যবই ছাপানো ও বিতরণে গতিশীলতা আসবে; ভাঙবে এনসিটিবি কেন্দ্রীয় দুর্নীতি ও সিন্ডিকেট। নতুন আইন অনুমোদিত হলে এনসিটিবির কার্যপরিধি ছোট হবে—এমন আশঙ্কা করছেন শিক্ষা ক্যাডাররা।
সংশ্লিষ্ট সূত্রমতে, বই ছাপানোয় এনসিটিবির কিছু কর্মকর্তার সীমাহীন দুর্নীতি, প্রতি বছর নিম্নমানের বই দেওয়া এবং সরকারের আর্থিক ক্ষতি কমাতেই পাঠ্যপুস্তক বোর্ড ২০১৮ সংশোধন করা হচ্ছে। এরই মধ্যে নতুন একটি আইনের খসড়া চূড়ান্ত করেছে আন্তঃমন্ত্রণালয়। ওয়েবসাইটে সর্বসাধারণের মতামতও চেয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। প্রস্তাব অনুযায়ী, এনসিটিবি শুধু মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক স্তরের পাঠ্যক্রম এবং বই নিয়ে কাজ করবে আর প্রাথমিক স্তরের বই মুদ্রণ, প্রকাশনা ও বিতরণ পরিচালনা করবে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর।
সংশ্লিষ্টরা জানান, এনসিটিবির অদক্ষতা, বই ছাপাতে দেরি, নিম্নমানের কাগজ ব্যবহার এবং অতিরিক্ত সার্ভিস চার্জ আদায়কে কেন্দ্র করে দীর্ঘদিনের সমালোচনা ছিল। প্রতি বছর ২০ থেকে ৩০ কোটি টাকা সার্ভিস চার্জ বাবদ খরচ হয়। নতুন আইন হলে এই টাকা সাশ্রয় করা সম্ভব হবে বলে মনে করছে গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়। তবে শিক্ষা ক্যাডারের কর্মকর্তারা এমন সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করে বলছেন, পাঠ্যপুস্তক প্রণয়ন থেকে বিতরণ পর্যন্ত সমন্বিত কাঠামো ভেঙে দিলে শিক্ষায় ধারাবাহিকতা নষ্ট হবে। ১৯৮৩ সালে সমন্বয়হীনতা কাটাতে এনসিটিবি গঠন করা হয়েছিল। এবার একই ভুল পুনরাবৃত্তির ঝুঁকি তৈরি হচ্ছে বলে তারা আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এনসিটিবি ভেঙে দুটি দপ্তর হলে বই ছাপানোর দীর্ঘসূত্রতা কমার পাশাপাশি যেমন অর্থ সাশ্রয় হবে, একই সঙ্গে জবাবদিহিও নিশ্চিত করা যাবে। এনসিটিবি বর্তমানে প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক—এই তিন স্তরের বই প্রণয়ন, মুদ্রণ ও বিতরণের দায়িত্বে রয়েছে। কিন্তু প্রাথমিক শিক্ষার প্রকৃতি মাধ্যমিক থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। তা সত্ত্বেও এনসিটিবিকে দিয়ে প্রাথমিকের বই ছাপানোর ফলে প্রায়ই নানা জটিলতা দেখা দেয়। এর মধ্যে বই ছাপানোর ধীরগতি এবং কাগজের নিম্নমান নিয়ে সবচেয়ে বেশি অভিযোগ ওঠে।
প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় যুক্তি দিয়েছে, প্রাথমিক শিক্ষার জন্য আলাদা পাঠ্যক্রম ও শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালিত হয়। তাই বই প্রণয়ন থেকে শুরু করে মুদ্রণ পর্যন্ত পুরো প্রক্রিয়াটি তাদের নিয়ন্ত্রণে থাকলে শিক্ষার্থীদের কাছে সময়মতো মানসম্মত বই পৌঁছে দেওয়া সহজ হবে। বর্তমানে বই ছাপানোর অনুমোদন প্রক্রিয়ায় এনসিটিবি, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়, প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর, মন্ত্রিপরিষদের ক্রয়-সংক্রান্ত কমিটি এবং মুদ্রণ প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে সমন্বয়ের অভাবে প্রায়ই বিলম্ব ঘটে। অথচ প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের অধীনে একটি শক্তিশালী ‘প্রকিউরমেন্ট উইং’ রয়েছে, যেখানে এই কাজ পরিচালনার জন্য পর্যাপ্ত জনবলও আছে।
প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের একজন পরিচালক কালবেলাকে বলেন, ‘প্রতি বছর প্রাথমিক স্তরের প্রায় ১০ কোটি বই ছাপানো হয়। এই বই ছাপার জন্য সরকার বাজেট দেয় প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়কে। কিন্তু কাজটি করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীন এনসিটিবি। এর জন্য সার্ভিস চার্জ বাবদ এনসিটিবিকে বছরে ৩০ থেকে ৩৫ কোটি টাকা দিতে হয়। প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর সরাসরি এই দায়িত্ব পালন করলে পুরো টাকাই সাশ্রয় হবে।’
ওই কর্মকর্তা এনসিটিবির বিরুদ্ধে বই ছাপাতে দেরি করা এবং বইয়ের মান নিয়ে প্রশ্ন ওঠার অভিযোগ তুলে বলেন, ‘বইয়ের মান তদারকির জন্য যে পরিদর্শন এজেন্সি নিয়োগ দেওয়া হয়, সেখানে পর্যন্ত এনসিটিবির কিছু কর্মকর্তা দুর্নীতিতে জড়িয়ে যান। এসব কারণেই ‘জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড আইন, ২০১৮’ সংশোধন করে প্রাথমিকের বই ছাপানোর দায়িত্ব প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরকে দেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। আশা করা হচ্ছে, এর মাধ্যমে সময়ক্ষেপণ ও সমন্বয়হীনতা দূর হবে এবং প্রতি বছর শিক্ষার্থীরা সময়মতো মানসম্মত বই হাতে পাবে।’
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানান, এনসিটিবির মূল কাজ পাঠ্যক্রম প্রণয়ন ও সংশোধন। কিন্তু প্রতিষ্ঠানটি সেই দায়িত্বে মনোযোগ না দিয়ে বই ছাপার দরপত্র ও কেনাকাটার কাজে বেশি ব্যস্ত থাকে। এ প্রক্রিয়ায় জড়িয়ে গত ১৫ বছরে বই ছাপা কার্যক্রম থেকে অনেক কর্মকর্তা বিত্তশালী হয়েছেন, এমন অভিযোগ রয়েছে। তাদের মধ্যে একাধিক কর্মকর্তা এরই মধ্যে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) তদন্তের আওতায় এসেছেন। শুধু কর্মকর্তারা নন, দুর্নীতির দায়ে চলতি বছর দুদকের জালে জড়িয়েছেন ৩৫টি ছাপাখানার মালিক। এসব বিষয় সরকারের সর্বোচ্চ মহলের নজরে আসার পর ২০১৮ সালে প্রাথমিক স্তরের বই মুদ্রণ ও বিতরণের দায়িত্ব এনসিটিবি থেকে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ে হস্তান্তরের উদ্যোগ শুরু হয়। একই বছরের শেষ দিকে গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর কাছে প্রস্তাব পাঠায়। প্রস্তাবে এসব প্রেক্ষাপট তুলে ধরে এনসিটিবি থেকে বই ছাপার কাজ নিজেদের কাছে রাখার প্রস্তাব করে গণশিক্ষা অধিদপ্তর। পরবর্তী সময়ে ২০২২ সালের ২৫ অক্টোবর প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে মুখ্য সচিবের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এক সভায় সিদ্ধান্ত হয়—এনসিটিবির তৈরি করা শিক্ষাক্রমের ভিত্তিতে প্রাথমিক স্তরের পাঠ্যপুস্তক মুদ্রণ এবং বিতরণের কাজ প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় নিজেদের ব্যবস্থাপনায় সম্পন্ন করবে। এরই ধারাবাহিকতায় ২০২৩ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এক সভায় সিদ্ধান্ত হয়, বিষয়টি চূড়ান্ত অনুমোদনের জন্য প্রধানমন্ত্রীর কাছে সারসংক্ষেপ আকারে উপস্থাপন করা হবে। তখন প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদন মিললেও জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড আইন পরিবর্তন না হওয়ায় উদ্যোগটি আটকে যায়। এখন সেই আইন সংশোধনের পথ তৈরি হয়েছে; আলোর মুখ দেখতে যাচ্ছে বহুল আলোচিত এ প্রক্রিয়া।
এনসিটিবি বলছে, প্রাথমিক স্তরের বই অন্য প্রতিষ্ঠানের হাতে গেলে শিক্ষায় ধারাবাহিকতা মারাত্মকভাবে ব্যাহত হবে। তাদের মতে, পাঠ্যপুস্তক প্রণয়ন থেকে বিতরণ পর্যন্ত সমন্বিত প্রক্রিয়াকে ভেঙে দিলে পুরোনো সংকট ফিরে আসবে। ১৯৮৩ সালে জাতীয় শিক্ষাক্রম উন্নয়ন কেন্দ্র ও স্কুল টেক্সট বুক বোর্ডকে একীভূত করে এনসিটিবি গঠনের মূল কারণই ছিল সমন্বয়হীনতা দূর করা। আইন অনুযায়ী, সার্ভিস চার্জ গ্রহণ বৈধ। এই আয় বন্ধ হলে প্রতিষ্ঠান চালাতে সরকারকে ভর্তুকি দিতে হবে। পাঠ্যপুস্তক ছাপা ও বিতরণে বোর্ডের রয়েছে বিশেষায়িত উইং, অভিজ্ঞ জনবল এবং দক্ষ ব্যবস্থাপনা। নতুন কোনো প্রতিষ্ঠানকে দায়িত্ব দিলে বিপুল জনবল নিয়োগ ও অবকাঠামো গড়ে তোলা ব্যয়সাপেক্ষ হবে।
শিক্ষা সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বই ছাপার মতো জনগুরুত্বপূর্ণ কাজটি এক ছাতার নিচে থাকলে ভালো। অন্য দপ্তরে গেলে সমন্বয়হীনতা, টেন্ডার ও মুদ্রণ তদারকিতে জটিলতা বাড়তে পারে। সবচেয়ে বড় ক্ষতি হবে সময়মতো মানসম্পন্ন বই শিক্ষার্থীদের হাতে পৌঁছাতে না পারা। প্রস্তাবটি বাস্তবায়িত হলে এনসিটিবির কার্যপরিধি সংকুচিত হবে আর প্রাথমিক শিক্ষায় নীতি ও বাস্তবায়নে দুটি মন্ত্রণালয়ের মধ্যে দ্বন্দ্ব-বিভাজন তৈরি হতে পারে।
নতুন প্রস্তাবে যা থাকছে: গতকাল শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে এনসিটিবির নতুন আইন সম্পর্কে জনসাধারণের মতামত চাওয়া হয়েছে। এর আগে আন্তঃমন্ত্রণালয়ের একাধিক বৈঠকে আইনের খসড়া অনুমোদন করা হয়। বর্তমানে এনসিটিবিতে একজন চেয়ারম্যান ও চারটি উইংয়ের প্রধানসহ মোট পাঁচ সদস্যের পদ রয়েছে। নতুন প্রস্তাবে চেয়ারম্যানসহ মোট আটজন সদস্য রাখার কথা বলা হয়েছে। প্রস্তাবিত সদস্যরা হবেন—পাঠ্যপুস্তক, প্রাথমিক শিক্ষাক্রম, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষাক্রম, মাদ্রাসা শিক্ষাক্রম, কারিগরি শিক্ষাক্রম, শিক্ষাক্রম প্রশিক্ষণ, শিক্ষাক্রম গবেষণা ও মূল্যায়ন এবং অর্থ উইংয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তি। বোর্ডের সচিবালয় কার্যক্রম দেখভাল করবেন একজন সচিব।
বিদ্যমান আইনে ‘জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড আইন, ২০১৮’, সেখানে নতুন প্রস্তাবনায় এর নাম পরিবর্তন করে রাখা হচ্ছে ‘জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক (সংশোধন) বোর্ড অধ্যাদেশ, ২০২৫’।
প্রস্তাবিত সংশোধনীতে বলা হয়েছে, প্রাথমিক শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক উইংয়ের কর্মকর্তারা প্রেষণে আসবেন প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর (ডিপিই) ও জাতীয় প্রাথমিক শিক্ষা একাডেমি (নেপ) থেকে। এ ছাড়া বোর্ডের কার্যাবলির ধারা ৮(জ)-এর অধীনে প্রাথমিক স্তরের পাঠ্যপুস্তক প্রণয়ন, মুদ্রণ ও বিতরণের দায়িত্ব প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের হাতে যাবে। তবে অন্যান্য স্তরের পাঠ্যপুস্তক প্রণয়ন, মুদ্রণ, প্রকাশনা ও বিনামূল্যে বিতরণের দায়িত্ব বোর্ডের কাছেই থাকবে। কর্মকর্তাদের মতে, এ পরিবর্তন হলে প্রাথমিক স্তরের পাঠ্যপুস্তক প্রণয়ন ও বিতরণে গতিশীলতা আসবে।
এদিকে, সরকারের এমন সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে গতকাল একটি জরুরি সভা ডাকা হয় এনসিবিটিতে। সেখানে চেয়ারম্যানের কাছে এ বিষয়ে ব্যাখ্যা চান প্রেষণ ও নিজস্ব কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। সেখানে বিষয়টি লিখিতভাবে জানানোর সিদ্ধান্ত হয়।
জানতে চাইলে এনসিটিবির সচিব অধ্যাপক মো. সাহতাব উদ্দিন কালবেলাকে বলেন, ‘এমনটি হলে বোর্ড চরম আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়বে। বোর্ড পরিচালনার জন্য সরকারকে এখানে ভর্তুকি দিতে হবে। তবে বিষয়টি নিয়ে এখনই চূড়ান্ত মতামত দেবে না বোর্ড। প্রাথমিকভাবে শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে বাস্তবতা তুলে ধরে একটি চিঠি দেওয়া হবে।’
মন্তব্য করুন