জাকির হোসেন লিটন
প্রকাশ : ০৭ অক্টোবর ২০২৫, ১২:০০ এএম
আপডেট : ০৭ অক্টোবর ২০২৫, ০৭:২৮ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

গণভোটের সময় নিয়ে দ্রুত ঐকমত্যে আসতে হবে

জুলাই সনদ বাস্তবায়ন
ঐকমত্য কমিশনের বৈঠক। ছবি : সংগৃহীত
ঐকমত্য কমিশনের বৈঠক। ছবি : সংগৃহীত

বহুল আলোচিত ‘জুলাই সনদ’ বাস্তবায়নের উপায় নির্ধারণে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে গণভোটের বিষয়ে ঐকমত্য এলেও এটি কখন অনুষ্ঠিত হবে—সেই সময় নিয়ে মতপার্থক্য দেখা দিয়েছে। বিএনপি চাইছে জাতীয় নির্বাচনের দিনই একসঙ্গে গণভোট অনুষ্ঠিত হোক। অন্যদিকে, জামায়াতে ইসলামীসহ কয়েকটি দল জাতীয় নির্বাচনের আগেই গণভোটের দাবি জানিয়েছে। আর জুলাই অভ্যুত্থান কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা তরুণদের রাজনৈতিক দল জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) জাতীয় নির্বাচনের দিন গণভোটের পক্ষে মত দিলেও তার আগেই জুলাই সনদের সাংবিধানিক অধ্যাদেশ দাবি করছে। এমন প্রেক্ষাপটে গণভোটের প্রক্রিয়া, প্রাসঙ্গিকতা এবং বাংলাদেশের ইতিহাসে এর ব্যবহার নিয়ে নতুন করে আলোচনা শুরু হয়েছে।

নির্বাচন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গণভোট নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলো প্রাথমিকভাবে একমত হয়েছে, এটি গুরুত্বপূর্ণ। তবে কবে এ ভোট অনুষ্ঠিত হবে, সে বিষয়েও দলগুলোকে দ্রুতই ঐকমত্যে আসতে হবে। দলগুলো চাইলে দিনক্ষণ নির্ধারণের জন্য সরকারের ওপর ক্ষমতা অর্পণ করতে পারে। কারণ, যখনই গণভোট হোক না কেন, তার জন্য নির্বাচন কমিশনকে প্রস্তুতি নিতে হবে।

তারা আরও বলছেন, বিশ্বের অনেক দেশেই কোনো সুনির্দিষ্ট বিষয়ে জনগণের মতামত নিতে গণভোট হয়েছে বা নেওয়ার চর্চা আছে। তবে বাংলাদেশে যেগুলো হয়েছে, তাতে জনগণ ভোট দিতে পেরেছে কতটা, তা নিয়েই প্রশ্ন আছে। এবার ‘জুলাই সনদ’ বাস্তবায়ন জনগণ চায় কি না, তা যাচাইয়ের জন্য যেভাবে রাজনৈতিক দলগুলো গণভোট চাইছে তাতে অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনে গণভোট হলে তাতে জনমতের প্রতিফলন পাওয়া যেতে পারে।

আর নির্বাচন কমিশন বলছে, গণভোট নিয়ে সরকার এবং রাজনৈতিক দলগুলোর ঐক্যবদ্ধ সিদ্ধান্ত পেলে যে কোনো সময় নির্বাচন আয়োজন করতে প্রস্তুত।

জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর দীর্ঘ ধারাবাহিক আলোচনায় অবশেষে ‘জুলাই সনদ’-এর আইনি ভিত্তি দিতে গণভোট অনুষ্ঠানের বিষয়ে সবাই একমত হয়েছে। রোববার ৩৩টি দলের প্রতিনিধিদের দিনব্যাপী আলোচনায় এ ভোটের বিষয়ে একমত হন নেতারা। বিষয়টিকে অত্যন্ত ইতিবাচক অগ্রগতি হিসেবে উল্লেখ করে সাধুবাদ জানিয়েছে ঐকমত্য কমিশন। তবে বিএনপির পক্ষ থেকে প্রস্তাব করা হয়েছে, গণভোট জাতীয় নির্বাচনের সঙ্গে একযোগে অনুষ্ঠিত হলে অর্থ ও সময় সাশ্রয় হবে। অন্যদিকে, জামায়াত মনে করে, নির্বাচনের আগেই গণভোটের মাধ্যমে জুলাই সনদের আইনি বাধ্যবাধকতা তৈরি করা জরুরি, যাতে এটি পরবর্তী সরকারের জন্য একটি অমোঘ নির্দেশনা হিসেবে কাজ করে। এনসিপি নেতারা চাইছেন, গণভোট জাতীয় নির্বাচনের দিন একই সঙ্গে আয়োজন করা হলে তাদের আপত্তি নেই। তবে তার আগেই অধ্যাদেশ জারি করে তার আইনি ভিত্তি দিতে হবে।

বাংলাদেশে গণভোটের ইতিহাস ও প্রেক্ষাপট: সংবিধানের ১৪২ (১ক) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, সংবিধানের প্রস্তাবনা অথবা কিছু গুরুত্বপূর্ণ অনুচ্ছেদ সংশোধনের জন্য সংসদে বিল পাস হওয়ার পর তাতে রাষ্ট্রপতি সম্মতি দেবেন কি না, সে প্রশ্নটি যাচাইয়ের জন্য গণভোটের বিধান রয়েছে। এই উদ্দেশ্যে ‘গণভোট আইন, ১৯৯১’ প্রণীত হয়। তবে বাংলাদেশের ইতিহাসে গণভোটের ব্যবহার মূলত তিনবার হয়েছে। তার প্রথম দুটিকে বলা হয় প্রশাসনিক গণভোট আর তৃতীয়টিকে বলা হয় সাংবিধানিক গণভোট।

এর মধ্যে সামরিক শাসনের বৈধতা দিতে ১৯৭৭ সালে প্রথম গণভোটের আয়োজন করা হয়। রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান সামরিক শাসনের মাধ্যমে ক্ষমতা গ্রহণের পর তার প্রতি জনগণের আস্থা যাচাইয়ের জন্য এই ভোট আয়োজন করেন। এতে সরকারি হিসেবে ৯৫ শতাংশ ভোটার উপস্থিতি এবং ৯৯ শতাংশ ‘হ্যাঁ’ ভোট পড়েছিল।

সামরিক শাসনের বৈধতা ১৯৮৫ সালে দ্বিতীয়বার গণভোট অনুষ্ঠিত হয়। তৎকালীন রাষ্ট্রপতি এইচ এম এরশাদ একইভাবে তার সামরিক শাসনামলকে বৈধতা দেওয়ার জন্য এই গণভোটের আয়োজন করেন। এখানেও বড় ব্যবধানে ‘হ্যাঁ’ ভোটে জয়ী হয়ে সামরিক শাসক হিসেবে ক্ষমতা সুসংহত করার সুযোগ পান এরশাদ। হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের পক্ষে ‘হ্যাঁ’ ভোট পড়েছিল ৯৪ দশমিক ১৪ শতাংশ। এ দুটি ভোট নিয়েই খানিকটা বিতর্ক করেন অনেকে।

এ ছাড়া সংসদীয় পদ্ধতির প্রবর্তন করতে ১৯৯১ সালে তৃতীয়বারের মতো গণভোট অনুষ্ঠিত হয়। দ্বাদশ সংশোধনী বিলের মাধ্যমে রাষ্ট্রপতি পদ্ধতির সরকারের পরিবর্তে সংসদীয় পদ্ধতির সরকার প্রবর্তনের জন্য এই ভোটের আয়োজন করা হয়। এটিই ছিল সংবিধান সংশোধনের বিষয়ে অনুষ্ঠিত প্রথম ও একমাত্র সাংবিধানিক গণভোট। এতে জনগণ সংসদীয় পদ্ধতির পক্ষে রায় দেয়। এই নির্বাচনেও ৮৪ শতাংশের বেশি ভোট পড়েছে বলে রেকর্ড আছে। ভোটের এই পরিসংখ্যান নিয়ে তখনই নানা অভিযোগ উঠেছিল; কিন্তু তা খুব একটা আলোচনায় আসেনি। কারণ সব দল তখন আগেই সংসদীয় পদ্ধতির পক্ষেই অবস্থান নিয়ে সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করে ফেলেছিল।

গণভোটের পদ্ধতি: গণভোট মূলত একটি বিশেষ বিষয়ে জনগণের মতামত জানার প্রক্রিয়া।

‘গণভোট আইন, ১৯৯১’ অনুযায়ী, রাষ্ট্রপতির নির্দেশ প্রাপ্তির সাত দিনের মধ্যে নির্বাচন কমিশন সরকারি গেজেটে প্রজ্ঞাপন জারি করে গণভোটের তারিখ নির্ধারণ করবে। সাধারণত প্রজ্ঞাপনের তারিখ থেকে ৪০ দিনের মধ্যে এই ভোট করতে হয়। গণভোটে সাধারণত একটি নির্দিষ্ট প্রশ্নের উত্তর ‘হ্যাঁ’ বা ‘না’ ভোট দিয়ে জানতে চাওয়া হয়।

যদিও আওয়ামী লীগ আমলে ২০১১ সালে সংবিধান থেকে গণভোটের বিধান বাতিল করে দেওয়া হয়েছিল। আবার আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর পঞ্চদশ সংশোধনী মামলায় আদালত আবার গণভোটের বিধান ফিরিয়ে আনার সিদ্ধান্ত দিয়েছে। কিন্তু এটি কোন প্রক্রিয়ায় বাস্তবায়ন হবে, তা এখনো নিশ্চিত নয়।

প্রতীক ও ভোটদান: ১৯৯১ সালের গণভোটে ‘হ্যাঁ’-সূচক ভোটের জন্য জাতীয় সংসদ ভবনের প্রতীক এবং ‘না’-সূচক ভোটের জন্য ‘কাটাদাগ’ চিহ্নিত প্রতীক ব্যবহৃত হয়েছিল। ভোটার ব্যালট পেপারে সিলমোহরের ছাপ দিয়ে ভোট দেন। আর অন্যান্য নির্বাচনের মতোই রিটার্নিং অফিসারদের মাধ্যমে ফল একীভূত করে কমিশন চূড়ান্ত ফল ঘোষণা করে।

কীভাবে হবে গণভোট, দলগুলো কী বলেছে: জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ রোববার রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে বৈঠকের পর বলেছেন, জুলাই সনদ বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়েছে এবং গণভোট অনুষ্ঠানের বিষয়ে দলগুলোর মধ্যে মতৈক্য হয়েছে।

কমিশনের সভায় বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ বলেছেন, যদি জাতীয় নির্বাচনের দিন গণভোট করা হয়, তাহলে সংবিধান আদেশ বা সুপ্রিম কোর্টের মতামত নেওয়ার প্রয়োজন হবে না। গতকাল সোমবার এক আলোচনা সভায় তিনি একটি অধ্যাদেশ জারি করে গণভোট আয়োজনের জন্য নির্বাচন কমিশনকে দায়িত্ব দিতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন।

অন্যদিকে জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল হামিদুর রহমান আযাদ গতকাল বলেছেন, জুলাই সনদ জনগণ অনুমোদন করে কি না, এটা নিয়েই হবে গণভোট। এটা হলে জুলাই সনদের শক্তিশালী আইনি ভিত্তি হবে। সেজন্য আমরা চাই আগে গণভোট হয়ে যাক।

নবগঠিত দল এনসিপি অবশ্য কমিশনের সভায় গণভোটের আগে জুলাই সনদকে একটি আইনি কাঠামোর মধ্যে আনার প্রস্তাব দিয়েছে।

জুলাই সনদের বাস্তবায়ন প্রশ্নে গণভোটের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে কোনো সন্দেহ না থাকলেও সময় নির্ধারণের এই বিভেদ এখন ঐকমত্য কমিশনের সামনে বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে দাঁড়িয়েছে। সংবিধান বিশেষজ্ঞ এবং দলগুলোর প্রতিনিধিদের নিয়ে আগামীকাল বুধবার আবারও বৈঠকের পরিকল্পনা রয়েছে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের। গণভোট জাতীয় নির্বাচনের আগে হবে না পরে, সেই সিদ্ধান্তই এখন দেশের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ নির্ধারণে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচিত হচ্ছে। এ বিষয়ে আশাবাদী নির্বাচন বিশেষজ্ঞরা।

জানতে চাইলে নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের সদস্য ও নির্বাচন বিশেষজ্ঞ ড. আব্দুল আলীম কালবেলাকে বলেন, গণভোট নিয়ে দলগুলোর মধ্যে চরম বিভক্তি ছিল। শেষ পর্যন্ত তারা একমত হয়েছে। তবে সেই ভোটের সময় নিয়ে দ্বিধাবিভক্তি থাকলেও দেশের মানুষ আশা করে, খুব দ্রুতই সেই বিভক্তি কেটে যাবে। কারণ, দলগুলো এরই মধ্যে তাদের জাতীয় নির্বাচনী প্রস্তুতি সেরে নিচ্ছে। সেজন্য গণভোটকে আর বাধা হিসেবে রাখতে চাইবে না তারা। আশা করি শিগগির আমরা গণভোটের সময় নিয়ে সুসংবাদ পাব।

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

সবাইকে নিয়ে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাব: নীরব

‘হামজা আমার দলে হলে বেঞ্চেই বসে থাকত’

লন্ডনে টাওয়ার হ্যামলেটসের মেয়রের সঙ্গে বাসস চেয়ারম্যানের মতবিনিময়

আফগানদের কাছে হারার পর যা বললেন মিরাজ

অল্প পুঁজি নিয়ে আফগানদের সাথে পারল না বাংলাদেশ

‘দেশের সার্বিক উন্নয়নে প্রবীণদের অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগাতে হবে’

রাবেতাতুল ওয়ায়েজীনের সঙ্গে সম্মিলিত খতমে নবুওয়ত পরিষদের মতবিনিময়

ডিএনসিসি এলাকায় টাইফয়েডের টিকা পাবে ১৩ লাখ শিশু

অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহে রেমিট্যান্স এসেছে ৬৯ কোটি ডলার

৭ বছর পর শহীদ জিয়ার মাজার জিয়ারত করলেন খালেদা জিয়া

১০

ফার্মগেটে ককটেল বিস্ফোরণ

১১

কালবেলার সংবাদের পর স্বপ্নের রঙিন ঘরে শাহারবানু

১২

আখিরাতের কল্যাণ নিশ্চিতে কাজ করছে জামায়াত : মুজিবুর রহমান

১৩

রাজধানীতে তারেক রহমানের সাক্ষাৎকারের রেকর্ডেড ভিডিও প্রদর্শন

১৪

জবাব দিতে পিএসসিকে আলটিমেটাম

১৫

অসদাচরণের অভিযোগে বদলি চিকিৎসক দম্পতি

১৬

সড়কের পাশে ময়লার ভাগাড়, দুর্গন্ধে অতিষ্ঠ মানুষ

১৭

শহীদ জিয়ার মাজারে দোয়া করলেন খালেদা জিয়া

১৮

নোয়াখালী বিভাগ চাইলেন ‘কাবিলা’

১৯

বেথ মুনির রেকর্ডে অস্ট্রেলিয়ার দুর্দান্ত জয়

২০
X