গত বছরের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার আন্দোলনে বোন শেখ রেহানাসহ দেশ ছেড়ে পালাতে বাধ্য হন সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এরপর ছয় শতাধিক হত্যা ও হত্যাচেষ্টা মামলার আসামি হন শেখ হাসিনা, যা তদন্তাধীন। এসব মামলা ছাড়াও চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে শেখ হাসিনা পরিবারের সাত সদস্যের বিরুদ্ধে প্লট দুর্নীতির অভিযোগে পৃথক ছয়টি মামলা করে দুদক। এসব মামলার বিচারকাজ দ্রুতই এগোচ্ছে। বর্তমানে সবকটি মামলাই সাক্ষ্য গ্রহণ পর্যায়ে রয়েছে। আসামিরা বিদেশে পলাতক থাকায় এবং তাদের পক্ষে কোনো আইনজীবী না থাকায় সাক্ষীদের জেরা বাদ দিয়েই সাক্ষ্য গ্রহণ শেষ হচ্ছে। রাষ্ট্রপক্ষ বলছে, আগামী নভেম্বরের মধ্যে দুর্নীতির এসব মামলায় রায় ঘোষণা হতে পারে। যে ধারায় আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়েছে, তাতে দোষী প্রমাণিত হলে সর্বনিম্ন চার বছর থেকে সর্বোচ্চ যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হতে পারে। এতে করে শেখ হাসিনা পরিবারের বাকি সদস্যদেরও নির্বাচনের পথ বন্ধ হতে পারে।
এদিকে, বিচারকাজ একতরফাভাবে এগোচ্ছে বলে মন্তব্য করে আওয়ামীপন্থি আইনজীবীরা বলছেন, ভবিষ্যতে রায় নিয়ে প্রশ্ন উঠবে।
আদালত সূত্রে জানা গেছে, শেখ হাসিনা, তার ছেলে জয় ও মেয়ে পুতুলসহ ১২ জনের বিরুদ্ধে প্লট দুর্নীতির পৃথক তিনটি মামলার বিচার চলছে ঢাকার বিশেষ জজ আদালত-৫-এ। এসব মামলায় সাক্ষী রয়েছেন ২৯ জন। তবে এরই মধ্যে ২৫ জনের সাক্ষ্য গ্রহণ শেষ হয়েছে। এ ছাড়া আরেক মামলায় সজীব ওয়াজেদ জয়সহ আসামি ১৭ জন। এ মামলায় ২৭ সাক্ষীর মধ্যে ২৪ জনের সাক্ষ্য গ্রহণ শেষ হয়েছে। অন্যদিকে, প্লট দুর্নীতির পৃথক আরেক মামলায় সায়মা ওয়াজেদ পুতুলসহ আসামি ১৮ জন। এ মামলায় ২৩ জন সাক্ষীর মধ্যে ১৮ জনের সাক্ষ্য গ্রহণ শেষ হয়েছে। আগামী ২৯ অক্টোবর বাকি আসামিদের সাক্ষ্য গ্রহণের দিন ধার্য রয়েছে।
এদিকে, মামলার নথি পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, প্রতি সপ্তাহে এসব মামলার সাক্ষ্য গ্রহণের দিন থাকে। মামলার প্রতি তারিখে তিন থেকে পাঁচজন সাক্ষীর সাক্ষ্য শেষ হচ্ছে।
এ ছাড়া ঢাকার বিশেষ জজ আদালত-৪-এ শেখ রেহানা, তার ছেলে রাদওয়ান মুজিব সিদ্দিক এবং মেয়ে আজমিনা সিদ্দিকের বিরুদ্ধে অন্য তিনটি মামলা বিচারাধীন। এর মধ্যে শেখ রেহানাসহ ১৭ জনের মামলায় সাক্ষী রয়েছেন ২৬ জন। এর মধ্যে ১৬ জনের সাক্ষ্য গ্রহণ শেষ হয়েছে। এ ছাড়া রেহানার মেয়ে আজমিনাসহ ১৮ জনের মামলায় ২৮ জন সাক্ষী রয়েছেন। এসব সাক্ষীর মধ্যে ১৬ জনের সাক্ষ্য গ্রহণ হয়েছে। এ ছাড়া রেহানার ছেলে রাদওয়ান মুজিবসহ ১৮ জনের মামলায় ২২ সাক্ষীর মধ্যে ১৩ জনের সাক্ষ্য গ্রহণ হয়েছে। এ তিন মামলায় শেখ হাসিনা ও টিউলিপ সিদ্দিককেও আসামি করা হয়েছে। আগামী ৩০ অক্টোবর সাক্ষ্য গ্রহণের জন্য দিন ধার্য রয়েছে।
মামলার বিচার প্রসঙ্গে দুদকের পাবলিক প্রসিকিউটর সুলতান মাহমুদ বলেন, সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তার পরিবারের বিরুদ্ধে ছয়টি মামলা বিচারাধীন। সাক্ষ্য গ্রহণের মাধ্যমে বিচার প্রক্রিয়া অনেকটাই এগিয়ে গেছে। সাক্ষীদের জবানবন্দিতে আসামিদের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ উঠে এসেছে। অক্টোবরের শেষের দিকে অথবা নভেম্বরের প্রথম দিকে এসব মামলা নিষ্পত্তি হবে। এতে ন্যায়বিচারের স্বার্থে আসামিদের সর্বোচ্চ সাজা যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হবে বলে প্রত্যাশা করছি।
এদিকে, শেখ হাসিনাসহ তার পরিবারের পক্ষে মামলায় লড়ার জন্য ওকালতনামা দেন আওয়ামীপন্থি আইনজীবী মোরশেদ আলম শাহীন। তিনি কালবেলাকে জানান, ‘সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ তার পরিবারের পক্ষে আইনি লড়াইয়ের জন্য ওকালতনামা জমা দিই। তবে আদালত সে আবেদন নামঞ্জুর করেছেন। আদালত বলেছেন, যদি এ মামলাগুলো সর্বোচ্চ সাজার যেমন মৃত্যুদণ্ডের হতো, তাহলে আপনাকে আইনজীবী নিয়োগ দিতে পারতাম। কিন্তু যেহেতু এ মামলা সর্বোচ্চ সাজার নয়, তাই দেওয়া যায় না। তখন আমরা বলি, এক মামলায় দিতে পারবেন, আরেক মামলায় দিতে পারবেন না—এটা আইনের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। আসামি শেখ হাসিনা পাঁচবারের সাবেক প্রধানমন্ত্রী, দুইবারের বিরোধীদলীয় নেত্রী। তিনি আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল।’
এ সময় তিনি আদালতে পেশ করা আইনের উদ্ধৃতি টেনে বলেন, ‘উচ্চ আদালতের একটি অর্ডিন্যান্স আছে। সেটার ৬৪৩ ধারায় বলা আছে, আসামি যদি অনুপস্থিত বা পলাতক থাকেন, তখন এ ক্ষেত্রে স্থানীয় আইনজীবী নিয়োগ দিতে পারেন। এমনকি আদালত বা সরকারও আইনজীবী নিয়োগ দিতে পারেন। ওই ধারা অনুযায়ী আমরা আদালতের কাছে দাবি করেছি, আমাদের আইনজীবী নিয়োগের জন্য। আইনের কপিও আমরা আদালতে উপস্থাপন করেছি। এ ধারা দুদকসহ সব মামলার জন্য প্রযোজ্য। কিন্তু অনুমতি দেওয়া হয়নি।’
এ আইনজীবী আরও বলেন, ‘একতরফাভাবে যেভাবে জাজমেন্ট হচ্ছে, ভবিষ্যতে এটা নিয়ে প্রশ্ন উঠবে। রায় নিয়েও প্রশ্ন উঠবে, আদালত নিয়েও। আমরা এখন দেখছি চিফ জাস্টিস পর্যন্ত জেলহাজতে। অনেক বিচারক ও আইনজীবীরাও জেলহাজতে। আমরা দেখছি, অনেক মামলা নিয়ে প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। একতরফা জাজমেন্ট যে সরকারের আমলেই হোক, এটা নিয়ে ভবিষ্যতে আদালত ও আইন নিয়ে প্রশ্ন উঠবে।’ মোরশেদ আলম শাহীন বলেন, ‘ভবিষ্যতে যেন এ মামলায় (প্লট দুর্নীতির) কোনো প্রশ্ন না হয়, আমরা মনে করি, যেহেতু এখন আদালতের সুযোগ ছিল পরিচালনার অনুমতি দেওয়ার। কিন্তু সুযোগ না দিয়ে আইনের শাসন এখানে প্রতিষ্ঠিত হয়নি। সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।’
এদিকে, আইনানুসারে শেখ হাসিনা পরিবারের বিরুদ্ধে এসব মামলায় সাজা হলে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নেওয়ার পথ বন্ধ হয়ে যাবে। বাংলাদেশের সংবিধানের ৬৬(২)(ঘ) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, কোনো ব্যক্তি নৈতিক স্খলনজনিত অপরাধে দুই বছরের অধিক কারাদণ্ডে দণ্ডিত হলে এবং সেই দণ্ড ভোগের পর পাঁচ বছর অতিবাহিত না হওয়া পর্যন্ত সংসদ সদস্য নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার যোগ্য থাকেন না। যদি আসামি এ রায়ের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে আপিল করেন এবং উচ্চ আদালত সেই সাজা স্থগিত বা বাতিল করে দেন, তবে সাংবিধানিক অযোগ্যতা কার্যকর থাকে না। যদিও অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের নতুন অধ্যাদেশ জারির কারণে মানবতাবিরোধী অপরাধ ও গণহত্যার দায়ে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে (আইসিটি) দায়ের হওয়া মামলায় আনুষ্ঠানিকভাবে অভিযোগ গঠন হওয়ায় শেখ হাসিনার নির্বাচনের পথ এরই মধ্যে বন্ধ হয়ে গেছে। দুদকের মামলায় সাজা হলে তার পরিবারের অন্য সদস্যদেরও নির্বাচনের পথ বন্ধ হয়ে যাবে।
শেখ হাসিনা পরিবারের প্লট দুর্নীতি মামলার অভিযোগপত্রে বলা হয়েছে, সরকারের সর্বোচ্চ পদে থাকাকালে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং তার পরিবার অর্পিত ক্ষমতার অপব্যবহার করেছেন। তারা বরাদ্দ পাওয়ার যোগ্য না হওয়া সত্ত্বেও অসৎ উদ্দেশ্যে পূর্বাচল আবাসন প্রকল্পের ২৭ নম্বর সেক্টরের ২০৩ নম্বর রাস্তার পাশে প্রত্যেকে ১০ কাঠা করে ছয়টি প্লট বরাদ্দ নেন। রাজউকের বিধান অনুযায়ী, ঢাকায় যাদের প্লট-গাড়ি-বাড়ি কিছুই নেই, তারাই মূলত সংস্থার প্লট বরাদ্দের জন্য আবেদন করতে পারেন। কিন্তু শেখ হাসিনার পরিবার রাজউকের কাছে মিথ্যা হলফনামা দেয়। সেখানে উল্লেখ করা হয়, তাদের ঢাকা শহরে জমি-বাড়ি কিছুই নেই। ক্ষমতার অপব্যবহার করে তারা রাজউকের ৬০ কাঠার প্লট নিয়েছেন, যা একটি অপরাধ। তাই আসামিদের বিরুদ্ধে দণ্ডবিধি, ১৮৬০-এর ১৬১/১৬৩/১৬৪/৪০৯/১০৯ ধারাসহ দুর্নীতি প্রতিরোধ আইন, ১৯৪৭-এর ৫(২) ধারায় অভিযোগ আনা হয়েছে। দুদক আইনের ৫(২) ধারায় কমপক্ষে চার বছর থেকে সর্বোচ্চ ১০ বছর পর্যন্ত কারাদণ্ডের বিধান রয়েছে। এ ছাড়া দণ্ডবিধিতে অপরাধজনক বিশ্বাসভঙ্গসহ অন্যান্য অপরাধের সর্বোচ্চ শাস্তি যাবজ্জীবন কারাদণ্ড রয়েছে।
মন্তব্য করুন