বাংলাদেশের গ্রামীণ ও উপকূলীয় সংস্কৃতিতে শুঁটকি একটি পরিচিত ও জনপ্রিয় খাবার। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে খাদ্য তালিকায় জায়গা দখল করে রাখা এই শুকনো মাছ শুধু স্বাদেই নয়, পুষ্টিগুণেও অনন্য। গবেষণা বলছে, শুঁটকি মাছ প্রোটিন, ক্যালসিয়াম, আয়রন, ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিড ও বিভিন্ন ভিটামিনের দারুণ উৎস।
তবে স্বাস্থ্য উপকারের পাশাপাশি কিছু সতর্কতা অবলম্বন করাও জরুরি, কারণ সঠিকভাবে প্রক্রিয়াজাত না হলে শুঁটকি ক্ষতিকর হয়ে উঠতে পারে। আজ আমরা জানব শুঁটকির উপকারিতা, পুষ্টিগুণ, স্বাস্থ্যঝুঁকি এবং নিরাপদভাবে গ্রহণের করণীয় সম্পর্কে।
আরও পড়ুন : কত বয়সে শুরু করবেন কোলেস্টেরল টেস্ট? চিকিৎসক যা বলছেন
আরও পড়ুন : শরীর যথেষ্ট ফাইবার পাচ্ছে কিনা বুঝবেন যেভাবে
পাশাপাশি জানব এ খাবার নিয়ে কী বলছেন পুষ্টিবিদ হাসিনা আকতার লিপি।
প্রোটিনের ভান্ডার
শুঁটকি একটি উচ্চ প্রোটিনসমৃদ্ধ খাবার। এতে প্রায় ৮০-৮৫% প্রোটিন থাকে, যা তাজা মাছের তুলনায় অনেক বেশি। শুকানোর ফলে পানির পরিমাণ কমে গিয়ে প্রোটিন ঘন হয়ে যায়। এই প্রোটিন দেহের কোষ গঠনে, পেশি মজবুত রাখতে, চুল ও ত্বকের স্বাস্থ্য বজায় রাখতে এবং ক্ষত সারাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধিতেও প্রোটিন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
আয়রনের উৎস
শুঁটকি মাছ আয়রনের একটি ভালো উৎস। এটি রক্তে হিমোগ্লোবিন গঠনে সহায়তা করে এবং শরীরের কোষে অক্সিজেন পরিবহন নিশ্চিত করে। আয়রনের অভাবে অ্যানিমিয়া দেখা দিতে পারে, যার ফলে ক্লান্তি, শ্বাসকষ্ট, মাথাব্যথা ও দুর্বলতা দেখা যায়।
ক্যালসিয়াম ও হাড়ের যত্ন
শুঁটকি ক্যালসিয়ামের অন্যতম ভালো উৎস। এটি হাড় ও দাঁত মজবুত করে এবং হাড়ের ঘনত্ব বজায় রাখতে সাহায্য করে। বয়স্কদের অস্টিওপোরোসিস প্রতিরোধে এবং শিশুদের হাড়ের বৃদ্ধি নিশ্চিত করতে শুঁটকি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।
ফসফরাসের উপস্থিতি
ফসফরাস ডিএনএ, আরএনএ এবং কোষের শক্তি উৎপাদনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। শুঁটকি মাছে এই খনিজ পদার্থের ভালো পরিমাণে উপস্থিতি হাড়, দাঁত ও কোষীয় স্বাস্থ্য রক্ষায় কার্যকর।
ওমেগা-৩ ফ্যাটি এসিড
শুঁটকি মাছ ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিডের সমৃদ্ধ উৎস। এটি হৃদরোগের ঝুঁকি কমায়, রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ করে এবং স্মৃতিশক্তি ও মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নতিতে সহায়ক। এ ছাড়া, প্রদাহ কমাতে এবং আর্থ্রাইটিসের ঝুঁকি হ্রাস করতেও এটি কার্যকর।
ভিটামিনের আধার
শুঁটকি মাছ ভিটামিন এ, ডি ও বি-কমপ্লেক্সে ভরপুর। ভিটামিন এ রাতকানা প্রতিরোধে সহায়ক, ভিটামিন ডি হাড়ের স্বাস্থ্য বজায় রাখে এবং বি-কমপ্লেক্স ভিটামিনগুলো স্নায়ুতন্ত্র এবং শক্তি উৎপাদনে সহায়তা করে।
অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট ও রোগ প্রতিরোধ
শুঁটকিতে থাকা অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট বিভিন্ন সংক্রমণ ও রোগ প্রতিরোধে সহায়তা করে। এতে থাকা ভিটামিন, মিনারেল ও প্রোটিন শরীরের ইমিউন সিস্টেমকে শক্তিশালী করে।
ইলেক্ট্রোলাইট ভারসাম্য
শুঁটকি প্রাকৃতিকভাবে লবণ ও পটাশিয়াম সরবরাহ করে, যা শরীরের ইলেক্ট্রোলাইট ব্যালেন্স বজায় রাখতে সহায়তা করে। তবে অতিরিক্ত লবণ গ্রহণ উচ্চ রক্তচাপের কারণ হতে পারে, তাই লবণ ব্যবহার নিয়ন্ত্রণে রাখা জরুরি।
সহজপাচ্য ও হজমে সহায়ক
শুঁটকি মাছ সাধারণত সহজপাচ্য এবং হজম প্রক্রিয়ায় সহায়ক। এতে থাকা প্রাকৃতিক এনজাইম হজমশক্তি বৃদ্ধি করে। তবে অতিরিক্ত তেল-মসলাযুক্ত রান্না বদহজমের কারণ হতে পারে, তাই পরিমিত ও স্বাস্থ্যকর রান্নার পরামর্শ দেওয়া হয়।
যদিও শুঁটকি পুষ্টিকর, তবে প্রচলিত উৎপাদন পদ্ধতির কারণে অনেক সময় এটি স্বাস্থ্যহানিকর হয়ে উঠতে পারে। সাধারণত মাছ ধরার পর সরাসরি রোদে শুকানো হয়, যেখানে সঠিক পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার অভাব থাকে। এতে ধুলোবালি, কাদা, কীটপতঙ্গ, এমনকি কুকুর বা বিড়ালের সংস্পর্শে আসার ঝুঁকি থাকে। অনেক সময় শুঁটকি সংরক্ষণে কীটনাশকও ব্যবহার করা হয়, যা মানবদেহের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। এ ছাড়া বাসি বা নষ্ট মাছ দিয়ে শুঁটকি তৈরি করা হলে তার গুণগতমান মারাত্মকভাবে কমে যায়।
স্বাস্থ্যকরভাবে শুঁটকি উপভোগ করতে কিছু বিষয় মাথায় রাখা জরুরি:
অতিরিক্ত লবণ এড়িয়ে চলুন : শুঁটকিতে প্রাকৃতিকভাবেই লবণ থাকে, তাই অতিরিক্ত লবণ দিয়ে রান্না করা ঠিক নয়।
বিশুদ্ধ ও রাসায়নিকমুক্ত শুঁটকি বেছে নিন : বাজারজাত অনেক শুঁটকিতে ক্ষতিকর রাসায়নিক মেশানো হয়। ভালো ব্র্যান্ড বা বিশ্বস্ত উৎস থেকে কেনা উচিত।
কম তেল-মসলা ব্যবহার করুন : অতিরিক্ত তেল ও মসলা শুঁটকির হজমে সমস্যা তৈরি করতে পারে, বিশেষ করে যাদের গ্যাস্ট্রিক বা উচ্চ রক্তচাপ রয়েছে।
শুঁটকি যাতে স্বাস্থ্যবান্ধব ও নিরাপদ হয়, তার জন্য প্রয়োজন উন্নত ও বিজ্ঞানভিত্তিক উৎপাদন ব্যবস্থা। মাছ আহরণ থেকে শুরু করে রোদে শুকানো, সংরক্ষণ এবং মোড়কজাত পর্যন্ত প্রতিটি ধাপে পরিচ্ছন্নতা, সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ এবং নিরাপদ খাদ্য প্রক্রিয়ার অনুসরণ আবশ্যক। সঠিক গাইডলাইন মেনে উৎপাদন ও বাজারজাত করলেই শুঁটকি হতে পারে স্বাস্থ্যকর ও বিশ্বমানের খাদ্যপণ্য।
চট্টগ্রাম ল্যাবএইড এবং পার্ক ভিউ হাসপাতাল অ্যান্ড ডায়াগনস্টিক লিমিটেডের কনসালট্যান্ট পুষ্টিবিদ হাসিনা আকতার লিপি জানিয়েছেন, শুঁটকি মাছের মধ্যে প্রাকৃতিকভাবে প্রচুর পটাশিয়াম থাকে, যা শরীরের পানির ভারসাম্য (fluid balance) বজায় রাখতে সহায়তা করে এবং হৃদযন্ত্রের স্বাভাবিক কার্যক্রমে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
এছাড়া এতে থাকা ফসফরাস হাড় ও দাঁতের গঠনে সহায়ক হওয়ার পাশাপাশি ডিএনএ ও আরএনএ গঠনেও সহায়তা করে। ফলে শুঁটকি একটি কার্যকর পুষ্টিকর খাবার হিসেবেই বিবেচিত।
আরও পড়ুন : টি ব্যাগ দিয়ে তৈরি চা কি শরীরের জন্য নিরাপদ? কি বলছেন পুষ্টিবিদ
আরও পড়ুন : ইউরিক অ্যাসিড কমাতে সাহায্য করে যে ৫ বাদাম ও শুকনো ফল
তবে তিনি সতর্ক করে বলেন, যেমন এর রয়েছে নানা উপকারিতা, তেমনি কিছু সতর্কতাও জরুরি। বিশেষ করে যাদের কিডনি সমস্যা রয়েছে বা রক্তে ইউরিক অ্যাসিডের মাত্রা বেশি, তাদের জন্য শুঁটকি খাওয়া বিপজ্জনক হতে পারে। এ ছাড়া, শুঁটকি খাওয়ার পর যদি কারও শরীরে অসুবিধা দেখা দেয়, তাহলে দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত।
মন্তব্য করুন