বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির ডা. সৈয়দ আব্দুল্লাহ মো. তাহের বলেছেন, দীর্ঘ কয়েক মাস ধরে বহু দলের পরিশ্রমে আমরা যে ঐকমত্যে পৌঁছেছি, তাতে অনেকে সই করেছেন। এখন প্রয়োজন জুলাই সনদের আইনি ভিত্তি। গতকাল বুধবার রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের তিনি এসব কথা বলেন। উপদেষ্টা পরিষদে থাকা কেউ কেউ প্রধান উপদেষ্টাকে বিভ্রান্ত করছেন জানিয়ে এ বিষয়ে তাকে সতর্ক থাকার কথাও জামায়াতের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে বলে জানান ডা. তাহের। এ ছাড়া নির্বাচনের আগে যেখানে যেখানে রদবদল দরকার, তা করে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরির কথাও তারা প্রধান উপদেষ্টাকে বলেছেন বলে জানান তিনি।
এর আগে গতকাল বুধবার সন্ধ্যা পৌনে ৬টার দিকে জামায়াতের প্রতিনিধিদলটি যমুনায় প্রবেশ করে। প্রতিনিধিদলে ডা. তাহের ছাড়াও ছিলেন দলটির সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার, সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল এটিএম মা’ছুম ও রফিকুল ইসলাম খান।
বৈঠক শেষে বেরিয়ে ডা. তাহের সাংবাদিকদের বলেন, আমরা দুটি কথা খুব স্পষ্ট বলেছি যে, দীর্ঘ কয়েক মাস ধরে বহু লোকের পরিশ্রমে বিভিন্ন দলের অংশগ্রহণে আমরা যে ঐকমত্যে পৌঁছেছি প্রায় ৮০টির ওপরে সংস্কারে, তার ভেতরে বেসিক কতগুলো পয়েন্টস আছে, যার সংখ্যা ১৯টির মতো এবং এখানে আমরা সবাই স্বাক্ষর করেছি। এখন যেটা প্রয়োজন এটাকে আইনি ভিত্তি দেওয়া এবং বাস্তবায়ন করা। এই সনদের মাঝে যেগুলো আগামী নির্বাচন সংশ্লিষ্ট, সেগুলোকে আগেই পাস করিয়ে তার ভিত্তিতে নির্বাচন দেওয়া। সেটা হচ্ছে গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের বলা হয়েছে, যেসব পয়েন্টে আপনারা একমত হয়েছেন, সেগুলো নিয়ে সনদ হয়েছে। আমরা এটা বাস্তবায়নের জন্য প্রধান উপদেষ্টার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছি। তিনি আমাদের সঙ্গে একমত হয়েছেন যে, এটা বাস্তবায়ন যদি না হয় তাহলে এটা পণ্ডশ্রম ছাড়া কিছু নয়। তিনি যথাযথ উদ্যোগ নেবেন বলে জানিয়েছেন। তবে আমরা একটি আদেশের মাধ্যমে এটাকে সাংবিধানিক মর্যাদা দেওয়ার কথা বলেছি। এটা কনস্টিটিউশন নয়। এটা হচ্ছে এক্সট্রা কনস্টিটিউশনাল অ্যারেঞ্জমেন্ট। যেটা কোনো সরকার এরকম একটি পরিস্থিতিতে পড়লে দেওয়ার এখতিয়ার রাখে। প্রধান উপদেষ্টা একমত হয়েছেন যে, একটা আদেশের মাধ্যমে এটা হবে। কেউ বলেছেন অধ্যাদেশ দেওয়ার জন্য। অধ্যাদেশ খুব দুর্বল। তবে ঐকমত্য কমিশন এক্সপার্ট কমিটির সঙ্গে বসা অব্যাহত রয়েছে এবং সবাই এই পরামর্শ দিয়েছেন যে, একটি আদেশের মাধ্যমেই এটাকে বৈধতা দিতে হবে।
তিনি আরও বলেন, সেই আদেশের ওপরেই গণভোট হবে। আমরা এটা ক্লিয়ারলি বলে আসছি। উনি আমাদের কথায় কনভিন্সড হয়েছেন বলে মনে হয়। আমরা আশা করি সেদিকেই যাবে। দ্বিতীয়ত, আমরা গণভোটের ব্যাপারে বলেছি। গণভোটের ব্যাপারে বিএনপি কোনোভাবে রাজি হচ্ছিল না প্রথম দিকে। আমরা এটা জোর দিয়েছিলাম। কিন্তু শেষ পর্যন্ত বিএনপি গণভোটে রাজি হয়েছে। আমরা বিএনপিকে ধন্যবাদ জানাই। তারপরও তারা একটা জটিলতা তৈরি করার চেষ্টা করছে। সেটা হচ্ছে গণভোট এবং জাতীয় নির্বাচন এক দিন হতে হবে। দুটি একেবারে আলাদা জিনিস। এখন প্রশ্ন তুলেছে তারা যে, সময় আছে কি না? সময় আছে। বাংলাদেশে তিনটা গণভোট হয়েছে। এর মধ্যে একটা হয়েছে ২১ দিনের ব্যবধানে। একটা হয়েছে ১৭ দিনের ব্যবধানে। আমরা বলেছি নভেম্বরের শেষে গণভোট করেন। প্রায় এক মাসের বেশি সময় আছে।
তারপর আরও আড়াই মাস থাকবে জাতীয় নির্বাচনের জন্য। সুতরাং এখানে সময়ের কোনো সমস্যা নয়। প্রশ্ন তোলা হয়েছে, অনেক খরচ হবে। না, অনেক খরচ হবে না। কারণ, আমরা যে বাক্স কিনব দুটি নির্বাচনের জন্য কিনব, আমরা যে মেশিনারিজ কিনব, সব দুটির জন্য কিনব। এখানে শুধু কালি, ছোট একটা কাগজ আর যাতায়াত ভাড়া—এই কয়েকটি। জাতীয় স্বার্থের জন্য যেভাবে কোটি কোটি টাকা খরচ করে আমরা নির্বাচন করি, কেউ যদি এটা বলে যে, নির্বাচন দরকার নাই। কারণ এখানে প্রায় ১ হাজার কোটি টাকা খরচ হয়। এটা কি যুক্তিযুক্ত হবে? হবে না। দেশের কল্যাণের জন্যে কিছু টাকা খরচ করে একটি সুষ্ঠুতার সঙ্গে যদি আমরা জাতীয় নির্বাচনে যেতে পারি, তাহলে এটা সবচেয়ে উত্তম।
জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির আরও বলেন, একটা জটিলতা তৈরির প্রক্রিয়া চলছে। আমরা খুব
সহজ-সরলভাবে যেটা সঠিক, সেভাবে আমরা অগ্রসর হতে চাচ্ছি। কারণ আমরা চাই জনগণের অংশগ্রহণমূলক একটা নির্বাচন, যা আমাদের জন্য জরুরি, দেশকে স্থিতিশীল করার জন্য। এজন্য কোনো ধরনের জটিলতা তৈরি না করে আমরা সবাই মিলে যেন ফেব্রুয়ারিতে একটা আনন্দময় নির্বাচনে যেতে পারি। সেভাবে আচরণের জন্যই আমি সব রাজনৈতিক দলের প্রতি আমি আহ্বান জানাচ্ছি। এ ছাড়াও আমরা বলেছি ইলেকশন কমিশনে, সচিবালয়ে, পুলিশ প্রশাসনে প্রায় ৭০-৮০ শতাংশ অফিসার একটি দলের আনুগত্য করছে। আমরা গেলে তারা বলে যে, প্রচণ্ড চাপ। চাপ কোত্থেকে? তারা বলেছে, একটি দল থেকে আসছে। পুলিশে একই অবস্থা আছে। তারপর প্রসিকিউটর যারা হয় ওখানেও পিপি, এপিপি ৮০ শতাংশ হচ্ছে একটি বিশেষ দলের—এই যে ইমব্যালেন্সটা হয়ে আছে। আমরা বলেছি, আপনি নিরপেক্ষ সরকার, লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরি করুন। নির্বাচনের আগে যেখানে রদবদল করা দরকার, আপনি তা করুন। প্রধান উপদেষ্টা বলেছেন, উনি নিজে তত্ত্বাবধান করবেন এবং লটারি সিস্টেমে পোস্টিং ঠিক করবেন। আমরা বলেছি আমাদের কোনো আপত্তি নেই।
তিনি বলেন, বিভিন্ন জায়গায় আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটছে এবং কবিরহাট নামে নোয়াখালীর একটা জায়গায় দুদিন আগে ছাত্রশিবিরের একটা মিটিংয়ে বিএনপির লোকজন প্রকাশ্যে হামলা করেছে। এরকম যদি এখনই শুরু হয়, তাহলে নির্বাচন কী হবে। এটা যদি থামাতে না পারেন, তাহলে নির্বাচন নিয়ে সংশয় তৈরি হবে, অনিশ্চয়তা তৈরি হবে।
ডা. তাহের আরও বলেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিষয়ে আমরা আলোচনা করিনি দুটি কারণে। এক, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ব্যাপারে এখনো সুপ্রিম কোর্টে শুনানি হচ্ছে। আমরা সুপ্রিম কোর্টের রায়ের অপেক্ষায় আছি। প্রধান উপদেষ্টা আমাদের বক্তব্য শুনেছেন। উনি আমাদের যুক্তিকে মূল্য দিচ্ছেন বলে মনে করি।
তিনি বলেন, সরকারের যারা উপদেষ্টা আছেন তাদের ব্যাপারে বলেছি, সবার ব্যাপারে নয়। আমরা বলেছি কিছু লোক আপনাকে বিভ্রান্ত করে। ওরা কোনো একটা দলের পক্ষে কাজ করে বলে আমরা মনে করি। তাদের ব্যাপারে আপনাকে হুঁশিয়ার থাকা দরকার। আপনার প্রতি আমাদের আস্থা আছে। প্রধান উপদেষ্টা বলেছেন, গভীরভাবে চিন্তাভাবনা করছেন এবং যেটা উত্তম হবে সেটি উনি করবেন ইনশাআল্লাহ।
মন্তব্য করুন