প্রাতিষ্ঠানিক নিয়োগ বিধির তোয়াক্কা না করে প্রথমে সৃষ্টি করা হয় পদ। এরপর কোনোরকম সার্কুলার ছাড়াই ১২১ জনকে চাকরি দেওয়া হয়। এমনকি সার্টিফিকেট জালিয়াতি করেও চাকরি পেয়েছেন বেশ কয়েকজন। এই প্রক্রিয়ায় নিয়োগ কমিটির সুপারিশ নেই। কোনো নিয়োগপত্রও দেওয়া হয়নি। তবুও সরকারি তহবিল থেকে তারা নিয়মিত বেতন পাচ্ছেন। পাট অধিদপ্তরের প্রকল্প থেকে রাজস্ব খাতে অস্থায়ী জনবল নিয়োগে এমন তুঘলকি কাণ্ড ঘটেছে।
বস্ত্র ও পাট, অর্থ ও জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় এবং বাংলাদেশ পাবলিক সার্ভিস কমিশন (পিএসসি) এরই মধ্যে এই নিয়োগ যথাযথ হয়নি বলে জানিয়েছে। তা সত্ত্বেও বছরের পর বছর ধরে এই কর্মকর্তা-কর্মচারীরা বেতন পাচ্ছেন। উচ্চ আদালতের নির্দেশের পরও অস্থায়ী রাজস্ব খাতের এই নিয়োগ বাতিল করা হয়নি।
জানা গেছে, ১৯৯৩ থেকে ১৯৯৮ সাল পর্যন্ত এই কর্মকর্তা-কর্মচারীরা ‘সমন্বিত উফশী পাট ও পাটবীজ উৎপাদন দ্বিতীয় পর্যায়’ শীর্ষক প্রকল্পে কর্মরত ছিলেন। ওই প্রকল্পের মেয়াদ শেষে তাদের বিভিন্ন প্রকল্পে কাজে লাগানো হয়। ২০১১ সালের ১ জুলাই থেকে তারা রাজস্ব খাত থেকে বেতন পাচ্ছেন। তাদের মধ্যে ৫৩ জন প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির কর্মকর্তা। অন্যরা তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, উল্লিখিত ১২১ কর্মকর্তা-কর্মচারীর শিক্ষা সনদের সত্যতা যাচাইয়ের জন্য বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয় থেকে এক কর্মকর্তাকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। তিনি প্রাথমিক তদন্তে ৭০ জনের সার্টিফিকেট জালিয়াতির প্রমাণ পান। তবে যাচাই প্রক্রিয়া শেষ করার আগেই তাকে অন্য মন্ত্রণালয়ে বদলি করা হয়। এরপর আর ওই তদন্ত শেষ হয়নি।
সংশ্লিষ্ট নথিপত্রে দেখা যায়, অস্থায়ী রাজস্ব খাতে নিয়োগ দেওয়া প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির ৫৩ কর্মকর্তার মধ্যে ৪০ জনের নিয়োগপত্র নেই উল্লেখ করে বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়ের সহকারী সচিব মো. জাহাঙ্গীর আলম চলতি বছরের ১৮ জানুয়ারি পিএসসিতে চিঠি দেন। এতে ওই কর্মকর্তাদের চাকরি নিয়মিত করার সুপারিশ করা হয়।
এই সুপারিশের জবাবে পিএসসি বলছে, ওই কর্মকর্তা-কর্মচারীরা রাজস্ব খাতে স্থানান্তরের জন্য তিনটি শর্ত পূরণ করতে হবে। এর মধ্যে তাদের চাকরি সন্তোষজনক হলেও নিয়োগপত্র ও নিয়োগবিধি এবং চাকরির ধারাবাহিকতা নেই। ফলে তাদের চাকরি রাজস্ব খাতে নিয়মিত করা সম্ভব নয়।
এর আগে ২০১৩ ও ২০২২ সালে জনপ্রশাসন ও অর্থ মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে পাট অধিদপ্তরকে দেওয়া চিঠিতে বলা হয়, ১২১ জনের পদায়ন বিধিসম্মত হয়নি এবং তাদের চাকরির ধারাবাহিকতা নেই।
জানা গেছে, ওই নিয়োগের বিষয়ে অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে ২০২২ সালের ১১ নভেম্বর ১২১ জনের নিয়োগের বৈধতা যাচাইয়ের জন্য চেয়ে বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়ের কাছে ২১টি কাগজপত্র চেয়ে চিঠি দেয় হিসাব মহানিয়ন্ত্রকের কার্যালয়। এর মধ্যে তিনটি ছাড়া বাকি ১৮টির তথ্য এখনো সরবরাহ করতে পারেনি মন্ত্রণালয়। এরপর পাট অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এবং মন্ত্রণালয়ের প্রধান হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তাকে একই বিষয়ে আরও তিনটি চিঠি দেওয়া হয়। চলতি বছরের ১২ ফেব্রুয়ারি সর্বশেষ চিঠিতে ১৮টি তথ্যসহ ১২১ কর্মকর্তা-কর্মচারীর জাতীয় পরিচয়পত্রের ফটোকপি ও প্রকল্পে থাকাকালীন চাকরি বহির সত্যায়িত ফটোকপি চাওয়া হয়। তবে এখন পর্যন্ত সেগুলো সরবরাহ করা হয়নি।
এ বিষয়ে হিসাব মহানিয়ন্ত্রক কার্যালয়ের উপহিসাব মহানিয়ন্ত্রক (পদ্ধতি) শহিদুল ইসলাম মোল্লা কালবেলাকে বলেন, ‘নিয়োগের বৈধতা যাচাইয়ের জন্য পাট মন্ত্রণালয়ের কাছে ২১টি প্রয়োজনীয় কাগজ চেয়েছিলাম। কয়েক দফা চিঠির পরিপ্রেক্ষিতে মাত্র তিনটি পাওয়া গেছে। অন্যগুলো সরবরাহ করা হচ্ছে না।’
অনুসন্ধানে জানা গেছে, ‘জুট ডেভেলপমেন্ট মটিভেটর’ পদে প্রকল্পে যাদের নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল তারা অস্থায়ী রাজস্ব খাতে যাওয়ার সময় পদ ও স্কেল পরিবর্তন করেছেন। ‘সমন্বিত পাট উৎপাদন ও বাজারজাতকরণ প্রকল্পে’ হিসাব সহকারী পদে মো. সোলায়মান অস্থায়ী রাজস্ব খাতে পদ ও স্কেল পরিবর্তন করে হিসাব রক্ষণ কর্মকর্তা পদের বেতন পাচ্ছেন। পাট অধিদপ্তরের ২০০৯ বিধিমালায় হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা পদে অনার্স দ্বিতীয় শ্রেণির যোগ্যতার কথা বলা হলেও তিনি পাস কোর্সে তৃতীয় শ্রেণিতে উত্তীর্ণ।
প্রকল্পের প্রশাসনিক ও হিসাব সহকারী পদে নিয়োজিত সওগাতুল আলম রাজস্ব খাতে যোগ দেন সমন্বয় কর্মকর্তা পদে। পদে তার যোগদানপত্র নেই। এমনকি পাট অধিদপ্তরের জনবল কাঠামোয় এ ধরনের কোনো পদ নেই।
প্রকল্পে হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্ব পালনকারী হাবিবুর রহমান রাজস্বে কাজ করছেন সহকারী পরিচালক পদে। অধিদপ্তরের নিয়োগ বিধিমালা-২০০৯ অনুযায়ী এ পদে প্রথম শ্রেণির স্নাতকোত্তর ডিগ্রি বা দ্বিতীয় শ্রেণিতে স্নাতক উল্লেখ থাকলেও তিনি পাস কোর্সে তৃতীয় শ্রেণির সার্টিফিকেট দিয়ে চাকরি পেয়েছেন।
জান্নাতুল ফেরদৌস প্রকল্প থেকে অস্থায়ী রাজস্বে যাওয়ার সময় ‘মনিটরিং অ্যান্ড ইভালুয়েশন অফিসার’ পদে যোগ দেন। এ পদে নিয়োগ বিধিতে চার বছরের স্নাতক/স্নাতকোত্তরসহ দ্বিতীয় শ্রেণির কথা উল্লেখ থাকলেও তিনি অনার্স তৃতীয় শ্রেণির সার্টিফিকেটে চাকরি করছেন।
জানা গেছে, ‘উচ্চ ফলনশীল (উফশী) পাট ও পাটবীজ উৎপাদন এবং উন্নত পাট পচন’ শীর্ষক আরেকটি প্রকল্পের প্রস্তাবে উল্লেখ ছিল, প্রকল্প শেষে সব জনবল স্বয়ংক্রিয়ভাবে রাজস্ব খাতে স্থানান্তর করা হবে। কিন্তু ২০১৭ সালে ওই প্রকল্পের মেয়াদ শেষে পাট অধিদপ্তর তা করেনি। এ কারণে ওই প্রকল্পের ১৫৮ জন অধিদপ্তরের বিরুদ্ধে আদালতের দ্বারস্থ হন। তাদের রিট পিটিশনের ভিত্তিতে গত ২ আগস্ট রুল জারি করেন হাইকোর্ট। এতে ১২১ জন কর্মকর্তা-কর্মচারীর নিয়োগ কেন অবৈধ ঘোষণা করা হবে না—পাট অধিদপ্তরকে চার সপ্তাহের মধ্যে তার জবাব দিতে বলা হয়। সেইসঙ্গে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক), জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়, অর্থ মন্ত্রণালয়, মহাহিসাব রক্ষক নিয়ন্ত্রকের কার্যালয়কে তদন্ত সাপেক্ষে ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দেন আদালত।
এর আগে ২০১৭ সালের ৩ আগস্ট ‘উচ্চ ফলনশীল (উফশী) পাট ও পাটবীজ উৎপাদন এবং উন্নত পাট পচন’ প্রকল্পের সবাইকে রাজস্ব খাতে নিয়োগ দেওয়ার নির্দেশ দেন আদালত। পাট অধিদপ্তর ওই রায়ের বিরুদ্ধে আপিল ও রিভিউতে হেরে ১৫৮ জনের মধ্যে ২৪ জনকে নিয়োগ দেয়। বাকি ১৩৪ জনকে নিয়োগ না দিয়ে আদালতের রায় অবমাননার বিষয়ে উচ্চ আদালতের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে ২০১৯ সালের ১১ জানুয়ারি আদালত আবারও তাদের নিয়োগের নির্দেশ দেন। এরপর ২০২২ সালে পুনরায় বিষয়টি উচ্চ আদালতের দৃষ্টিতে আনা হলে কোনো অজুহাত না দেখিয়ে ১৩৪ জনকে সরাসরি নিয়োগের নির্দেশ দেওয়া হয়। তবে আদালতের সেই রায় এখনো বাস্তবায়ন হয়নি।
উচ্চ আদালতের নির্দেশনার ১৩৪ জনকে রাজস্ব খাতে নিয়োগ দিতে বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয় একাধিকবার পাট অধিদপ্তরকে তাগিদ দিয়েছে। তবে অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মন্ত্রণালয়ের নির্দেশও আমলে নিচ্ছেন না বলে অভিযোগ করছেন ভুক্তভোগীরা।
এসব বিষয়ে কথা বলার জন্য পাট অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ড. সেলিনা আক্তারকে ফোন করা হলে এই প্রতিবেদকের পরিচয় জানার পর ব্যস্ততার কথা বলে কল কেটে দেন। এরপর আর তিনি ফোন রিসিভ করেননি। খুদেবার্তা পাঠানো হলেও তার জবাব মে লেনি।
বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. আব্দুর রউফের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি এই প্রতিবেদকের সঙ্গে রীতিমতো অশোভন আচরণ করেন। হোয়াটসঅ্যাপে ফোন করে প্রশ্ন করার পরই তিনি ক্ষেপে উঠে বলেন, ‘আপনি সাংবাদিক কি না এ বিষয়ে সন্দেহ আছে। যদি সাংবাদিক হতেন তাহলে এমন প্রশ্ন করতেন না। আপনি মামলাবাজদের একজন। তাদের পক্ষ নিয়ে আমাকে টেলিফোন করেছেন। এ বিষয় ছাড়া মন্ত্রণালয়ের গুরুত্বপূর্ণ আর কিছু নেই আপনার কাছে?’
উচ্চ আদালতের আদেশ বাস্তবায়নে মন্ত্রণালয় থেকে পাট অধিদপ্তরকে দেওয়া নির্দেশ সম্পর্কে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, ‘আমার কাছে সব বিভাগের খবর নেই। আপনি যদি মন্ত্রণালয়ের অন্য কোনো বিষয়ে কথা বলতে চাইতেন, তাহলে বলতাম। এটি একেবারেই অবান্তর প্রশ্ন।’
মন্তব্য করুন