কোনোটির জায়গা দখল করে বসানো হয়েছে ওয়াসার পানির পাম্প। কোনোটির সীমানার ভেতর নির্মাণ করা হয়েছে বাড়ি কিংবা দোকান। আছে শ্রেণিকক্ষের পাশে বাজার বসার উদাহরণও। আবার সরকারি সংস্থা ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষণার পরও নিরুপায় হয়ে জরাজীর্ণ ভবনে চলছে পাঠদান।
রাজধানী ঢাকার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের চিত্র মোটা দাগে এমনটাই। বেশিরভাগ বিদ্যালয়ের প্রায় সব শিক্ষার্থী নিম্নবিত্ত পরিবারের সন্তান। আর এ কারণেই এগুলোর প্রতি শিক্ষা বিভাগ কিংবা স্থানীয় সচেতন মানুষের মনোযোগ নেই বলে শিক্ষাবিদরা মনে করেন।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ঢাকা মহানগরীতে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সংখ্যা ৩৪২। এর মধ্যে বেদখল হয়ে আছে কমপক্ষে ৪০টির জমি কিংবা ভবন।
ঢাকা জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসের তথ্য বলছে, ডেমরা থানার ৭টি, মতিঝিলের ৭টি, সূত্রাপুরের ৬টি, কোতোয়ালির ৪টি, ধানমন্ডির ১টি, মিরপুরের ৫টি, মোহাম্মদপুরের ৩টি, গুলশানের ২টি, রমনার ২টি এবং তেজগাঁও থানার ১টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় জরাজীর্ণ ও বেদখলের তালিকায় রয়েছে। এর মধ্যে ৮টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পাম্প বসিয়ে দখল করে রেখেছে ওয়াসা। ১২টিতে দখল করে রেখেছে পার্শ্ববর্তী উচ্চ বিদ্যালয়। বাকিগুলো ধর্মীয় উপাসনালয়, বস্তি, দোকান, বাজার ইত্যাদির মাধ্যমে দখল করে রেখেছে স্থানীয় প্রভাবশালীরা। আবার দুটি বিদ্যালয়ে বেদখল এবং জরাজীর্ণ দুই সমস্যাই আছে।
প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা বলছেন, ঢাকার বেশিরভাগ প্রাথমিক বিদ্যালয়ের অবকাঠামো ভালো নয়। জরাজীর্ণ ও বেদখলের কারণে উচ্চবিত্তরা এসব বিদ্যালয় থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন। গ্রামে বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কম থাকায় বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সরকারিই ভরসা। ফলে সেসব বিদ্যালয়ে ভর্তির ক্ষেত্রেও থাকে প্রতিযোগিতা। কিন্তু ঢাকায় অভিভাবকদের বিকল্প চিন্তার সুযোগ অবারিত। সে কারণে উচ্চবিত্ত তো বটেই, মধ্যবিত্তরাও সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সন্তানকে ভর্তির চিন্তা করেন না। মূলত এসব বিদ্যালয়ে পড়তে আসে নিম্নবিত্ত পরিবারের ছেলেমেয়েরা। দীর্ঘ অবহেলা ও অমনোযোগের কারণে এ ধরনের বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠানেরই এখন বেহাল অবস্থা।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক মজিবুর রহমান কালবেলাকে বলেন, ‘শিক্ষকের সংখ্যা ও মান, স্কুলের অবস্থান, খেলার আলাদাসহ পর্যাপ্ত জায়গা, নিরাপত্তা ইত্যাদি বিবেচনা করলে দেশে যে গড়পড়তা প্রাথমিক বিদ্যালয় আছে, তার চেয়েও খারাপ অবস্থা খোদ রাজধানীতে। এর কারণ হলো, একটি গোষ্ঠী চায় না, ঢাকার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলো ভালো করুক। তারা বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের স্বার্থ রক্ষা করতে গিয়ে সরকারি প্রাথমিকের দিকে দৃষ্টি দিচ্ছে না।’
তিনি বলেন, ‘নীতিনির্ধারকদের সন্তানরা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়াশোনা করে না। সচেতন মানুষ বেসরকারি গুটিকয় প্রতিষ্ঠানের প্রতি আগ্রহী। ফলে প্রাথমিকের দিকে মনোযোগ দেওয়া হয়নি। সেজন্য নীতি পরিবর্তন না করলে অদূরভবিষ্যতেও ভালো কিছু দেখব, এমন আশা করতে পারছি না।’
ঢাকা জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিস থেকে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে গত এক মাসে রাজধানীর চারটি থানার অন্তত ২০টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ঘুরেছেন এই প্রতিবেদক। সরেজমিন গিয়ে সরকারি তালিকার বাইরেও কয়েকটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে জরাজীর্ণ ভবনে পাঠদান করতে দেখা গেছে। শিক্ষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ঝুঁকিপূর্ণ এসব ভবন সংস্কার কিংবা পুনর্নির্মাণের জন্য জমি পরিমাপ ও মাটি পরীক্ষা করা হয়েছে। এরপর দীর্ঘদিনেও আর অগ্রগতি নেই। আর সেসব বিদ্যালয়ের বেদখল হয়ে থাকা জায়গা উদ্ধারে নেই চোখে পড়ার মতো কোনো তৎপরতা।
সূত্রাপুর থানাধীন বাংলাবাজার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ঠিকানায় গিয়ে বিদ্যালয়ের কোনো অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি। সেখানে বসবাস করছে একটি পরিবার।
স্থানীয়রা জানান, অনেক বছর আগে এখানে পাঠদান কার্যক্রম চলতে দেখেছেন তারা। এরপর কখন কীভাবে বিদ্যালয়টি বন্ধ হয়েছে, সেটি তারা জানেন না।
বিদ্যালয়ের বিষয়ে খোঁজখবর নিতে গেলে এই প্রতিবেদকের পিছু নেন স্থানীয় এক ব্যক্তি। পরে জানা যায়, শ্যামল চন্দ্র পাল নামে ওই ব্যক্তি বিদ্যালয়ের জায়গায় বসবাসকারী পরিবারের সদস্য।
জানতে চাইলে তিনি উল্লিখিত জায়গাটি তাদের পরিবারের সম্পত্তি দাবি করে বলেন, তাদের কাছে এ সংক্রান্ত দলিল আছে।
তার দাবি, ‘এখানে কোনো সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ছিল না। স্থানীয়দের পড়াশোনা শেখাতে অনেক বছর আগে তাদের বাসার একটি কক্ষে শিক্ষকদের দিয়ে পাঠদানের ব্যবস্থা করেন তার দাদা জগদীশ চন্দ্র পাল। কিন্তু ৭-৮ বছর আগে সেই পাঠদান বন্ধ হয়ে যায়।’ পাঠদান বন্ধের কারণ জানতে চাইলে তিনি কোনো তথ্য দিতে পারেননি।
নথিপত্রে দেখা যায়, রাজধানীর মতিঝিল থানার মাদারটেক সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মোট জমির পরিমাণ ৩১ শতাংশ। হাফিজউদ্দীন মাস্টার নামে এক ব্যক্তি এই জমি দান করেন; কিন্তু স্কুলের ১৯ শতাংশ জমিই এখন বেদখল হয়ে আছে। এর মধ্যে ১৮ শতাংশ জমি দখল করে রেখেছে পার্শ্ববর্তী পুরোনো মাদারটেক মসজিদ ও বাজার কর্তৃপক্ষ। সেখানে ৪-৫টি কক্ষ ভাড়া দেওয়া হয়েছে। আরও ১ শতাংশ জমিতে বসেছে ওয়াসার পাম্প।
স্কুলের শিক্ষকরা জানান, কিছুদিন আগে ওয়াসা পাম্প সংস্কার করায় স্কুলের সীমানা প্রাচীরের কিছু অংশ ভেঙে যায়। সেখানেই বাজার কর্তৃপক্ষ তৈরি করেছে পাবলিক টয়লেট।
কোতোয়ালি থানাধীন হয়বৎনগর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে গিয়ে দেখা গেছে, ঝুঁকিপূর্ণ ভবনে ক্লাস করছে শিক্ষার্থীরা। বিভিন্ন অংশে দেয়ালের পলেস্তারা খসে পড়েছে। যে কোনো সময় ঘটতে পারে দুর্ঘটনা। জরাজীর্ণ পরিবেশে এই বিদ্যালয়ে সন্তানদের ভর্তি করাতে চান না অভিভাবকরা। কমতে কমতে এখন শিক্ষার্থী মাত্র ৭৩ জনে দাঁড়িয়েছে। বিদ্যালয়টির প্রধান শিক্ষক মো. নুর হোসেন কালবেলাকে বলেন, ‘নতুন ভবন নির্মাণের জন্য ২০২০ সালে একবার মাটি পরীক্ষা করা হয়েছিল। এরপর আর কোনো অগ্রগতি নেই।’
শ্যামপুর থানার জুরাইন এলাকায় একই ভবনে জুরাইন আদর্শ বালক সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় এবং জুরাইন আদর্শ বালিকা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পাঠদান চলে। এই ভবনটিও মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ। বিভিন্ন জায়গায় পলেস্তারা খসে রড দেখা যাচ্ছে।
শিক্ষকরা জানিয়েছেন, বাধ্য হয়ে তারা ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থার মধ্যেই ক্লাস নিচ্ছেন। ভবন সংস্কারের উদ্যোগ নেওয়া হলেও উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি নেই।
মিরপুরের চম্পা পারুল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে গিয়ে দেখা যায়, একতলা জরাজীর্ণ ভবনে পাঠদান চলছে। বৃষ্টির সময় ছাদ চুয়ে শ্রেণিকক্ষে পানি পড়ছে। এ কারণে বর্ষাকালে অনেক শিক্ষার্থী স্কুলে আসে না বলে জানান শিক্ষকরা। অথচ পাশেই বিদ্যালয়ের জায়গা দখল করে গড়ে তোলা হয়েছে একটি বহুতল ভবন।
একই থানার খলিলুর রহমান সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ৪০ শতাংশ জায়গাজুড়ে বস্তি গড়ে তোলা হয়েছে। আর ইসলামিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ৫ শতাংশ জায়গায় হাই স্কুল, ওয়াসার পানির পাম্প ও দোকানঘর তৈরি করে দখল করেছেন স্থানীয় প্রভাবশালীরা।
তেজগাঁও থানাধীন বিকে আফতাব সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের জায়গা দখল করে একটি পরিবার বসবাস করছে। স্থানীয়রা জানান, লিটন নামে ওই ব্যক্তি প্রভাবশালীদের পক্ষে স্থানীয় ফকিন্নিবাজার থেকে দৈনিক চাঁদা সংগ্রহ করেন।
কোতোয়ালি থানাধীন ছোট কাটারা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মূল ভবনটি বেশ ঝুঁকিপূর্ণ। ভবনের বিভিন্ন অংশ ভেঙে পড়েছে। এই ভবনের দুটি কক্ষে শিক্ষকরা বসেন আর টিনশেড দুটি কক্ষে শ্রেণি কার্যক্রম চলে। এদিকে, ভবনের দোতলা অবৈধভাবে ব্যবহার করছে শাহ আব্দুল হামিদ কালান্দার বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ।
সরেজমিন দেখা যায়, প্রচণ্ড বৃষ্টিতে টিনশেডের দুটি কক্ষে পানি পড়ছে। সেখানেই চলছে পাঠদান কার্যক্রম। মূল ভবনের সামনে টানানো একটি পোস্টারে চোখ আটকে গেল। সেখানে লেখা রয়েছে, স্কুল পরিচালনার জন্য জেলা প্রশাসন থেকে জায়গা লিজ দেওয়া হয়েছে।
প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা জানান, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭৩ সালে যখন প্রাথমিক বিদ্যালয় সরকারীকরণ করেন, তখন এই বিদ্যালয়ের নামে ১২ শতাংশ জায়গা নামজারি হয়েছিল। কিন্তু কালান্দার স্কুলকে কীভাবে সেই জায়গা লিজ দেওয়া হয়েছে তা তাদের বোধগম্য নয়।
তারা জানান, ভবনের জরাজীর্ণ অবস্থার কারণে ২০১৩ সালের মার্চে স্কুলটি হয়বৎনগর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে স্থানান্তর করা হয়। সাড়ে ৬ বছর পর ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে তারা ফের আগের জায়গায় ফিরে আসেন। কিন্তু এরপর গত চার বছরেও ভবন নির্মাণ হয়নি। সবশেষ গত আগস্টে একবার মাটি পরীক্ষা করা হয়েছে।
সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের জায়গা দখলের বিষয়ে জানতে শাহ আব্দুল হামিদ কালান্দার বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে গিয়ে প্রধান শিক্ষক এস এম আবুল কালাম আজাদকে পাওয়া যায়নি। পরে তার ভিজিটিং কার্ডে থাকা নম্বরে ফোন দেওয়া হলে তিনি রং নম্বর বলে কল কেটে দেন। একই থানায় ওয়াকফ সম্পত্তিতে প্রতিষ্ঠিত এফ কে এম সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের চারতলা ভবনের শুধুমাত্র নিচতলায় প্রাথমিক বিদ্যালয়। দ্বিতীয় থেকে চতুর্থ তলা ব্যবহার করছে বংশাল বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়।
সূত্রাপুরের ওয়ারী মহিলা সমিতি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়টিকে গত বছরের ৬ ডিসেম্বর ঝুঁকিপূর্ণ ও পরিত্যক্ত ঘোষণা করেন এলজিইডির নির্বাহী প্রকৌশলী। কিন্তু এখনো সেই ভবনেই চলছে শ্রেণি কার্যক্রম। ভবনের অর্ধেক অংশের দ্বিতীয় তলায় শিক্ষকরা বসেন। আর নিচতলায় চলে ক্লাস। বাকি একটি অংশের পুরোটাই মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ হওয়ায় সে অংশে কেউ যান না।
শিক্ষকরা জানান, এই বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী মাত্র ৬৮ জন। জরাজীর্ণ অবস্থার কারণে এখানে শিক্ষার্থী ভর্তি হয় কম। মাসতিনেক আগে জমির মাপ নেওয়া হয়। আর নতুন ভবন নির্মাণে চলতি মাসে মাটি পরীক্ষা করা হয়। বিদ্যালয়ের খেলার মাঠে এই ভবন নির্মাণ করার কথা। তবে স্থানীয়দের বাধার কারণে কাজ এগোচ্ছে না। এক কক্ষবিশিষ্ট টিনশেড ভবনের চারপাশের দেয়াল খসে পড়ছে সূত্রাপুর থানার আরেক প্রতিষ্ঠান মুসলিম সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের।
শিক্ষকরা জানান, দুর্বল অবকাঠামো ও জরাজীর্ণ অবস্থার কারণে এই বিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের আকৃষ্ট করতে পারছে না।
বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মোছাম্মত কোহিনূর আক্তার বলেন, গত আগস্টে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র বিদ্যালয়টি পরিদর্শন করে গেছেন। কাউন্সিলররাও ছিলেন। চলতি বছরের মধ্যে একটি ভালো খবর পাবেন বলে তিনি আশা প্রকাশ করেন।
সূত্রাপুর থানার প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা জেসমিন আক্তার বানু বলেন, বিদ্যালয়টির জায়গায় নকশা অনুযায়ী ভবন করা যাচ্ছে না। জায়গা কম থাকায় প্রতি ফ্লোরে একটি করে কক্ষ দিয়ে হলেও কয়েক তলা ভবন নির্মাণ করতে চাচ্ছি।
কয়েক বছর আগে একই থানার ইসলামিয়া ইউপি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের নতুন ভবন নির্মাণের নির্দেশ দিয়েছিলেন তৎকালীন মন্ত্রী মোস্তাফিজুর রহমান ফিজার। পরে সেখানকার পুরোনো জরাজীর্ণ ভবনটি ভেঙে ফেলা হয়। কিন্তু নতুন ভবনের নির্মাণকাজ আর শুরু হয়নি। জমি নিয়ে মামলা চলছে।
সরেজমিন দেখা গেছে, পার্শ্ববর্তী এম এ আলীম সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের চতুর্থ তলার দুটি কক্ষে চলছে ইসলামিয়া ইউপি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের কার্যক্রম। এর মধ্যে একটি কক্ষে চলে ক্লাস আর আরেকটিতে শিক্ষকরা বসেন। এই বিদ্যালয়ের জায়গায় এখন নিয়মিত বসে মাছ, সবজি আর মুরগির বাজার।
এলাকার মানুষের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, কয়েক বছর আগে এখানে বিদ্যালয়ের নাম সংবলিত একটি ব্যানার টানানো হয়েছিল। সেটি এখন আর নেই। জায়গাটি যিনি বিদ্যালয়ের জন্য দান করেছিলেন, তার বংশধররাই এখন দখল করে বাজার বসিয়েছেন। এই জায়গায় বিদ্যালয়ের ভবন নির্মাণের জন্য বিভিন্ন সময় মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তর থেকে কর্মকর্তারা এসেছেন ঠিকই, কিন্তু কোনো উদ্যোগ আলোর মুখ দেখেনি।
এ ছাড়া সূত্রাপুরের এম এ আলীম সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের জায়গায় পাঁচতলা ভবন নির্মাণ করা হয়েছে। ডেমরার ব্রাহ্মণচিরণ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মাঠ দখল করে বসতি স্থাপন করেছে কথিত জমিদাতা।
ঢাকার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোর এ দুর্দশা সম্পর্কে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা বিশেষজ্ঞ কে এম এনামুল হক বলেন, ‘পিইডিপি-৩ ও পিইডিপি-৪-এ অবকাঠামো খাতে বড় বাজেট ছিল। এই কর্মসূচি গ্রামে যতটা বাস্তবায়ন হয়েছে, শহুরে এলাকায় ততটা হয়নি। কিছু ক্ষেত্রে ওয়াসাসহ অন্য সংস্থার কাজে বিদ্যালয়ের জায়গার একাংশ ব্যবহার করা হয়েছে। আবার স্থানীয় প্রভাবশালীরা মিলে স্কুলের জায়গায় কিছু স্থায়ী বা অস্থায়ী বাণিজ্যিক কার্যক্রম চালাচ্ছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে এগুলোর সঙ্গে ব্যবস্থাপনা কমিটির যোগসূত্র পাওয়া যায়। আবার রাজনৈতিক দলের নেতারা যদি এর সঙ্গে যুক্ত হয়, তাহলে কঠিন অবস্থা দাঁড়ায়।’
তিনি বলেন, ‘সরকারের পরিকল্পনা, অর্থায়ন এবং নেতৃত্বের আন্তরিকতা থাকলে এসব সমস্যা দূর করা সম্ভব। এজন্য আন্তঃমন্ত্রণালয় এবং আন্তঃপ্রতিষ্ঠান সমন্বয় জরুরি। কোনো কোনো ক্ষেত্রে আদালত স্বপ্রণোদিত হয়ে রুল জারি করতে পারে এবং জবাবদিহি চাইতে পারে।’ বিদ্যালয়ের জায়গায় পানির পাম্প স্থাপনের বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা ওয়াসার উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালক (ও অ্যান্ড এম) প্রকৌশলী একেএম সহিদ উদ্দিন কালবেলাকে বলেন, ‘জায়গা দেওয়া হয়েছে বলেই সেখানে পাম্প বসানো হয়েছে। যখন এগুলো বসানো হয়, তারা (প্রাথমিক শিক্ষা প্রশাসন) কি চোখ বন্ধ করে ছিল? এখন যদি বলা হয়, বসানো যাবে না। তাহলে তো বিকল্প জায়গা দিতে হবে।’
ঢাকা জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা আজিজ বলেন, ‘বিদ্যালয়গুলোর সংকট নিরসনে বিভিন্ন পর্যায়ে কার্যক্রম চলমান রয়েছে। বেদখল ও জরাজীর্ণ প্রতিষ্ঠানগুলোর বিষয়ে পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের পাশাপাশি জেলা প্রশাসককেও অনুরোধ করা হয়েছে।’ জানা গেছে, দেশে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের অবকাঠামো উন্নয়নে ১ হাজার ১৬০ কোটি টাকার একটি প্রকল্প চলমান রয়েছে। এর বাস্তবায়নকাল ধরা হয়েছে ২০২০ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২৪ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত। প্রকল্পটির অধীন ঢাকার ১৫৪টি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ভবন নতুন করে নির্মাণ এবং ১৭৭টি বিদ্যালয়ের অবকাঠামো উন্নয়ন করে দৃষ্টিনন্দন করা হবে। এর পাশাপাশি ঢাকার উত্তরায় ৩টি এবং পূর্বাচলে ১১টি নতুন বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা হবে।
এই প্রকল্পের পরিচালক ও প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের পরিচালক (পরিকল্পনা ও উন্নয়ন) মোহাম্মদ মিজানুর রহমান বলেন, ‘পিইডিপি-৩ প্রকল্পে জরাজীর্ণ বিদ্যালয় ভবন সংস্কার ও বেদখল জমি উদ্ধারের বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত ছিল। কিন্তু ওই প্রকল্পে ঠিকভাবে কাজ হয়নি। বর্তমানে প্রকল্পের কাজ চলমান রয়েছে। বিদ্যালয়ের ডিজাইন ভেদে আলাদা আলাদা মাস্টারপ্ল্যান করতে হচ্ছে।’
তিনি বলেন, ‘ঢাকাসহ সারা দেশের জরাজীর্ণ প্রাথমিক বিদ্যালয় সংস্কারে আমরা আলাদা একটি প্রকল্প হাতে নেব। আর বেদখলের বেশিরভাগেরই মামলা রয়েছে। সেক্ষেত্রে মামলা নিষ্পত্তি না হলে কিছু করা যাবে না।’ বাংলাদেশ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সভাপতি আবুল কাশেম বলেন, ‘প্রাথমিক শিক্ষা প্রশাসন জরাজীর্ণ ভবন সংস্কার ও বেদখল উচ্ছেদে কার্যক্রম শুরু করলেও এতে ধীরগতি রয়েছে। দখল উচ্ছেদের ক্ষেত্রে স্বরাষ্ট্র ও ভূমি মন্ত্রণালয়ের সমন্বয়ে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। এ ছাড়া জেলা প্রশাসন ও সিটি করপোরেশনের সহায়তাও লাগবে। এলজিইডির কার্যক্রমে গতি আনতে হবে। মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তরকে তাদের কার্যক্রম আরও গতিশীল করতে হবে।’
সার্বিক বিষয়ে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সচিব ফরিদ আহাম্মদ বলেন, ‘প্রকল্পের কাজ পুরোদমে চলছে। এখন পর্যন্ত ৯৭টি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মাস্টারপ্ল্যান অনুমোদন হয়েছে। নতুন করে ১১টি প্রাথমিক বিদ্যালয় পূর্বাচলে এবং তিনটি উত্তরায় হবে। এই ১৪টি বাদে ৩৪২টি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মধ্যে প্রয়োজন অনুযায়ী সংস্কার বা নতুন ভবন নির্মাণ করা হবে। আগামী দুই বছরের মধ্যে ঢাকা শহরের সবগুলো প্রাথমিক বিদ্যালয় দৃষ্টিনন্দন হয়ে যাবে।’
মন্তব্য করুন