আতাউর রহমান
প্রকাশ : ২৫ অক্টোবর ২০২৩, ০৩:১২ এএম
আপডেট : ২৫ অক্টোবর ২০২৩, ১০:২৮ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

উত্তরা ষড়যন্ত্রের আশঙ্কায় নজরদারিতে কর্মকর্তারা

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন
উত্তরা ষড়যন্ত্রের আশঙ্কায় নজরদারিতে কর্মকর্তারা

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে বিএনপির চলমান আন্দোলনে শক্তি জোগাতে কোনো কোনো সরকারি কর্মকর্তার ভূমিকা নজরে রাখছেন গোয়েন্দারা। আন্দোলনের চূড়ান্ত পর্যায়ে এসব আমলা ‘উত্তরা ষড়যন্ত্র’-এর মতো সংগঠিত হতে পারেন বলে তাদের ধারণা। এ কারণে কর্মকর্তাদের কেউ যাতে সরকারের ভেতরকার গুরুত্বপূর্ণ কোনো তথ্য ফাঁস করতে না পারেন, সে বিষয়ে গোয়েন্দা সংস্থাগুলো সতর্ক রয়েছে। সেইসঙ্গে মার্কিন ভিসা নীতি থেকে গা বাঁচাতে কোনো কর্মকর্তা আঁতাত করছেন কি না—তাও পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে।

গোয়েন্দা সূত্রে জানা গেছে, বিরোধী দলের আন্দোলন জোরদার হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কোনো কোনো সরকারি কর্মকর্তাও তৎপর হয়ে উঠতে পারেন। ২০০৬ সালের মতো নিজেদের সংগঠিত করে আন্দোলনে নেপথ্য ভূমিকা রাখতে পারেন তারা। এ ধরনের তৎপরতা ঠেকাতে এবার আগে থেকেই সতর্ক আছে গোয়েন্দা সংস্থাগুলো। সরকারি চাকরিজীবীদের মধ্যে কারা বিরোধীদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছেন বা ভবিষ্যতে যোগাযোগ রাখতে পারেন—সে বিষয়ে নজরদারি শুরু হয়েছে। শুধু দেশে নয়, বিদেশে কারও সঙ্গে যোগাযোগ রয়েছে কি না তাও চিহ্নিত করার চেষ্টা চলছে।

২০০৭ সালে ২২ জানুয়ারির বাতিল হওয়া নির্বাচনের আগে ২০০৬ সালের ২৪ নভেম্বর রাতে রাজধানীর উত্তরায় ‘আর্টিসান সিরামিক’ নামের একটি শিল্প প্রতিষ্ঠানে গোপন বৈঠক করেন বেশ কয়েকজন সরকারি কর্মকর্তা। ওই প্রতিষ্ঠানটির মালিক বন্ধ হয়ে যাওয়া দৈনিক আমার দেশ পত্রিকার সম্পাদক ও সাবেক আমলা মাহমুদুর রহমান। ওই বৈঠকে পুলিশসহ প্রশাসনের বেশ কয়েকজন কর্মকর্তা অংশ নেন। খবর পেয়ে গণমাধ্যমকর্মীরা সেখানে উপস্থিত হলে মুখ ঢেকে দৌড়ে ওই এলাকা ত্যাগ করেন সরকারি কর্মকর্তারা। ওই বৈঠকটিই ‘উত্তরা ষড়যন্ত্র’ নামে পরিচিত।

সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সাধারণত জাতীয় নির্বাচনের আগে সরকারি কর্মকর্তাদের মধ্যে কেউ কেউ ‘ভবিষ্যতের কথা’ চিন্তা করে দুদিকেই যোগাযোগ রক্ষা করে চলেন। এ ছাড়া ভিন্ন আদর্শের অনুসারী হলেও অনেকেই এতদিন চুপ ছিলেন। বিরোধী দলের আন্দোলন জোরদার করতে ভেতরে ভেতরে তৎপর হয়ে উঠতে পারেন তারা। পরিস্থিতি ঘোলাটে করতে সরকারের ভেতরে থেকে কেউ কেউ রাখতে পারেন বিতর্কিত ভূমিকা। মূলত এ ধরনের কর্মকর্তাদের ওপরই নজর রাখছেন গোয়েন্দারা।

সূত্র বলছে, বিশেষ করে প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীসহ বিভিন্ন স্তরের সিদ্ধান্ত গ্রহণকারী পর্যায়ের কর্মকর্তাদের কেউ কেউ এ তালিকায় রয়েছেন। তাদের মনোভাব এবং চলাফেরায় নজরদারি করা হচ্ছে। তারা কোথায় যাচ্ছেন, কোথায় যোগাযোগ করছেন, এক বা দুই বছর আগে সরকারের প্রতি তাদের আনুগত্য কেমন ছিল, বর্তমানে কেমন রয়েছে—এসব বিষয় দেখা হচ্ছে।

দায়িত্বশীল এক গোয়েন্দা কর্মকর্তা কালবেলাকে বলেন, এই নজরদারি একক কোনো সংস্থা করছে না। এক এক প্রতিষ্ঠান অন্য প্রতিষ্ঠানে সন্দেহভাজনদের ওপর নজরদারি করছে। ওই কর্মকর্তা ব্যাখ্যা করে বলেন, তিনি হয়তো সন্দেহভাজন কারও ওপর নজরদারি করছেন, আবার তার দিকেও হয়তো কারও নজরদারি রয়েছে।

প্রশাসন ক্যাডার ও পুলিশ ক্যাডারের বেশ কয়েকজন কর্মকর্তার সঙ্গে কথা হয় কালবেলার। তারা বলছেন, মার্কিন ভিসা নীতির কারণে অনেকের মধ্যে কিছুটা অস্বস্তি রয়েছে। বিশেষ করে যাদের মার্কিন ও কানাডার ভিসা রয়েছে এবং যাদের সন্তানরা সেখানে পড়াশোনা করছেন, এই অস্বস্তিটা তাদের মধ্যে বেশি। এই কর্মকর্তাদের মধ্যে অনেকেই গত কয়েক বছরে সরব থাকলেও মার্কিন ভিসা নীতি প্রয়োগের ঘোষণা আসার পর অনেকটা চুপসে গেছেন। অনেকে নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় থাকতে চাচ্ছেন না। তবে তাদের সংখ্যা হাতেগোনা।

অধিকাংশ কর্মকর্তাই মনে করেন, তারা নিজেদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব পালন করেছেন, ভবিষ্যতেও করবেন। সরকারি দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে যা হওয়ার হবে।

পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) এ কে এম শহীদুল হক কালবেলাকে বলেন, ‘সরকারি দায়িত্ব পালন করা যে কোনো কর্মকর্তা-কর্মচারীর দায়িত্ব। তবে প্রশাসনে রাজনৈতিক আদর্শ ধারণ করা কিছু লোক থাকবেই। নিজেদের আদর্শের পক্ষে তারা কাজ করার চেষ্টা করবেন। তবে সে ধরনের লোক এখনো আছে কি না, জানা নেই।’

সূত্রগুলো বলছে, এরই মধ্যে সরকারি কর্মকর্তাদের মধ্যে কতজনের আমেরিকা ও কানাডার ভিসা রয়েছে, কতজনের সন্তান ওই দুটি দেশে পড়াশোনা করছেন—সেই খোঁজখবর শুরু করেছে একটি গোয়েন্দা সংস্থা। তাদের মধ্যে কেউ ব্যক্তিগতভাবে সুবিধায় থাকার জন্য লিয়াজোঁ করছেন কি না, সেদিকেও নজর রয়েছে গোয়েন্দাদের।

সম্প্রতি ৬৪ জেলার এসপিসহ ঊর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তাদের নিয়ে ক্রাইম কনফারেন্স করে আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন বলেছেন, ভিসা নীতি নিয়ে পুলিশের চিন্তা করার কিছু নেই। এর বাইরে বিভিন্ন সময়েই বিষয়টি নিয়ে মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তাদের অভয় দিয়েছেন ঊধ্বর্তন কর্মকর্তারা।

পুলিশ সূত্র বলছে, নানা কারণেই ঢাকা মহানগর পুলিশসহ বিভিন্ন থানায় অফিসার ইনচার্জ এবং বিভিন্ন ক্রাইম জোন ও জেলাগুলোতে সরকারবিরোধী মনোভাবাপন্ন কর্মকর্তা রয়েছেন। পেশাদার হিসেবে বা রাজনৈতিক রঙ পাল্টে বা অন্য কোনো কারণে তারা ভালো পদায়নও পেয়েছেন। এ ধরনের কর্মকর্তারা এখন সরকারের শেষ সময়ে এসে হয়তো নিশ্চুপ হয়ে যাবেন, কেউ নিরপেক্ষ হয়ে যাবেন। আবার পুলিশি নানা কৌশল ফাঁস করে দিতে পারেন বিরোধী পক্ষের কাছে। এ ধরনের কর্মকর্তাদের বিষয়েও সতর্ক নজরদারি রয়েছে।

পুলিশের এক কর্মকর্তা কালবেলাকে বলেছেন, তারাও চান পুলিশ পেশাদারিত্বের সঙ্গে কাজ করুক। কিন্তু এর বাইরে গিয়ে সরকারকে বিব্রত করতে অনেকে তৎপরতা চালাতে পারে। অনেকে হয়তো অর্পিত দায়িত্ব পালনে অনীহা দেখাতে পারেন। তবে সবসময়ই সবকিছু নজরদারিতে থাকে।

ওই কর্মকর্তা বলেন, পুলিশে খুব কমসংখ্যক কর্মকর্তা রয়েছেন, যাদের সন্তানরা বিদেশে পড়াশোনা করেন। ওই কর্মকর্তাদের মধ্যে নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় থাকবেন, মাঠপর্যায়ে এমন কমান্ডিং অফিসারের সংখ্যাও কম। সুতরাং তাদের ভিসা নীতি নিয়ে চিন্তার কিছু নেই।

একজন গোয়েন্দা কর্মকর্তা জানান, মূলত গত মাসে ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল এমরান আহমেদ ভূঁইয়ার বেফাঁস মন্তব্য এবং মার্কিন দূতাবাসে আশ্রয় নেওয়ার পরই গোয়েন্দারা নড়েচড়ে বসেন। প্রশাসনে তার মতো আরও কেউ রয়েছেন কি না, সে বিষয়ে অনুসন্ধান শুরু হয়। বছরের পর বছর ধরে সরকারের সুবিধা নিয়ে শেষ সময়ে এমরান আহমেদ ভূঁইয়ার মতো কেউ যাতে বিব্রতকর পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে না পারে, সেজন্য নজরদারি চলছে। সরকারের বিভিন্ন দপ্তরের বেশ কয়েকজন কর্মকর্তার দিকে সেই নজরদারি চলছেও।

এ বিষয়ে মন্তব্য চাওয়া হলে সাবেক সচিব ও জনপ্রশাসন বিশেষজ্ঞ আবদুল আউয়াল মজুমদার কালবেলাকে বলেন, ‘সরকারি চাকরি করে কেউ যদি রাজনৈতিক মতাদর্শ বাস্তবায়নে কারও সঙ্গে আঁতাত করে, সেটা শতভাগ অনৈতিক আচরণ এবং বিধিবহির্ভূত কাজ হবে।’

তিনি বলেন, ‘সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সরকারের আদেশ পালন করা কর্তব্য। কে ক্ষমতায় আসবে, কে ক্ষমতায় থেকে যাবে—সেটা জনগণ ঠিক করবে। কর্মকর্তারা শুধু দায়িত্ব পালন করবেন। এর বাইরে অন্য কিছু হলে তা সম্পূর্ণ অনৈতিক।’

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

ছাত্রদলের কমিটিতে নিষিদ্ধ ছাত্রলীগ নেতা ইস্যুতে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া

আ.লীগের কার্যক্রম নিষিদ্ধ সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপন স্পষ্ট করতে সরকারের বিবৃতি

কঠোর গোপনীয়তার মাধ্যমে বিলুপ্ত হলো এনবিআর

পাবজি মোবাইল ন্যাশনাল চ্যাম্পিয়নশিপ জিতে কাজাখস্তান যাচ্ছে বাংলাদেশের A1 Esports

পাকিস্তানের হাইকমিশনারের ঢাকা ত্যাগ নিয়ে নানা গুঞ্জন

সাবেক এমপি মমতাজ গ্রেপ্তার 

আইইবির সাবেক কাউন্সিল সদস্য প্রকৌশলী শফিকুল ইসলাম আর নেই

স্মার্ট কার্ড জটিলতায় টিসিবির খাদ্যপণ্য পাচ্ছে না ১৮ হাজার পরিবার

সফলভাবে সম্পন্ন হলো ‘নিরাপদ পথচারী পারাপারে পাইলট প্রকল্প’

ধর্ষণচেষ্টার অভিযোগ, যুবদল নেতাকে বহিষ্কার

১০

একপাশে অটোরিকশা স্ট্যান্ড, অন্যপাশে ময়লার ভাগাড়

১১

সাংবাদিকদের ওপর হামলার অভিযোগ ঢাবি শিক্ষার্থীর বিরুদ্ধে

১২

আ.লীগের কার্যক্রম বন্ধ করা হয়েছে অন্তর্বর্তী সরকারের মদদেই : এলডিপি মহাসচিব

১৩

যুদ্ধ করল ভারত-পাকিস্তান, পোয়াবারো চীনের

১৪

বগুড়ায় আওয়ামী লীগের দুই নেতা গ্রেপ্তার

১৫

প্রতিপক্ষকে ফাঁসাতে নিজ মেয়েকে হত্যা করলেন বাবা-মা

১৬

তেল কম দেওয়ায় পেট্রল পাম্প সিলগালা করে দিল বিএসটিআই

১৭

জুলাই আন্দোলনে আহত তালিকায় ছাত্রলীগ কর্মী

১৮

পকেট কমিটি বাতিলের দাবিতে বাকেরগঞ্জে বিএনপির নেতাকর্মীদের সড়ক অবরোধ

১৯

রিয়ালকে চারবার হারিয়ে যে রেকর্ড গড়ল বার্সা

২০
X