ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও মাঠের বিরোধী দল বিএনপির পাল্টাপাল্টি মহাসমাবেশ ঘিরে রাজধানীসহ সারা দেশে তৈরি হয়েছে আতঙ্ক। তপশিল ঘোষণার কয়েক সপ্তাহ আগে দুদলের এ মহাসমাবেশ ছড়িয়েছে উত্তাপ। কর্মসূচির নামে ঢাকায় কোনো নৈরাজ্য, অশান্তি ও বিশৃঙ্খলা করলে তা প্রতিরোধ করে দাঁতভাঙা জবাব দিতে প্রস্তুত আওয়ামী লীগ।
আগামীকাল শনিবার ঢাকার নয়াপল্টনে মহাসমাবেশের ঘোষণা দিয়েছে বিএনপি। এজন্য সারা দেশ থেকেই নেতাকর্মীদের ঢাকায় জমায়েত করার বিপুল প্রস্তুতি নিয়েছে দলটি। এরই পরিপ্রেক্ষিতে রাজধানীতে নিজেদের সুদৃঢ় অবস্থান বজায় রাখতে মহাসমাবেশের মাধ্যমে বড় জমায়েতের সর্বাত্মক প্রস্তুতি নিয়েছে আওয়ামী লীগ। একই সঙ্গে সারা দেশেই আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনগুলোকেই প্রস্তুত থাকতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
ওই দিন রাজপথ দখল রাখতে আওয়ামী লীগের পাশাপাশি মাঠে থাকবে যুবলীগ, ছাত্রলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ, কৃষক লীগ, যুব মহিলা লীগ, মহিলা আওয়ামী লীগসহ সব সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীরা। রাজধানীর গুরুত্বপূর্ণ স্থানে থাকবে সতর্ক পাহারা। প্রতিটি পাড়া-মহল্লার মোড়ে এবং গুরুত্বপূর্ণ সড়কে প্যান্ডেল টানিয়ে সকাল থেকে অবস্থান নেবেন নেতাকর্মীরা। দলীয় সংসদ সদস্য ও সিটি করপোরেশনের কাউন্সিলররাও তাদের অনুসারীদের নিয়ে মাঠে থাকবেন। সব মিলিয়ে রাজধানী ঢাকার নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতাসীনদের দখলে রাখতে পরিকল্পনা নিয়েছে আওয়ামী লীগ।
এদিকে, মহাসমাবেশটি জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমের দক্ষিণ ফটকে অনুষ্ঠিত হবে বলে জানিয়েছে আওয়ামী লীগ। যদিও ঢাকা মেট্রো পলিটন পুলিশের (ডিএমপি) পক্ষ থেকে বিকল্প দুটি ভেন্যুর প্রস্তাব দিতে গত বুধবার আওয়ামী লীগকে চিঠি দেয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে, স্বল্পসময়ের মধ্যে অন্য কোনো ভেন্যুতে নতুনভাবে সমাবেশের প্রস্তুতি গ্রহণ করা দুরূহ ব্যাপার উল্লেখ করে আওয়ামী লীগ পূর্বনির্ধারিত জায়গাতেই মহাসমাবেশ করবে বলে পাল্টা চিঠিতে ডিএমপিকে জানিয়েছে।
এ বিষয়ে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, বায়তুল মোকাররমের দক্ষিণ গেট, অনলি ওয়ান ভেন্যু আই ম্যানশন। যেটা বলেছি সেটাই। ২৮ অক্টোবর আমরা শান্তি সমাবেশ করব। তারা আক্রমণ করতে এলে চুপচাপ বসে থাকব না। শান্তি সমাবেশে হামলা হলে আমাদের কর্মীরাও পাল্টা হামলা করবে।
আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারকরা জানান, বিএনপিকে বিশ্বাস করা যায় না। দলটি শান্তিপূর্ণ কর্মসূচির কথা বলে যে কোনো সময় বিশৃঙ্খলা ও জ্বালাও-পোড়াও শুরু করে দিতে পারে। এজন্য সতর্কতাস্বরূপ আওয়ামী লীগ রাজধানীসহ সারা দেশেই সতর্ক থাকবে। অশান্তি ও উচ্ছৃঙ্খলতার কড়া জবাব দিতে প্রস্তুত থাকবে। এজন্য দলটির জেলা, থানা, ওয়ার্ড শাখার নেতাকর্মী, সহযোগী ও ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠনের নেতাকর্মীরা সারা দেশেই প্রতিটি অলিগলিতে পাহারার ব্যবস্থা করেছে। ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের অন্তর্গত সব কাউন্সিলর ও মহিলা কাউন্সিলর নিয়ে বিএনপি-জামায়াতের অপরাজনীতি
জ্বালাও-পোড়াও প্রতিহত করতে গতকাল বিশেষ সভা অনুষ্ঠিত হয়।
আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য জাহাঙ্গীর কবির নানক বলেন, জনপ্রতিনিধি হিসেবে ঢাকা নগরবাসীর জানমালের নিরাপত্তা রক্ষায় আগামী ২৮ তারিখে তীব্র প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। সন্ত্রাসী ও ধ্বাংসাত্মক কর্মকাণ্ড প্রতিরোধের লক্ষ্যে যা যা করণীয় তার সব ব্যবস্থা নিতে হবে, যাতে তারা ঢাকা ছেড়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়।
গতকাল বৃহস্পতিবার বিকেল থেকেই রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় মিছিল, মহড়া, সতর্ক অবস্থানে থেকে আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের পাহারা দিতে দেখা গেছে। স্বেচ্ছাসেবক লীগ রাজধানীতে শান্তি ও উন্নয়নের মিছিল করে। মিছিলটি কাফরুল থেকে শেওড়াপাড়া হয়ে মিরপুর ১০ নম্বর গোলচত্বরে গিয়ে শেষ হয়। এ ছাড়া যুবলীগ টানা ২০ দিনব্যাপী কর্মসূচি ঘোষণা করে। ছাত্রলীগ ও ঢাকা মহানগর
উত্তর-দক্ষিণের বিভিন্ন শাখা ইউনিট শহরে মিছিল সমাবেশ করেছে।
অন্যদিকে দেশের বিভিন্ন বিভাগীয় ও জেলা শহরে সতর্ক থাকতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। একই সঙ্গে ২৮ তারিখে বিভাগীয়, জেলা ও উপজেলার গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় নানাবিধ কর্মসূচি দিয়ে নেতাকর্মীদের মাঠে থাকতে বলা হয়েছে। বিএনপি ঢাকার বাইরের জেলাগুলোতে নৈরাজ্য করলে তা প্রতিরোধ করতে প্রস্তুত থাকতে বলা হয়েছে।
নেত্রকোনা জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শামছুর রহমান লিটন কালবেলাকে বলেন, ২৮ অক্টোবর ঘিরে আমাদের কর্মসূচি রয়েছে। আমরা সতর্ক পাহারায় থাকব সেদিন।
জানা যায়, ২৮ অক্টোবরের মহাসমাবেশের প্রস্তুতিস্বরূপ গত বুধবার ঢাকা মহানগর উত্তর-দক্ষিণ ও ঢাকা জেলা, সহযোগী সংগঠনের কেন্দ্রীয় ও ঢাকা মহানগর
উত্তর-দক্ষিণ, ঢাকা জেলা শাখার সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক এবং নির্বাচিত দলীয় জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে মতবিনিময় সভায় অংশ নেন দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরসহ কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের নেতারা। এর আগের দিন ঢাকা মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগের সঙ্গে বিশেষ বর্ধিত সভা করেন তিনি। এ ছাড়া মহানগর উত্তর-দক্ষিণ আওয়ামী লীগ, সহযোগী সংগঠনগুলো আলাদা আলাদা প্রস্তুতি সভা করেছে। এসব সভা থেকে মহাসমাবেশে আসা নেতাকর্মীদের খালি হাতে না আসারও নির্দেশনা দেওয়া হয়। সবাই যেন আড়াই থেকে তিন হাত লম্বা লাঠি হাতে আসেন, লাঠির মাথায় থাকবে জাতীয় পতাকা।
এ বিষয়ে ঢাকা মহানগর উত্তর আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ বজলুর রহমান কালবেলাকে বলেন, বিএনপি-জামায়াত জোট আবারও নাশকতা করতে পারে—মানুষ এ কারণে শঙ্কিত। শঙ্কার কোনো কারণ নেই, আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা প্রতিটি এলাকায় পাহারায় থাকবেন। মহাসমাবেশে যোগ দেওয়ার আগে যেমন এলাকায় অবস্থান করবে, মিছিল করবে, তেমনি মহাসমাবেশ থেকে ফিরে গিয়েও এলাকায় জনগণের শান্তি ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে।
আওয়ামী লীগ-বিএনপির পাল্টাপাল্টি মহাসমাবেশ ছাড়াও ২৮ অক্টোবর ঘিরে অতীতের ঘটনাও মানুষের স্মৃতিতে ভেসে ওঠায় জনমনে ঘনীভূত হয়েছে শঙ্কা। ২০০৭ সালে নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে সদ্য সাবেক প্রধান বিচারপতি বিএনপি ঘরনার কে এম হাসানকে নিয়োগ প্রদান না করতে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন রাজনৈতিক দলগুলো আন্দোলন করে। এরই ধারাবাহিকতায় ২০০৬ সালের ২৮ অক্টোবর আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ১৪ দলীয় জোট ‘লগি-বৈঠা’ নিয়ে বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ের সমাবেশে হাজির হয়। রাজধানীর পল্টনে চারদলীয় বিএনপি-জামায়াত জোটের নেতাকর্মীদের উসকানিতে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ হয়।
আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম কালবেলাকে বলেন, কোনো ধরনের অরাজক পরিস্থিতি সৃষ্টি করা হলে তার দাঁতভাঙা জবাব দেওয়া হবে। আন্দোলনের নামে কোনো ধরনের অশান্তি ও নৈরাজ্য যেন সৃষ্টি করতে না পারে, সেজন্য তৈরি আছে আওয়ামী লীগ। বিএনপি যে ভাষায় কথা বলে তা রাজনৈতিক নয়, বরং সন্ত্রাসীদের ভাষা। গণতন্ত্রের স্বার্থে যারা দখলদারিত্ব ও জবরদখল করতে চায়, তাদের আমরা কোনো সুযোগ দিতে পারি না। এমনকি জেলা পর্যায়েও যেন কোনো অঘটন না ঘটাতে পারে সেজন্য প্রস্তুত থাকতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।