বন্ড সুবিধায় আমদানি করা পণ্য অবৈধভাবে অপসারণ করেছে সাভার ইপিজেডের চীনা প্রতিষ্ঠান সাউথ চায়না ব্লিচিং অ্যান্ড ডায়িং ফ্যাক্টরি লিমিটেড। প্রতিষ্ঠানটি বন্ডিং মেয়াদে পণ্য রপ্তানি না করে ওয়্যারহাউস থেকে পণ্য অপসারণ করেছে। অবৈধভাবে দুই দফায় এসব অনিয়মের কারণে ডিমান্ড থেকে শুরু করে দাবিনামা জারি করলেও প্রতিষ্ঠানটি আমলে নেয়নি। সর্বশেষ চীনা এ বৃহৎ প্রতিষ্ঠানের অনিয়মের কারণে আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রম বন্ধ করে দিয়েছে ঢাকা বন্ড কমিশনারেট। একই সঙ্গে দুই ধাপে প্রতিষ্ঠানটির কাছে ৮৬৫ কোটি টাকা আদায়ের জন্য বিচারাদেশ করেছেন বন্ড কমিশনার। সর্বশেষ প্রতিষ্ঠানটি মামাবাড়ি আবদার করেছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) আপিলাত ট্রাইব্যুনালের কাছে। কাস্টমস আইনে আপিল করার জন্য নগদ ও ব্যাংক গ্যারান্টি মিলে ন্যূনতম ২০ শতাংশ অর্থ জমা দেওয়ার নিয়ম থাকলেও প্রতিষ্ঠানটি ১ শতাংশ অর্থ জমা দিয়ে আপিল করতে চায় চীনা এ কোম্পানি। এনবিআর সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
সূত্র জানায়, দীর্ঘদিন ধরে সরকারি সর্বোচ্চ সুবিধা ভোগ করে সাভার ইপিজেডে ব্যবসা করছে সাউথ চায়না ব্লিচিং অ্যান্ড ডায়িং ফ্যাক্টরি লিমিটেড। প্রতিষ্ঠানটি বিদেশি প্রতিষ্ঠান হিসেবে সরকারি বন্ড সুবিধা থেকে শুরু করে সব সুবিধা ভোগ করে ব্যবসা করছে। এ সুবিধার অপব্যবহার করে বন্ডেড পণ্য অপসারণ বা বাইরে বিক্রির অভিযোগ ওঠে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে তদন্তে নামে ঢাকা বন্ড কমিশনারেট। আর তদন্তে প্রতিষ্ঠানের অনিয়ম উঠে আসে। প্রতিষ্ঠানটি বিদেশ থেকে বন্ড সুবিধায় আনা কাঁচামাল কোনো ধরনের এন্ট্রি না করে অবৈধভাবে অপসারণ করেছে। নির্ধারিত বন্ডিং মেয়াদেও প্রতিষ্ঠানটি রপ্তানি করেনি। এতে সরকারের রাজস্ব ফাঁকির প্রমাণ পায় বন্ড কমিশনারেটের করা তদন্ত দল।
বন্ড কমিশনারেট সূত্রে জানা গেছে, সাউথ চায়না ব্লিচিং অ্যান্ড ডায়িং ফ্যাক্টরি লিমিটেড ২০১৫ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত মেয়াদে প্রতিষ্ঠানটি ৮২টি বিল অব এন্ট্রির মাধ্যমে আমদানি করা ১ কোটি ২৩ লাখ ১৪ হাজার ৫০০ গজ মেয়াদোত্তীর্ণ গ্রে ফ্রেবিক্স পাওয়া যায়। যার শুল্কায়নযোগ্য মূল্য ছিল ১৬১ কোটি ৯১ লাখ ৩৬ হাজার ৯৭০ টাকা। আর এসব পণ্যের শুল্ক-করের পরিমাণ ছিল ১৪৬ কোটি ৬৫ লাখ ৪৯ হাজার ৫০১ টাকা। আর এসব টাকা আদায়ে বন্ড কমিশনারেটের প্রাথমিক ধাপ হিসেবে দাবিনামা সংবলিত কারণ দর্শানোর নোটিশ পাঠানো হয় সাউথ চায়না ব্লিচিং অ্যান্ড ডায়িং ফ্যাক্টরি লিমিটেডের কাছে। এতে প্রতিষ্ঠানটি বন্ডেড ওয়্যারহাউস লাইসেন্সিং বিধামালার সুস্পষ্ট লঙ্ঘন বলেও উঠে এসেছে বন্ডের প্রতিবেদনে। পরবর্তী সময়ে প্রতিষ্ঠানটিকে শুনানিতে ডাকে ঢাকা বন্ড কমিশনারেট। কমিশনারের কাছে শুনানিতে লিখিত বক্তব্য দেন প্রতিষ্ঠানটির জেনারেল ম্যানেজার। আর শুনানি শেষে বিচারাদেশ দেন ঢাকা বন্ডের তৎকালীন কমিশনার মো. শওকাত হোসেন। আর এই বিচারাদেশে প্রতিষ্ঠানটিকে দি কাস্টমস অ্যাক্ট-১৯৬৯-এর সেকশন, ৩২, ৯৫, ৯৭, ৯৬ ও ১১৪ এবং লাইসেন্সিং বিধামালা লঙ্ঘন হওয়ায় একই আইনের সেকশন ১৩ (৩) ও সেকশন ১৫৬-এর সাব সেকশন ১-এর ক্লজ ১, ১৪, ও ৯০ অনুযায়ী দণ্ডযোগ্যে। আইনের এসব ধারায় কোম্পানিটিকে শুল্ক করাদি বাবত ১৪৬ কোটি টাকা এবং ১৫ কোটি টাকা অর্থদণ্ড আরোপ করে আদেশ করা হয়।
বন্ডের অনিয়মের বিষয়ে সাউথ চায়না ব্লিচিং অ্যান্ড ডায়িং ফ্যাক্টরির জেনারেল ম্যানেজার মির্জা গোলাম সাত্তার বন্ডিং মেয়াদের মধ্যে রপ্তানি করতে না পারা অনিয়ম হলেও রাজস্ব ফাঁকি হয়নি বলে দাবি করেন। তিনি বলেন, যথা সময়ে ইন বন্ড এবং এক্স বন্ড রেজিস্টারে এন্ট্রি করা অনিয়ম হিসেবে মানলেও শুল্ক ফাঁকি মানতে নারাজ চীনা কোম্পানির এ কর্মকর্তা। তার দাবি, রপ্তানি হয়েছে এবং রপ্তানির অর্থ দেশে প্রত্যাবাসিত হয়েছে।
সূত্র আরও জানায়, সাউথ চায়না ব্লিচিং অ্যান্ড ডায়িং ফ্যাক্টরির শুধু এ অনিয়মই করেনি। ২০১৫ সালের এক নিরীক্ষা প্রতিবেদনে উঠে আসে আরও ভয়াবহ অনিয়ম। কোম্পানিটি একইভাবে বন্ডিং মেয়াদে রপ্তানি না করে পণ্য অপসারণ করেছে। সেই সময় কোম্পানিটি একইভাবে কাস্টমস আইন এবং বন্ডেড ওয়্যারহাউসের লাইসেন্সিং বিধিামালাকে উপেক্ষা করে বন্ডের অপব্যবহার করে। আর এ অপব্যবহারের অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে বন্ড কমিশনারেট থেকে একটি নিরীক্ষা করা হয়। এই নিরীক্ষা প্রতিবেদনে ৭১৯ কোটি টাকার অনিয়মের চিত্র উঠে আসে। সেই সময়ে প্রতিষ্ঠানটির এক্সপি থেকে শুরু করে আমদানি-রপ্তানির যাবতীয় তথ্য পর্যালোচনা করে কোম্পানির বিরুদ্ধে অনিয়মের প্রমাণ পায়। একই নিয়মে বন্ড সুবিধার অপব্যবহার করে প্রতিষ্ঠানটি। তৎকালীন বন্ডের কমিশনার ৭১৯ কোটি টাকা আদায়ের নির্দেশ দেন। আর এ আদেশটি জারি হয় ২০১৭ সালে। পরবর্তী সময়ে ২০২১ সালে এসেও একই অপকৌশল করে বন্ডেড সুবিধার অপব্যবহার করে প্রতিষ্ঠানটি। অনিয়ম করেই শেষ নয়, এবার আইনে আপিলের জামানত বাধ্যতামূলক হলেও নানা অজুহাতে এ অর্থ জমা দান থেকেও অব্যাহতি চেয়েছে প্রতিষ্ঠানটি।
এনবিআর সূত্রে জানা গেছে, চলতি মাসের শেষ সপ্তাহে সাউথ চায়না ব্লিচিং অ্যান্ড ডায়িং ফ্যাক্টরি লিমিটেডের গ্রুপ সিইও চ্যান চি ওয়াই আপিলের শর্ত হিসেবে সরকারি কোষাগারে ন্যূনতম ২০ শতাংশের পরিবর্তে ১ শতাংশ অর্থ জমা দিয়ে আপিল করার আবেদন করেছেন কাস্টমস, এক্সাইজ ও ভ্যাট আপিলাত ট্রাইব্যুনালের প্রেসিডেন্ট বরাবর। কোম্পানির আবেদনে আরও বলা হয়েছে, সাউথ চায়না ব্লিচিং অ্যান্ড ডায়িং ফ্যাক্টরিসহ পাঁচটি প্রতিষ্ঠান সাভার ইপিজেডে সুনামের সঙ্গে ব্যবসা করে আসছে। বন্ডিং মেয়াদোত্তীর্ণ হলেও প্রতিষ্ঠানটি রপ্তানি করেছে এবং অর্থ দেশে প্রত্যাবাসিত হয়েছে। আর কোম্পানির আর্থিক দুরবস্থার কারণে প্রতিষ্ঠানটি আপিলের শর্ত হিসেবে নগদ এবং ব্যাংক গ্যারান্টি জমা দিতে পারবে না। তাই প্রতিষ্ঠানটিকে দাবিনামা ১ শতাংশ অর্থ জমাদান সাপেক্ষে আপিল করার সুযোগ দেওয়ার আবেদন করেছে প্রতিষ্ঠানটি।
এ বিষয়ে আপিলাত ট্রাইব্যুনালের প্রেসিডেন্ট হুমায়ুন কবীরের সঙ্গে বারবার যোগাযোগ করে তার কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি। সর্বশেষ তার মোবাইল ফোনে খুদেবার্তা পাঠিয়েও এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য জানা যায়নি।