বিএনপির সঙ্গে যুগপৎ আন্দোলনের মিত্ররাও দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন বর্জন করেছিল। আসন্ন উপজেলা পরিষদ নির্বাচনেও দলীয়ভাবে অংশ না নেওয়ার নীতিগত সিদ্ধান্ত রয়েছে বিএনপির। এ কারণে এখানেও প্রধান শরিককে অনুসরণ করবে বিএনপির মিত্ররা। যুগপতের নেতারা মনে করছেন, যেসব কারণে তারা ৭ জানুয়ারির জাতীয় নির্বাচন বর্জন করেছিলেন, তার সব কারণই এখনো বিদ্যমান। বিএনপির মতো যুগপতের শরিকদেরও দাবি, দেশের গোটা নির্বাচনী ব্যবস্থার প্রতি মানুষের কোনো আস্থা নেই। নির্বাচনকে প্রহসনে পরিণত করা হয়েছে।
এবার চার ধাপে ষষ্ঠ উপজেলা পরিষদ ভোট করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে নির্বাচন কমিশন, যার প্রথমটি হবে আগামী ৪ মে। ক্ষমতাসীন দলের পক্ষ থেকে ইতোমধ্যে এ নির্বাচন দলীয় প্রতীকে না হওয়ার কথা জানানো হয়েছে। তবে আওয়ামী লীগ সরকার ও বর্তমান নির্বাচন কমিশনের অধীনে জাতীয় ও স্থানীয় সরকারের কোনো নির্বাচনে না যাওয়ার নীতিগত সিদ্ধান্ত রয়েছে বিএনপির। এর অংশ হিসেবে দুই বছর ধরে জাতীয় সংসদসহ সব ধরনের নির্বাচন বর্জন করেছে দলটি। অবশ্য বিএনপির আন্দোলন ও বর্জনের মধ্যে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের পর এখন নতুন রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট তৈরি হয়েছে বলে অনেকে মনে করছেন। কারণ, বিএনপির বছরের অধিক সময় ধরে চলা রাজপথের আন্দোলনে চূড়ান্ত সফলতা না আসায় দলটির নেতাকর্মীদের মধ্যে এক ধরনের হতাশা বিরাজ করছে। একই সঙ্গে ঝিমিয়ে পড়েছে সারা দেশের সংগঠন। এমন অবস্থায় নির্বাচনে না যাওয়ার সিদ্ধান্ত পরিবর্তনের সময় এসেছে বলে মনে করছেন দলের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাকর্মীরা। সংগত কারণে আসন্ন উপজেলা নির্বাচনে অংশগ্রহণের বিষয়ে দুই ধরনের মত তৈরি হয়েছে বিএনপিতে।
দীর্ঘদিন ক্ষমতার বাইরে থাকা বিএনপির একপক্ষ মনে করছে, উপজেলা নির্বাচনে যাওয়ার কৌশল খোঁজা উচিত। তৃণমূলের এই অংশ মনে করে, নির্বাচনে গেলে বিএনপির রাজনীতিতে চাঙ্গাভাব ফিরে আসবে। নির্বাচনে যাওয়ার এই সুযোগ হাতছাড়া করা ঠিক হবে না। এর মাধ্যমে বিএনপি স্বাভাবিক রাজনীতিতে ফিরতে পারবে। কারণ, আন্দোলন ব্যর্থতায় বিএনপির তৃণমূল এখন খুবই বিপর্যস্ত। এমন অবস্থায় শুধু সরকারবিরোধী কর্মসূচি দিয়ে তাদের মনোবল চাঙ্গা করা যাবে না। কারচুপি হলেও নির্বাচন সব সময় উৎসবের আবহ তৈরি করে। বিএনপি উপজেলা নির্বাচন প্রক্রিয়ায় যুক্ত হলে হাজার হাজার নেতাকর্মী সক্রিয় হওয়ার সুযোগ পাবেন। তাদের দাবি, বিএনপি নির্বাচনমুখী দল হওয়ায় স্থানীয় সরকারের এই নির্বাচনে অংশ না নিলে মাঠপর্যায়ে জনপ্রতিনিধিত্বশীল নেতাদের ধরে রাখা কঠিন হয়ে পড়বে। সেক্ষেত্রে দলীয় সিদ্ধান্ত অমান্য করে অনেকে নির্বাচন করতে পারেন। দলটির অন্য পক্ষের দাবি, বিএনপি ঘোষণা দিয়ে উপজেলা নির্বাচনে অংশ নিলে বিরোধীদের কাছ থেকে সরকারের ‘বৈধতা’ পাওয়ার বিষয়টি সামনে চলে আসবে। এতে মনে হতে পারে, বিএনপি সরকারকে মেনে নিয়েছে। এর সুযোগ নেবে সরকার।
এমন প্রেক্ষাপটে আসন্ন উপজেলা পরিষদ নির্বাচনের ব্যাপারে বিএনপির নীতিনির্ধারণী নেতারা এখনো দোলাচলে রয়েছেন। নির্বাচনের পর স্থায়ী কমিটির দু-একটি বৈঠকে এ বিষয়ে অল্পবিস্তর আলোচনা হলেও চূড়ান্ত কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। তবে বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে সংগঠনকে চাঙ্গা করতে এক্ষেত্রে কৌশলী ভূমিকা নিতে পারে দলটি। দলীয়ভাবে অংশগ্রহণের ঘোষণা না দিলেও দলের কেউ স্বতন্ত্র প্রার্থী হলে তাদের ক্ষেত্রে নমনীয়তা দেখানো হতে পারে বলে জানা গেছে। যদিও এ বিষয়ে এখন পর্যন্ত বিএনপি দলীয়ভাবে কোনো সিদ্ধান্ত নেয়নি।
জানা গেছে, বিএনপির মিত্ররাও উপজেলা নির্বাচনে না যাওয়ার নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তবে তারা এ বিষয়ে বিএনপির চূড়ান্ত সিদ্ধান্তের দিকে তাকিয়ে রয়েছেন। নির্বাচনের পর অনুষ্ঠিত বৈঠকে এ ব্যাপারে বিএনপির সঙ্গে তাদের প্রাথমিক আলোচনা হলেও এখনো চূড়ান্ত আলোচনা হয়নি। তবে বিএনপি কোনো কারণে শেষ মুহূর্তে নির্বাচনে অংশগ্রহণের সিদ্ধান্ত নিলে যুগপতের শরিকরাও তাদের অনুসরণ করতে পারে বলে অনেকে জানিয়েছেন।
যুগপৎ আন্দোলনের শরিক গণতন্ত্র মঞ্চের অন্যতম শীর্ষ নেতা ও বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক কালবেলাকে বলেন, দেশের গোটা নির্বাচনী ব্যবস্থার প্রতি মানুষের কোনো আস্থা নেই। সরকারের প্রবল আধিপত্যের মধ্যে রাজনৈতিক দলগুলো নির্বাচনে অংশ নিলে মানুষ নির্বিঘ্নে ভোট দিতে পারবে—এমন কোনো সুযোগ আছে বলে এখনো মনে করছি না। ফলে বিএনপিসহ বিরোধী দলগুলো আসন্ন উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে অংশ নেবে না বলে ধারণা পাচ্ছি। গণতন্ত্র মঞ্চ জোটগতভাবে এবং মঞ্চের দলগুলোও দলীয়ভাবে নির্বাচনে যাবে না। তবে কেউ স্বতন্ত্রভাবে নির্বাচন করলে তাদের ব্যাপারে জোটের অবস্থান কী হবে, সে ব্যাপারে এখনো চূড়ান্ত কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি।
১২ দলীয় জোটের প্রধান ও জাতীয় পার্টির (কাজী জাফর) চেয়ারম্যান মোস্তফা জামাল হায়দার বলেন, দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন আমরা বর্জন করেছি। যে যে কারণে ওই নির্বাচন বর্জন করেছিলাম, তার সবই বিদ্যমান। আওয়ামী লীগ সরকার ও বর্তমান নির্বাচন কমিশনের অধীনে কখনো অবাধ, সুষ্ঠু নির্বাচন হবে না। তাদের অধীনে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করলে জনগণের রায়ের প্রতিফলন যেমন ঘটবে না, তেমনি সঠিক ফলও পাওয়া যাবে না। সুতরাং আসন্ন উপজেলা নির্বাচনে যাওয়া অর্থহীন, সেটা দলীয় প্রতীকে কিংবা প্রতীক ছাড়া যেভাবেই হোক।
জাতীয়তাবাদী সমমনা জোটের সমন্বয়ক ও এনপিপির চেয়ারম্যান ড. ফরিদুজ্জামান ফরহাদ বলেন, আওয়ামী লীগ সরকার এবং বর্তমান নির্বাচন কমিশনের অধীনে ইউনিয়ন পরিষদ থেকে জাতীয় কোনো নির্বাচনই সুষ্ঠু হবে না। বিএনপি ও জাতীয়তাবাদী সমমনা জোটসহ গণতন্ত্রমনা জোট ও দলগুলো গণতন্ত্র ও মানুষের ভোটাধিকার ফেরানোর জন্য আন্দোলন করছে। এমন অবস্থায় উপজেলা নির্বাচনে যাওয়া উচিত হবে না।
গণতান্ত্রিক বাম ঐক্যের সমন্বয়ক ও সোশ্যাল ডেমোক্রেটিক পার্টির (এসডিপি) আহ্বায়ক আবুল কালাম আজাদ বলেন, ২০০৮ সালের পর থেকে অনুষ্ঠিত ইউনিয়ন পরিষদ থেকে জাতীয় নির্বাচন পর্যন্ত সব জায়গায় নামেমাত্র নির্বাচন হয়েছে। আওয়ামী লীগ সরকার ও বর্তমান নির্বাচন কমিশনের অধীনে এমন নির্বাচনে অংশগ্রহণ করা অর্থহীন।
বিএনপির নেতৃত্বাধীন যুগপৎ আন্দোলনের বাইরে থাকলেও বাম গণতান্ত্রিক জোটও বিগত জাতীয় নির্বাচন বর্জন করেছে। এই জোটের কেন্দ্রীয় সমন্বয়ক ও বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স কালবেলাকে বলেন, দেশে নির্বাচনের পরিবেশ নেই। সেজন্য জোট ও দলগতভাবে উপজেলা নির্বাচনে অংশ নেওয়ার কথা ভাবা হচ্ছে না। তিনি আরও বলেন, নির্বাচনকে দিন দিন আরও জটিল করে ফেলা হচ্ছে। কীভাবে জামানতের টাকা বাড়িয়ে দেওয়া হলো? একদিকে নির্বাচন প্রহসনে পরিণত হয়েছে, অন্যদিকে তা অর্থবিত্তের মালিকদের খেলায় পরিণত হয়েছে।