হুমায়ূন কবির
প্রকাশ : ০৫ অক্টোবর ২০২৫, ১২:০০ এএম
আপডেট : ০৫ অক্টোবর ২০২৫, ০৭:২৫ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

ফ্লোটিলার ঢেউ আছড়ে পড়ছে সারা বিশ্বে

ফ্লোটিলার ঢেউ আছড়ে পড়ছে সারা বিশ্বে

গ্লোবাল সুমুদ ফ্লোটিলা যখন যাত্রা করেছিল, তখন নৌবহর গাজায় উপকূলে পৌঁছবে কি না; তার থেকে একটি বড় বিষয় আলোচিত হয়—এর বিশ্ববার্তা নিয়ে। এর মাধ্যমে তারা জানান দেয়—গাজা একা নয়। শত শত নারী-পুরুষ অবরুদ্ধ জনগণের পাশে দাঁড়ানোর জন্য বিশ্বের সবচেয়ে বেপরোয়া ও আক্রমণাত্মক সামরিক দখলদারত্বের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তার, নির্বাসন ও সংঘর্ষের ঝুঁকি নিতে ইচ্ছুক। তাদের লক্ষ্য, প্রতীকীভাবে ত্রাণসামগ্রী গাজা উপত্যকায় পৌঁছানোর মাধ্যমে আগ্রাসী ইসরায়েলের সর্বাত্মক অবরোধ ভাঙা। পাশাপাশি মানবসৃষ্ট দুর্ভিক্ষে যখন গাজাবাসী অনাহারে অসার হচ্ছেন, শিশুরা ধুঁকে ধুঁকে মরছে; তার মধ্যে ‘গণহত্যার লাইভ স্ট্রিমিং’ চলছে—এরপরও চুপ থাকা বিশ্ববিবেককে জাগিয়ে তোলা। সব বাধা আর হামলা পেরিয়ে নৌযানগুলো যখন ভূমধ্যসাগরে, তখন তাতে হামলে পড়ে দখলদার ইসরায়েলের সেনারা। আটক করা হয় অধিকারকর্মীদের। এতে ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে লোকালয় থেকে লোকালয়ে। ফ্লোটিলায় ভূমধ্যসাগরের সেই ঢেউ আছড়ে পড়ে ইউরোপ থেকে এশিয়া, অস্ট্রেলিয়া থেকে আমেরিকা; উত্তাল হয় গোটা বিশ্ব। এবারের গাজাঅভিমুখী গ্লোবাল সুমুদ ফ্লোটিয়া নিয়ে বিস্তারিত লিখেছেন হুমায়ূন কবির

গ্লোবাল সুমুদ ফ্লোটিলার বহর ১ সেপ্টেম্বর প্রথম প্রহরে স্পেনের বার্সেলোনা থেকে যাত্রা করে। এরপর ধীরে ধীরে এগোতে থাকে। এরপর ১৩ থেকে ১৫ সেপ্টেম্বর তিউনিসিয়া ও ইতালির সিসিলি দ্বীপ থেকে আরও নৌযান এ বহরে যুক্ত হয়। এ ছাড়া গ্রিসের সাইরাস দ্বীপ থেকে পরবর্তী সময়ে আরও কিছু নৌযান ত্রাণ নিয়ে বহরে যুক্ত হয়। বর্তমানে বহরটিতে ৪৪টি নৌযানের ৪০টি আটকে দিয়েছে ইসরায়েল।

শুরুতে এ নৌবহরে ৫০টির বেশি জাহাজ ও অন্তত ৪৪টি দেশের প্রতিনিধিত্বকারী শত শত আন্তর্জাতিক স্বেচ্ছাসেবক, কর্মী ও আইনপ্রণেতা ছিলেন। আয়োজকদের মতে, তাদের মধ্যে ২৪ জন মার্কিন নাগরিকসহ কয়েকজন সামরিক অভিজ্ঞ ব্যক্তিও আছেন। নৌযানগুলোয় প্রতীকী হলেও উল্লেখযোগ্য পরিমাণ মানবিক কার্গোয় খাদ্য, চিকিৎসাসামগ্রী ও গাজার জনগণের জন্য অন্যান্য প্রয়োজনীয় দ্রব্য ছিল।

সে সময়ে ফ্লোটিলায় থাকা অধিকারকর্মীরা সমুদ্রে কয়েকটি বৈরী ঘটনার বর্ণনাও দিয়েছেন। এর মধ্যে মাল্টা ও ক্রিটের কাছে সন্দেহভাজন ড্রোন হামলার ঘটনাও ছিল। এতে কিছু নৌযান ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং পিছু হটতে বাধ্য হয়। যখন ফ্লোটিলা পূর্ব ভূমধ্যসাগরের কাছে পৌঁছায়, তখন বহরে ৪৪টি জাহাজ ছিল। এরপরও ফ্লোটিলা অগ্রসর হতে থাকলে আন্তর্জাতিক মনোযোগ বেড়ে যায় যখন। এর অগ্রগতি পর্যবেক্ষণ ও প্রয়োজনে সহায়তা দেওয়ার জন্য স্পেন ও ইতালি নৌবাহিনীর জাহাজ মোতায়েন করে। অন্যদিকে ইউরোপসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশ সব পক্ষকে সংযত থাকার আহ্বান জানায়।

এরপর ২ অক্টোবর ভূমধ্যসাগরে ফ্লোটিলার ৩৯টি নৌযানে হামলে পড়ে ইসরায়েলি সেনারা। সেখান থেকে ৪৪৩ কর্মীকে আটক করেছে তারা। পরদিন আরেকটি নৌযান আটক করা হয়। তাদের মধ্যে কয়েকজনকে নিজ দেশে পাঠানো হয়েছে।

গন্তব্যে না পৌঁছালেও ফ্লোটিলা বিশ্বজুড়ে আলোড়ন তৈরি করেছে, নাড়া দিয়েছে বিশ্ববিবেককেও।

মানবিক এই উদ্যোগ আটকে দেওয়ায় বৃহস্পতি ও শুক্রবার ফ্রান্স, গ্রিস, ইতালি, জার্মানি, তিউনিসিয়া ও তুরস্কে ব্যাপক বিক্ষোভ হয়েছে। পাকিস্তান, বলিভিয়া ও মালয়েশিয়া থেকেও ইসরায়েলি কর্মকাণ্ডের সমালোচনা উঠেছে। ইতালিতে কয়েকটি শহরে বিক্ষোভ সমাবেশ হয়।

স্পেনের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর বার্সেলোনার পৌর পুলিশ জানিয়েছে, হাজারো মানুষ রাস্তায় নেমে ইসরায়েলের এ পদক্ষেপের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ করেছেন। তারা স্লোগান দেন—‘গাজা, তুমি একা নও’; ‘ইসরায়েলকে বর্জন করো’ এবং ‘ফিলিস্তিনের স্বাধীনতা চাই’। সুমুদ ফ্লোটিলায় থাকা একটি নৌযানে বার্সেলোনার সাবেক মেয়র আডা কোলাউ ছিলেন। তার পাশাপাশি ছিলেন নেলসন ম্যান্ডেলার নাতি ম্যান্ডলা ম্যান্ডেলাও। তাদের সবাইকে ইসরায়েল থেকে বহিষ্কার (ডিপোর্ট) হওয়ার মুখে পড়তে হচ্ছে। একই ঘটনায় আইরিশ পার্লামেন্টের বাইরে ডাবলিনে কয়েকশ মানুষ মিছিল করেন। সেখানে ফিলিস্তিনিদের প্রতি সমর্থনকে প্রায়ই ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে আয়ারল্যান্ডের দীর্ঘ সংগ্রামের সঙ্গে তুলনা করা হয়। এএফপির সংবাদদাতাদের তথ্যমতে, বার্লিন, হেগ, তিউনিস, ব্রাসিলিয়া এবং বুয়েন্স আয়ার্সেও বিক্ষোভ হয়েছে। ইতালিতে দেশটির প্রধান শ্রমিক ইউনিয়নগুলো নৌবহরের সঙ্গে সংহতি জানাতে শুক্রবার সাধারণ ধর্মঘট করে।

জাতিসংঘ জানিয়েছে, আটক কর্মীদের যেন কোনো ক্ষতি না হয়, সেটাই প্রধান অগ্রাধিকার। মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেসের ডেপুটি মুখপাত্র ফারহান হক বলেন, আমরা আশা করি তাদের সঙ্গে ন্যায়সংগত আচরণ এবং তাদের অধিকার ও মর্যাদা রক্ষা করা হবে। গাজার মানুষের জন্য মানবিক সহায়তা পৌঁছানো বাধাগ্রস্ত হওয়া উচিত নয় বলেও উল্লেখ করেন তিনি।

জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনার ভলকার তুর্ক ইসরায়েলকে জরুরিভাবে গাজার অবরোধ তুলে নিয়ে জীবন রক্ষাকারী উপকরণ প্রবেশের অনুমতি দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। যুক্তরাজ্যের পররাষ্ট্র দপ্তর জানিয়েছে, তারা নৌকায় থাকা ব্রিটিশ নাগরিকদের পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করছে। সংকট সমাধানের আশায় তারা ইসরায়েলি কর্তৃপক্ষের সঙ্গেও যোগাযোগ রাখছে।

এ ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় কলম্বিয়ার প্রেসিডেন্ট গুস্তাভো পেত্রো দেশটি থেকে সব ইসরায়েলি কূটনীতিককে বহিষ্কার করেছেন এবং নেতানিয়াহুর বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধের অভিযোগ তুলেছেন। দেশটি ইসরায়েলের সঙ্গে করা মুক্ত বাণিজ্য চুক্তিও বাতিল করেছে।

ইসরায়েল জানিয়েছে, নৌবহরের কর্মীদের ইউরোপে নির্বাসিত করা হবে। আটকের আগে থুনবার্গ এক ভিডিওতে জানান, ইসরায়েলি বাহিনী আমাকে অপহরণ করেছে এবং আমার ইচ্ছার বিরুদ্ধে নিয়ে গেছে।

ভূমধ্যসাগরে এই ফ্লোটিলা যাত্রা ছিল আন্তর্জাতিক আন্দোলনের ক্ষেত্রে সংহতি প্রকাশের নতুন এক অধ্যায়ের সূচনা। আরব বা বিদেশি ব্যক্তিদের মধ্যে যে কেউ জাহাজেই থাকুক না কেন, সেই জাহাজের প্রত্যেক কর্মী তাদের সঙ্গে এমন এক দৃঢ়সংকল্প লালন করেছিলেন, যা সীমানা ছাড়িয়ে বহুদূর এগিয়ে গেছে। যদিও ইসরায়েল জাহাজগুলো অবরুদ্ধ করতে সফল হতে পারে, তবে এই কর্মীরা যখন দেশে ফিরে আসবেন. তখন তাদের এই কণ্ঠস্বর আরও জোরে প্রতিধ্বনিত হবে, তা থামানোর মতো তাদের কোনো পদক্ষেপই কাজ করবে না।

ফ্লোটিলা অন্য প্রচারকদের তুলনায় কেন আলাদা? তারা কেবল গাজা হত্যাযজ্ঞের বিরুদ্ধেই সমর্থন জানাচ্ছেন না, বরং তারা ইসরায়েলবিরোধী অবস্থান নিতে নিজেরাই এখন সাক্ষী, তা ছাড়া নৌবহরে অংশগ্রহণকারী অন্য প্রচারকদের থেকে আলাদা হওয়ার কারণ, জীবিত অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হওয়া। তারা আর রিপোর্ট বা পরিসংখ্যান দেখে বসে থাকার পক্ষে নয়; নিজেরাই ঘটনার সাক্ষী হতে এগিয়ে গেছেন। ইসরায়েলি অবরোধকারী সেনাদের তৎপরতার প্রত্যক্ষদর্শী তারা। একটি শান্তিপূর্ণ অভিযান থামিয়ে দিতে তারা আন্তর্জাতিক জলসীমায় ইসরায়েলি দখলদারদের হস্তক্ষেপ পৌঁছে যাওয়ার অভিজ্ঞতা অর্জন করেছেন। এই চাক্ষুষ ব্যক্তিগত সাক্ষ্য উড়িয়ে দেওয়া অসম্ভব। এরই মধ্য দিয়ে তারা এসব কর্মীকে নিজেদের সম্প্রদায়, জনগোষ্ঠী, সংসদ, বিশ্ববিদ্যালয় ও সংবাদমাধ্যমে কথা বলার জন্য অতুলনীয় স্বীকৃতি ও কর্তৃত্ব চর্চার অনুমোদন দেয়। তাদের এ বহরের প্রভাব হবে বহুমুখী। বাড়ি ফিরে আসার পর এই কর্মীরা কেবল বন্ধুই নন; বরং তারা এই পরিচয় ছাপিয়ে গল্পেরই অংশ হয়ে ওঠে। তাদের গ্রেপ্তার, তাদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার অথবা নির্বাসন একটি জীবন্ত আখ্যান হয়ে ওঠে, যা ফিলিস্তিনের দুর্দশা থেকে দূরে থাকা দর্শকদের মধ্যে জাগরণ সৃষ্টি এবং তাদের একত্র করতে ভূমিকা রাখতে পারে। স্থানীয় রেডিও অনুষ্ঠান থেকে শুরু করে জাতীয় সংসদ পর্যন্ত তারা যেসব প্ল্যাটফর্মে কথা বলে, তা গাজার কণ্ঠস্বরের বিস্তৃত পরিসরে রূপ নেয়। এভাবে একটি একক নৌবহর মহাদেশজুড়ে হাজার হাজার কথোপকথনে ঢেউ তুলতে পারে।

সুমুদের নৌবহর গাজায় পৌঁছেছিল কি না, এখন আর এই প্রশ্ন প্রাসঙ্গিক নয়। এই প্রক্রিয়া নৌবহরকে কেবল একটি মানবিক মিশন হিসেবে প্রচারিত করে না, বরং একটি রাজনৈতিক ও নৈতিক প্রকাশ বলে পুনর্বিবেচনা করে, যা ফিলিস্তিনি অধিকারের পক্ষে বিশ্বব্যাপী সমর্থন বিস্তৃত করে।

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

পাখি শিকারে নিষেধ করায় যুবককে গুলি

তাহলে কি তৃতীয় বারের মতো সংসার ভাঙছে শোয়েব মালিকের?

অষ্টম শ্রেণি পাসেই নিজ এলাকায় কাজের সুযোগ দিচ্ছে আবুল খায়ের গ্রুপ

হঠাৎ ঝড়ে লন্ডভন্ড শতাধিক ঘরবাড়ি

গাজায় কখন যুদ্ধ শেষ হবে, ট্রাম্প কী বলছেন

‘কোথায় বা কখন আটকানো হতে পারে, তা বলা কঠিন’

শ্বশুরবাড়িতে যুবককে গলা কেটে হত্যাচেষ্টা, ভুক্তভোগীর মামলা

বেনামাজি ব্যক্তিকে সাক্ষী রাখলে বিয়ে বৈধ হবে কি?

বুলবুলের চিঠি বৈধ, বিসিবির নির্বাচন হতে বাধা নেই

দক্ষিণ কোরিয়ার বিরুদ্ধে ‘বিশেষ অস্ত্র’ মোতায়েন উত্তর কোরিয়ার

১০

সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্টের ষড়যন্ত্র নস্যাৎ করেছে সরকার : স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা

১১

কনমেবল ইভল্যুশন লিগ / অতিরিক্ত সময়ে নাটকীয় গোল, আর্জেন্টিনার বিপক্ষে ফাইনালে ব্রাজিল

১২

শিগগির দল হিসেবে আ.লীগের বিচারের বিষয়ে আনুষ্ঠানিক তদন্ত শুরু হবে

১৩

তিন নদীতে বাড়তে পারে পানি, চার জেলায় বন্যার পূর্বাভাস

১৪

দুদকের মামলায় খালাস পেলেন বিএনপি নেতা গয়েশ্বর চন্দ্র

১৫

ধানক্ষেতের আইলে মরদেহ, পাশে পড়ে ছিল কলার ব্যাগ

১৬

অর্থ পাচার ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে অর্থায়ন প্রতিরোধ কর্মশালার সনদ প্রদান

১৭

‘ভারত আমার মাতৃভূমি’, হঠাৎ কেন এই কথা বললেন পাক ক্রিকেটার

১৮

হঠাৎ ঝড়ে লন্ডভন্ড সব

১৯

একটানা অনেক দিন চিয়া সিড খেলে শরীরে ৫ সমস্যা দেখা দিতে পারে

২০
X