প্রণব চক্রবর্তী
প্রকাশ : ১১ ডিসেম্বর ২০২৪, ০২:৫৯ এএম
আপডেট : ১১ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৮:২৭ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

গীতা জয়ন্তী ও মোক্ষদা একাদশী

গীতা জয়ন্তী ও মোক্ষদা একাদশী

মোক্ষদা একাদশী

মোক্ষদা একাদশী হলো পাপ থেকে মুক্তির জন্য এবং মৃত্যুর পর মোক্ষ (মুক্তি) অর্জনের জন্য ভগবান শ্রীবিষ্ণুর উপাসনার জন্য নিবেদিত একটি শুভ দিন। গীতা জয়ন্তীও একই দিনে পালিত হয়। এদিন শ্রীকৃষ্ণ তার যুদ্ধসারথি অর্জুনকে শ্রীমদ্ভগবদ্গীতার পবিত্র উপদেশ দিয়েছিলেন। এটি ৫১৬১তম গীতাজয়ন্তী।

মোক্ষদা একাদশীর দিন সূর্যোদয় থেকে পরের দিন ভোর পর্যন্ত সম্পূর্ণ উপবাস পালন করা হয়। যারা অসুস্থতা বা অন্য কোনো কারণে এ সময়ের জন্য উপবাস পালন করতে পারেন না, তারা আংশিক উপবাস পালন করেন। শুধু নিরামিষ খাবার, বিশেষ করে ফলমূল, শাকসবজি, দুগ্ধজাত দ্রব্য এবং বাদাম খাওয়া যায় এ আংশিক উপবাসকালে। তবে এই দিনে ভাত, মটরশুঁটি, ডাল, রসুন এবং পেঁয়াজ খাওয়া নিষিদ্ধ।

অধিকাংশ একাদশীর মতো, নিয়মিত আচারের মধ্যে বিষ্ণুর পূজা এবং প্রার্থনা জড়িত। এই দিনে শ্রীকৃষ্ণেরও পূজা করা হয়। সঠিকভাবে উপবাস পালনকারী ভক্তরা মৃত্যুর পর মোক্ষ লাভ করে থাকেন। এই দিনে একাদশী উপবাস পালনকারী ভক্তরা ভগবান বিষ্ণুর বিশেষ আশীর্বাদ লাভ করেন। পাশাপাশি তাদের পূর্বপুরুষদের আত্মাও শান্তি লাভ করেন।

আজ ১১ ডিসেম্বর রাত ১১টা ৫ মিনিট পর্যন্ত একাদশী তিথি। একাদশী তিথি শুরু হয়েছে গতকাল রাত ১টা ২৬ মিনিটে।

গীতা জয়ন্তী সনাতন ধর্মগ্রন্থের সব গ্রন্থের মধ্যে শ্রীমদ্ভগবদ্গীতাকে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ স্থান প্রদান করা হয়। কারণ এতে নিহিত জীবনের সার। আবার দ্বাপর যুগে শ্রীকৃষ্ণের সব লীলার বর্ণনাও পাওয়া যায় গীতায়। অর্জুন ও কৃষ্ণ সংবাদ গীতায় স্থান পেয়েছে। গীতায় জ্ঞানযোগ, কর্মযোগ, ভক্তিযোগ, রাজযোগ, একেশ্বরবাদ ইত্যাদির গূঢ় দর্শনের মনোমুগ্ধকর আলোচনা করা হয়েছে। ব্যক্তিকে কর্মের গুরুত্ব বোঝায় গীতা। গীতা জীবনের শাশ্বত সত্যকে দ্বিধাহীনভাবে মানুষের কাছে তুলে ধরে। শ্রেষ্ঠ মানব জীবনের সারও বর্ণিত রয়েছে এই গীতার মধ্যে। এতে ১৮টি অধ্যায় রয়েছে, যাতে জীবনের সঙ্গে জড়িত প্রতিটি প্রশ্নের উত্তর ও সমস্যার সমাধান নিশ্চিত করা হয়েছে।

মার্গশীর্ষ মাসের শুক্লপক্ষের একাদশীতে, ভগবান শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে ভগবদ্গীতার ঐশ্বরিক জ্ঞান প্রদান করেন। এই ঐতিহাসিক ঘটনাকে স্মরণ করতে প্রতি বছর গীতা জয়ন্তী পালিত হয়। সনাতন ধর্মে ভগবদ্গীতাকে একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং পবিত্র পাঠ হিসেবে বিবেচনা করা হয়।

গীতার প্রথম অধ্যায় ‘অর্জুন-বিষাদ যোগ’। এতে ৪৬টি শ্লোকের মাধ্যমে অর্জুনের মনঃস্থিতির বর্ণনা করা হয়েছে। অর্জুন নিজের আত্মীয়দের সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত হতে চান না। তারপর কৃষ্ণ তাকে কীভাবে সম্মত করান, তা এই অধ্যায়ে বর্ণিত আছে।

‘সাংখ্য যোগ’ গীতার দ্বিতীয় অধ্যায়। এতে মোট ৭২টি শ্লোক রয়েছে। কৃষ্ণ অর্জুনকে কর্মযোগ, জ্ঞানযোগ, সাংখ্যযোগ, বুদ্ধিযোগ ও আত্মার জ্ঞান দেন। এই অধ্যায় বাস্তবে গীতার সারাংশ পূরণ গীতাকে সংক্ষেপে প্রত্যয়ন করা হয়েছে এখানে।

‘কর্মযোগের’ ব্যাখ্যা পাওয়া যায় তৃতীয় অধ্যায়ে। এতে মোট ৪৩টি শ্লোক রয়েছে। এখানে শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে বোঝান যে, ফলাফলের চিন্তা না করেই ব্যক্তির কর্ম করা উচিত।

‘জ্ঞান যোগ’ গীতার চতুর্থ অধ্যায়ের বিষয়বস্তু। এতে ৪২টি শ্লোক রয়েছে। অর্জুনকে কৃষ্ণ বলেন, ধর্মপরায়ণের সংরক্ষণ ও অধর্মীদের বিনাশের জন্য গুরুর মাহাত্ম্য অনেক বেশি।

‘কর্ম-সন্ন্যাস যোগ’ গীতার পঞ্চম অধ্যায়। এতে ২৯টি শ্লোক রয়েছে। এখানে অর্জুন কৃষ্ণকে জিজ্ঞেস করেন কর্মযোগ ও জ্ঞান যোগ—এ দুইয়ের মধ্যে তার জন্য কোনটি শ্রেষ্ঠ? তখন কৃষ্ণ জানান যে, দুটোরই লক্ষ্য এক, কিন্তু কর্মযোগই উৎকৃষ্ট।

‘আত্মসংযম যোগ’ গীতার ষষ্ঠ অধ্যায়। এখানে ৪৭টি শ্লোক রয়েছে। কৃষ্ণ অর্জুনকে অষ্টাঙ্গ যোগ সম্পর্কে জানান। মনের ভ্রান্তি কীভাবে দূর করা যায়, তা অর্জুনকে ব্যাখ্যা করেন শ্রীকৃষ্ণ।

‘জ্ঞানবিজ্ঞান যোগ’ গীতার সপ্তম অধ্যায়। এখানে ৩০টি শ্লোক রয়েছে। শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে নিরপেক্ষ বাস্তব এবং তার ভ্রামক ঊর্জা, মায়া সম্পর্কে উপদেশ দেন।

‘অক্ষর-ব্রহ্মযোগ’ গীতার অষ্টম অধ্যায়ের বিষয়বস্তু। এখানে ২৮টি শ্লোক রয়েছে। গীতার এই পাঠে স্বর্গ ও নরকের সিদ্ধান্ত শামিল। এতে মৃত্যুর আগে ব্যক্তির চিন্তা, আধ্যাত্মিক সংসার ও নরক এবং স্বর্গে যাওয়ার পথ সম্পর্কে উপস্থাপন করা হয়েছে।

‘রাজবিদ্যা-রাজগুহ্য যোগ’ গীতার নবম অধ্যায় যেখানে ৩৪টি শ্লোক রয়েছে। কৃষ্ণের অভ্যন্তরীণ ঊর্জা সৃষ্টিকে ব্যাপ্ত করে, তার সৃজন করে এবং পূর্ণ ব্রহ্মাণ্ডকে নষ্ট করে দেয়।

‘বিভূতি যোগ’ গীতার দশম অধ্যায় এবং এতে ৪২টি শ্লোক রয়েছে। এখানে কৃষ্ণ অর্জুনকে জানান, কীভাবে সব তত্ত্ব ও আধ্যাত্মিক অস্তিত্বের অন্ত করে।

‘বিশ্বরূপ দর্শন যোগ’ গীতার একাদশ অধ্যায়ের বিষয়বস্তু, যেখানে রয়েছে ৫৫টি শ্লোক। এ অধ্যায়ের অর্জুনের নিবেদনে শ্রীকৃষ্ণ বিশ্বরূপ ধারণ করেন।

২০টি শ্লোকের মাধ্যমে ‘ভক্তি যোগ’ দ্বাদশ অধ্যায়ে বর্ণিত হয়েছে। ভক্তি মার্গের মহিমা সম্পর্কে অর্জুনকে জানান কৃষ্ণ। এর পাশাপাশি অর্জুনকে ভক্তি যোগের বর্ণনা দেন।

‘ক্ষেত্র-ক্ষেত্রজ্ঞ বিভাগ যোগ’ গীতার ত্রয়োদশ অধ্যায়ে বর্ণিত হয়েছে। এতে ৩৫টি শ্লোক রয়েছে। এতে কৃষ্ণ অর্জুনকে ক্ষেত্র ও ক্ষেত্রজ্ঞের জ্ঞান দেন। পাশাপাশি সত্ত্ব, রজ ও তম গুণ দ্বারা উৎকৃষ্ট জন্ম লাভের উপায় জানান।

২৭টি শ্লোকের সাহায্যে ‘গুণত্রয় বিভাগ যোগ’ চতুর্দশ অধ্যায়ে বর্ণিত। এতে শ্রীকৃষ্ণ সত্ত্ব, রজ ও তম গুণ ও মনুষ্যের উত্তম, মধ্যম তথা অন্যান্য গতির সবিস্তার বর্ণনা করেছেন। অবশেষে এই গুণ লাভের উপায় ও এর ফল জানিয়েছেন।

‘পুরুষোত্তম যোগ’ গীতার পঞ্চদশ অধ্যায়। এতে ২০টি শ্লোক রয়েছে। এখানে কৃষ্ণ বলেন যে, ঐশ্বরিক প্রকৃতি সম্পন্ন জ্ঞানী পুরুষ সর্বপ্রকারে আমার ভজন করেন ও অসুর প্রবৃত্তির অজ্ঞানী পুরুষ আমার উপহাস করেন।

‘দৈবাসুর সম্পদ বিভাগ যোগ’ গীতার ষোড়শ অধ্যায়। এখানে ২৪টি শ্লোক রয়েছে। এতে শ্রীকৃষ্ণ স্বাভাবিক রীতিতে ঐশ্বরিক প্রকৃতির জ্ঞানী পুরুষ ও অসুর প্রবৃত্তির অজ্ঞানী পুরুষের লক্ষণ সম্পর্কে জানিয়েছেন।

‘শ্রদ্ধাত্রয় বিভাগ যোগ’ গীতার সপ্তদশ অধ্যায়। এতে ২৮টি শ্লোক রয়েছে। এখানে কৃষ্ণ অর্জুনকে জানান, শাস্ত্র বিধির জ্ঞান না থাকলে ও অন্য কারণে শাস্ত্র বিধি ত্যাগ করা সত্ত্বেও যজ্ঞ, পূজা ইত্যাদি শুভ কর্ম যিনি শ্রদ্ধা ভরে করে থাকেন, তাদের পরিস্থিতি কেমন হয়।

‘মোক্ষ যোগ’ গীতার অষ্টাদশ অধ্যায়। এতে ৭৮টি শ্লোক রয়েছে। এটি আগের সব অধ্যায়ের সারমর্ম। এতে অর্জুন কৃষ্ণের কাছে ন্যাস অর্থাৎ জ্ঞানযোগ ও ত্যাগ অর্থাৎ ফলাসক্ত রহিত কর্মযোগের তত্ত্ব জানার ইচ্ছা প্রকট করেন।

গীতা জয়ন্তীতে করণীয়

গীতা জয়ন্তীর দিন ব্রহ্ম মুহূর্তে খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠে স্নান করে পরিষ্কার বস্ত্র পরিধান করুন। ভগবান শ্রীকৃষ্ণের ধ্যান করুন এবং যথাযথভাবে তার উপাসনা করুন।

সূর্যদেবকে জল নিবেদন করুন।

শ্রীকৃষ্ণের প্রতিমা বা ছবিতে চন্দন, ফুল ও প্রদীপ অর্পণ করুন। ভগবদ্গীতা গ্রন্থের ওপর চন্দনের তিলক লাগিয়ে পুজো করুন।

গীতার শ্লোক পাঠ করুন এবং গীতার আরতি করুন।

কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধক্ষেত্রে অর্জুনকে দেওয়া শ্রীকৃষ্ণের শিক্ষা কেবল তার জন্য নয়, সমগ্র মানবতার জন্য অনুপ্রেরণাদায়ক।

লেখক: ঢাকেশ্বরী জাতীয় মন্দির কমিটির উপদেষ্টা পুরোহিত, সম্পাদক: জয় বাবা লোকনাথ পঞ্জিকা এবং অতিরিক্ত সচিব (অব.)

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

গরুর মাংসে হাড়-চর্বি বেশি দেওয়ায় সংঘর্ষ

‘বিএনপি ছাড়া দেশে শান্তি আসবে না’

এক ইলিশ ১০ হাজার টাকা

ভাতের হোটেলের পাওনা চাওয়ায় গুলি

ব্যক্তি স্বার্থে দলকে ব্যবহার করা যাবে না : সেলিমুজ্জামান

‘জনগণের অধিকার ও মৌলিক চাহিদা নিশ্চিত করতে কাজ করছে বিএনপি’

নিউইয়র্কের প্রবাসীদের এনআইডি কার্যক্রমের উদ্বোধন

কুয়েতে প্রবাসী বাংলাদেশিদের জন্য সুখবর

ফের জামায়াতের সমালোচনা করলেন হেফাজত আমির

জবি ক্যাম্পাসে ছাত্রদল নেতা হাসিবুলের প্রথম জানাজা সম্পন্ন

১০

গণতন্ত্রে উত্তরণে বিশ্বের সমর্থন পাওয়া গেছে : মির্জা ফখরুল

১১

আমরা পা ছেড়ে মাথার রগে ফোকাস করছি, মজার ছলে সর্ব মিত্র

১২

নাটকীয় ম্যাচ জিতে টাইগারদের সিরিজ জয়

১৩

জবি ছাত্রদল নেতার মৃত্যুতে হাসপাতালে ভিপি সাদিক কায়েম

১৪

হঠাৎ খিঁচুনিতে জবি ছাত্রদল নেতার মৃত্যু

১৫

আবারও ইনজুরিতে ইয়ামাল

১৬

ঈদগাহের নামকরণ নিয়ে দ্বন্দ্ব, দুই গ্রামবাসীর সংঘর্ষ

১৭

খুলনায় ছেলের হাতে বাবা খুন

১৮

চাকসু নির্বাচন / ১৫ সেকেন্ডে দিতে হবে ১ ভোট

১৯

‘ভোটের অধিকার না থাকায় শ্রমজীবীরা বেশি অমর্যাদার শিকার’

২০
X