প্রতি বছর খ্রিষ্টীয় নববর্ষ উদযাপনে দেশের মানুষ নতুন বছরকে বরণ করে আতশবাজি ফাটানো ও ফানুস ওড়ানোর মাধ্যমে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের মতো বাংলাদেশেও নববর্ষ উদযাপনে ব্যাপকভাবে আতশবাজি, পটকা ফোটানো, ফানুস ওড়ানো ইত্যাদি ব্যাপক ব্যবহার হচ্ছে, যা মানুষ, পরিবেশ ও প্রকৃতির মারাত্মক ক্ষতির। ফানুস ওড়ানোয় অগ্নিকাণ্ডের মতো বড় অনাকাঙ্ক্ষিত দুর্ঘটনাও ঘটছে। আনন্দঘন এ রাত কখনো কখনো বিষাদে পরিণত হয়। ভয়াবহ শব্দদূষণে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে রোগী, বৃদ্ধ, শিশু ও পাখিরা।
৩১ ডিসেম্বর রাত ১১টার পর থেকেই ঢাকাসহ বিভিন্ন শহরের আকাশে আলোর ঝলকানি শুরু হয়। রাত ১২টা বাজার সঙ্গে সঙ্গে আতশবাজির বর্ণিল আলোতে আলোকিত হয় আকাশ। তবে মুহুর্মুহু কান ফাটানো শব্দে বিরক্ত হয়েছে রাজধানীর বাসিন্দারা। খ্রিষ্টীয় নববর্ষ উদযাপন উপলক্ষে থার্টিফার্স্ট নাইটে ঢাকাসহ সারা দেশে ফানুস ওড়ানো ও আতশবাজি না করতে কঠোর নির্দেশনা দেয় পুলিশ। কিন্তু সেই নির্দেশনা উপেক্ষা করে বিভীষিকাময় উৎসবে মেতে ওঠে অনেকে। নতুন বর্ষবরণের নামে একশ্রেণির মানুষের এমন কর্মকাণ্ডে দীর্ঘদিন ধরে বিরক্তি ও ক্ষোভ প্রকাশ করে আসছে সচেতন নগরবাসী।
ঢাকা মহানগরসহ দেশের বড় বড় শহরে পরিবেশ দূষণের অন্যতম কারণ হচ্ছে শব্দদূষণ। শহরে উচ্চ শব্দদূষণের কোনো প্রাণীর বিলুপ্তির খবরও শোনা যায়। এ কারণে শহরে পাখি কমে যাচ্ছে দিন দিন। বর্ষবরণের রাতের বিকট শব্দে ও বায়ুদূষণের কারণে বিভিন্ন জায়গায় পাখির মৃত্যু হয়। রাতে ফানুস ওড়ানো, আতশবাজি ও পটকা ফাটানোর আনন্দ-উল্লাস অনেকের জন্য বিপদ ডেকে আনে। এতে রাজধানীসহ দেশের বেশিরভাগ বড় শহরের বায়ু ও শব্দদূষণ তীব্র হয়ে ওঠে। অসুস্থ রোগী, শিশু ও প্রবীণ মানুষরা অনেকেই অস্বস্তি ও অসুস্থ বোধ করেন।
বাংলাদেশেও বহুকাল ধরে আতশবাজি ব্যবহার হচ্ছে। আতশবাজি খেলার মাধ্যমে উৎসব উদযাপন আনন্দের খোরাক হলেও প্রাণীদের জন্য আতঙ্ক ও প্রাণহানির খেলা। আতশবাজিতে উচ্চমাত্রায় শব্দ ও বায়ুদূষণ হয়, তাতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতির শিকার হচ্ছে শহরের পাখিগুলো। পাখি ভয় ও আতঙ্কে বাসা থেকে উড়ে অন্যত্র আশ্রয় নেয়। পাখিরা অসুস্থ হয়ে পড়ে। সবচেয়ে বেশি মৃত্যু ঘটে চড়ুইসহ ছোট পাখির। আর বিকট শব্দে বাসা থেকে বেশি পালায় টিয়া, কাক, লক্ষ্মীপ্যাঁচা, দোয়েল ও শালিক পাখি।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, আবাসিক বাড়িতে ও শোবার ঘরে শব্দের মাত্রা ২৫ ডেসিবল, অন্যান্য রুমে ৪০ ডেসিবল, হাসপাতালে ২০ থেকে ৩০ ডেসিবল, রেস্টুরেন্টে ৪০ থেকে ৫০ ডেসিবল, অফিস কক্ষে ৩৫ থেকে ৪০ ডেসিবল এবং শ্রেণিকক্ষে ৩০ থেকে ৪০ ডেসিবল থাকা স্বাস্থ্যসম্মত। এর চেয়ে বেশি হলে সেটা শব্দদূষণের পর্যায়ে পড়ে। উচ্চশব্দ মানুষের ঘুমেও ব্যাঘাত সৃষ্টি করে। শব্দদূষণের কারণে হৃদরোগ, উচ্চ রক্তচাপ, বুক ধড়ফড়, খিটখিটে মেজাজ, মাথাব্যথা, পেপটিক আলসার, অস্থিরতা, অমনোযোগী ভাব, ঘুমে ব্যাঘাত, শ্রবণশক্তি ও স্বাভাবিক কর্মক্ষমতা হ্রাস পেতে পারে।
ফানুস মূলত ছোট আকারের একটি হট এয়ার বেলুনের মতো কাজ করে। ফানুসে থাকা মোমবাতি একে বাতাসে উড়তে সাহায্য করে। ওজনে হালকা হওয়ায় আগুন না নেভা পর্যন্ত বেশ উঁচুতেই উড়তে পারে একটি ফানুস। একটি ফানুস ৩ হাজার ফুট উচ্চতায় ৬ থেকে ২০ মিনিট পর্যন্ত উড়তে পারে। ফানুসের কাঠামো তৈরিতে ব্যবহৃত করা হয় তার ও বাঁশের ফ্রেম। আকাশে উড়তে থাকা অনেক পাখিরই ফানুসের সঙ্গে ধাক্কা লেগে মৃত্যু ঘটে। মাটিতে পড়ার সঙ্গে সঙ্গেই ফানুসের আগুন নিভে যায় না। ফলে এ ফানুস গাছপালা বা মাটিতে থাকা দাহ্য পদার্থের সংস্পর্শে এসে অগ্নিকাণ্ড ঘটা অস্বাভাবিক কিছু নয়।
পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর উৎসব অনুষঙ্গ আতশবাজি। একটি চীনা আতশবাজিতে ৪৬.৮৮ শতাংশ পটাশিয়াম নাইট্রেট, ২৩.৪৪ শতাংশ সালফার, ২৩.৪৩ শতাংশ অ্যালুমিনিয়াম ও ৬.২৫ শতাংশ বেরিয়াম নাইট্রেট ব্যবহৃত হয়। স্থানীয় আতশবাজিতে এসব ক্ষতিকর উপাদান ব্যবহারের অনুপাত আরও বেশি। এতে যে শুধু পরিবেশই দূষিত হয় তা নয়; আতশবাজির উচ্চশব্দ বিভিন্ন প্রাণীর মৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়ায়। নববর্ষ উদযাপনের এই প্রচণ্ড শব্দে পাখিরা ওড়াউড়ি করে এবং গাছে বা বিল্ডিংয়ের দেয়ালে আঘাত পেয়ে নিচে পড়ে গিয়ে আহত হয়েছে, এমনকি মারাও গেছে।
আতশবাজি বা পটকাবাজি মূলত তিন ধরনের ক্ষতি করে। এগুলো ফোটানোর সঙ্গে সঙ্গে বিকট শব্দ হয়, যা চারদিকে শব্দদূষণ ঘটায়। এই শব্দ শিশু, বৃদ্ধসহ রোগীদের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। এতে হার্ট অ্যাটাকের আশঙ্কা থাকে। আতশবাজির শব্দে প্রাণীরা চমকে ওঠে। ফলে প্রতি বছর হাজারো পাখি ও বন্যপ্রাণী অসুস্থ হয়ে মারা যায়। পথে থাকা কুকুর-বিড়াল ভয়ে ছোটাছুটি করে, আতঙ্কিত হয়ে পড়ে। এ ছাড়া এ থেকে ক্ষতিকর রাসায়নিক পদার্থ বাতাসে ছড়িয়ে পড়ে মারাত্মক বায়ুদূষণ ঘটায়, যা ফুসফুসের নানা রোগের কারণ। প্রতি বছর নববর্ষ উদযাপনে আনন্দের নামে আতশবাজির উচ্চশব্দ তৈরির খেলা করা হয়, তাতে নাগরিকজীবন নানাভাবে ক্ষতির শিকার হয়। তাই আতশবাজি ফোটানো ও ফানুস ওড়ানো বন্ধে সামাজিকভাবে সচেতনতা সৃষ্টি করা প্রয়োজন।
প্রকাশ ঘোষ বিধান,পাইকগাছা