বিশ্ববরেণ্য স্থপতি লুই ইসাডর কানের ঢাকায় আগমন শুধু একটা সফরই ছিল না; বরং এর সঙ্গে অন্তর্নিহিত ছিল একজন গুরু স্থপতির অমর স্থাপত্য রচনার সূচনালগ্নের কথকতা। বিশ্ব স্থপতির কালজয়ী সৃষ্টির সূতিকাগারে অমর স্থাপত্যের জন্মপূর্ব বিচরণ ও তার পর্যবেক্ষণ নিয়েও আমাদের জানার প্রয়োজন আছে বৈকি। তার এ কর্মকাণ্ড ছিল তার নবদর্শনের স্থাপত্যবোধের বিকাশকাল। শেরেবাংলা নগর প্রকল্পে কান কীভাবে নিযুক্ত হন; তার প্রি-বিড মিটিং, পারিশ্রমিকের নেগোসিয়েশন কেমন ছিল? অথবা কেমন ছিল তার আইডিয়ার উপস্থাপনা? কেমনইবা ছিল তার ডিজাইন-পূর্ববর্তী সাইট মূল্যায়ন বা ব-দ্বীপকে তিনি কোন দৃষ্টিকোণ থেকে দেখেন? সেইসঙ্গে তার ডিজাইনের কোনো প্রভাব পড়েছিল কি না। আবার লুইয়ের অফিস কর্তৃপক্ষকে কোন প্রক্রিয়ায় তাদের সম্মানীর যৌক্তিকতা তুলে ধরেছিল। অন্যদিকে কান তার আইডিয়া প্রতিষ্ঠায় কতটুকু প্রসব বেদনাইবা সহ্য করেন—সেসব সম্পর্কে কিঞ্চিৎ ধারণা দিতেই এ লেখার অবতারণা।
গণতন্ত্র ও স্থাপত্যের মধ্যে সম্পর্ক বহুমুখী, যা রাজনৈতিক আদর্শ ও সামাজিক মূল্যবোধ নির্মিত পরিবেশকে কীভাবে রূপ দিতে পারে, তা প্রতিফলিত করে। গণতান্ত্রিক সমাজের স্থাপতিক বহিঃপ্রকাশের মাধ্যম হচ্ছে সংসদ ভবন, আদালত, সিটি হল, মিউজিয়াম, প্রশাসনিক ভবন, গণজমায়েতের স্কয়ার ইত্যাদি। নিজেকে গণতন্ত্রবান্ধব প্রমাণের কপট উচ্চাভিলাষে তৎকালীন স্বৈরাচারী সামরিক সরকার ঢাকায় সংসদ ভবন প্রকল্পটির আয়োজন করে। বাংলাদেশের স্থাপত্যাচার্য মাজহারুল ইসলামের মধ্যস্থতায় ১৯৬২ সালে লুই কানকে দিয়ে এর নকশা প্রণয়নের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
১৯০১ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি ইউরোপের এস্তোনিয়ায় দরিদ্র ইহুদি পরিবারে লুই কানের জন্ম। তবে বাল্যকালেই যুক্তরাষ্ট্রের ফিলাডেলফিয়ায় এসে স্থায়ী হন। কান তার নিজস্ব স্থাপত্যশৈলী খুঁজে পান সুদীর্ঘ কর্মজীবনের প্রায় শেষের দশকে, যা বিশ্ব স্থাপত্যের আরাধ্য দর্শন হয়ে ওঠে।
কান ১৯৬২ সালে প্রথম জমি পরিদর্শন এবং সরকারের ইচ্ছেগুলো জানতে ঢাকায় সংক্ষিপ্ত সফর করেন। প্রকল্পের ফাংশন সম্পর্কে কর্তৃপক্ষ বিশ্লেষণ দিতে না পারায় কানকেই একটি প্রস্তাবনা উপস্থাপন করতে বলা হয়। যদি তার প্রস্তাবনা গ্রহণযোগ্য হয়, তবে উভয়পক্ষের মধ্যে চূড়ান্ত চুক্তি স্বাক্ষরিত হবে মর্মে আলোচনার মাধ্যমে প্রথম সফর শেষ হয়। এমন মর্যাদাপূর্ণ প্রকল্পের দায়িত্ব পেয়ে লুই কান যথেষ্ট উদ্দীপ্ত ছিলেন। পূর্ণোদ্যমে প্রস্তাবনা সম্পন্ন করে ৮ মার্চ ১৯৬৩ সালে পুনরায় প্রকৌশলী অগাস্ট কোমেন্ড্যান্টসহ ঢাকায় আসেন। পরদিন লুই কান অর্থমন্ত্রী ও উচ্চপদস্থ সরকারি আমলাদের সামনে খসড়া মাস্টারপ্ল্যান এবং স্টাডি মডেল উপস্থাপন করেন। উপস্থিত প্রত্যেকেই তার প্রস্তাবিত নকশায় সন্তুষ্ট হন। অর্থমন্ত্রী কানকে ধন্যবাদ জানিয়ে প্রকল্প সাইট পরিদর্শন করার অনুরোধ করেন।
তারা তৎকালীন বিমানবন্দর ও সেনানিবাসের কাছাকাছি প্রস্তাবিত ২০০ একরের সাইটটি পরিদর্শনকালে অনুধাবন করেন জায়গাটি কৃষি বিদ্যালয়ের অধ্যয়নের জন্য ব্যবহৃত কৃষিভূমি এবং নতুন স্থাপনা নির্মাণে জটিলতাহীন। ঢাকার আশপাশ পরিদর্শনকালে লুই লক্ষ করেন এখানকার ল্যান্ডস্কেপ প্রধানত সমতল ব-দ্বীপ এলাকার নদীবেষ্টিত পলল নিম্নভূমি। বাড়িগুলো মাটির স্তূপের ওপর নির্মিত এবং পার্শ্ববর্তী এলাকার চেয়ে কিছুটা উঁচু। উঁচু করতে বাড়ির পাশের খননকৃত গর্তটি মাছের পুকুর হিসেবে ব্যবহৃত হয়। বর্ষায় হিমালয়ের ঢলে নদীগুলো উপচে পড়ে নিম্নাঞ্চল প্লাবিত করলে উঁচু ঢিবির ওপর থাকা বাড়িগুলোর মধ্যে গমনাগমনে নৌকা ব্যবহৃত হয়। যখন পানির স্তর কমে তখন বাড়ির পুকুরগুলো মাছে পরিপূর্ণ হয়। তাই কৃষকদের সারা বছর মাছের অভাব হয় না। বসতবাড়ির পার্শ্ববর্তী উঁচু স্থানে ইটের স্তূপ থাকে, যা কৃষকরা স্থানীয় মাটির চুলায় পুড়িয়ে আদিম পদ্ধতিতে উৎপাদন করে।
স্থানীয় নির্মাণপদ্ধতি পর্যালোচনার জন্য কানের সহযোগীরা নির্মাণ সাইটগুলো পরিদর্শনে লক্ষ করেন, আমদানি করা সিমেন্টের মান খারাপ। মাচা, স্ক্যাফোল্ডিং, ফর্মওয়ার্কের জন্য পাটের রশি, বাঁশের খুঁটি ও নিম্নমানের তক্তা ব্যবহৃত হয়। রডও আমদানি করা হয়। কংক্রিট মেশানো, রড বাঁকানো এবং উপকরণ হাতে বহন করা হয়। সর্বোপরি কাজের গুণগতমান খারাপ।
এদিকে কর্তৃপক্ষ নকশাগুলো পর্যালোচনায় সন্তুষ্ট ছিলেন। তবে তাদের প্রধান উদ্বেগ ছিল ইসলামিক বৈশিষ্ট্য—বিশেষ করে মসজিদ, তার অবস্থান এবং দিকনির্দেশনা সম্পর্কিত। বাংলাদেশ বিভিন্ন ধর্ম-সম্প্রদায়ের। তাই কান সিদ্ধান্ত নেন, সব ধর্মের জন্য একটি সাধারণ ধ্যানের স্থান তৈরি করা; যেখানে একজন অবিশ্বাসীও প্রবেশ করতে পারবে। এটি কাবার দিকবর্তী হতে পারে। তবে দেখতে ঐতিহ্যবাহী মসজিদের মতো নয়। পরদিনের সভায় একজন সাংসদ কানকে অপ্রস্তুত করে প্রশ্ন তোলেন, মুসলিমপ্রধান সমাজের প্রকল্পের জন্য কেন একজন ইহুদি স্থপতি নিযুক্ত হলো? তখন কর্তৃপক্ষ দক্ষতা ও শ্রেষ্ঠতার বিচারে কানের প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরেন। এভাবে মসজিদের মতো ইহুদিসংক্রান্ত দ্বিধারও সমাধান হয়।
এসব আলোচনার পর চুক্তির প্রসঙ্গ আসলে কান নির্মাণ ব্যয়ের ৭ শতাংশ ফি দাবি করেন। কিন্তু কর্তৃপক্ষ ৫ শতাংশ প্রস্তাব দেন। কারণ অনেক নামকরা বিদেশি স্থপতি ৫ শতাংশ ফিতে রাজি ছিলেন। কানের ৭ শতাংশ কীভাবে যৌক্তিক হবে জানতে চাইলে অগাস্ট বলেন, তারা অন্যদের তুলনায় ভিন্ন ধরনের সেবা দেবেন। প্রথমত, তারা স্থানীয় স্থপতি ও প্রকৌশলীদের প্রশিক্ষণ দিয়ে এ কাজে সম্পৃক্ত করবেন। দ্বিতীয়ত, তাদের আধুনিক নির্মাণ পদ্ধতি ও সরঞ্জাম কাজ শেষের পরেও এ দেশের কাজে লাগবে। তৃতীয়ত, তারা প্রিকাস্টিং ও প্রি-স্ট্রেসিং প্লান্ট স্থাপন করে নির্মাণ কাঠামোর গুরুত্বপূর্ণ উপাদান বানাবেন। তারা আরও নিশ্চয়তা দেন যখন ভবনসমূহ নির্মিত হবে, তখন এটা হবে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার নির্মাণশিল্পের পথিকৃৎ। যুক্তিগুলো অর্থমন্ত্রীর মনঃপূত হওয়ায় ৭ শতাংশ ফি চূড়ান্ত হয়। এর পরের সভায় তৎকালীন রাষ্ট্রপতি স্থানীয় রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে কানকে দ্রুত নকশা শেষ করার অনুরোধ করলে জুলাইয়ে নির্মাণ ড্রইং নিয়ে ফিরবেন বলে প্রতিশ্রুতি দিয়ে কান কলকাতা, দিল্লি, আগ্রা হয়ে ফিলাডেলফিয়ায় চলে যান।
যুক্তরাষ্ট্রে ফিরে কান মূল কন্সেপ্টের জ্যামিতিক কাঠামো ঠিক রেখেই ডিজাইন সংশোধন করতে কালক্ষেপণ করছিলেন। ফলে কান জুলাইয়ে ঢাকায় না গিয়ে এক মাস পর যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু কর্তৃপক্ষকে দেওয়া প্রতিশ্রুতি রক্ষার্থে অগাস্ট কানকে কাজ সম্পন্ন করার তাগিদ দিলে চাপে পড়ে কান ১৯৬৩ সালের জুলাইতেই ঢাকায় কর্তৃপক্ষের সঙ্গে সভা করলেও সেখানে নির্মাণ ড্রইং জমা না দিয়ে বলেন যে, অগাস্ট ড্রইং শেষ করতে পারেননি। বস্তুত, মনঃপূত নকশা অর্জনে আপসহীন থাকার মানসিকতা থেকে তিনি অজুহাত বানিয়ে তার কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছতে সময় নেন। ফলে প্রকল্পের নির্মাণকাজ বিলম্বিত হয়ে ১৯৬৪ সালের অক্টোবরে শুরু হয়।
১৯৬৮-৬৯ সালের দিকে কান সংসদ ভবনের ছাদের নকশা নিয়ে দোটানায় পড়লে অগাস্ট এর সমাধান করেন। এর পরই মহান মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে নির্মাণকাজ বন্ধ হয়। স্বাধীনতার পর বাংলাদেশের কাছ থেকে প্রকল্পটি শেষ করার অনুরোধ পেয়ে কান পুনরায় ঢাকায় আসেন। সে সময় কান তিন-চারবার ঢাকায় আসেন। বুয়েটে বক্তৃতাও দেন। সর্বশেষ, ১৯৭৪ সালের মার্চে ঢাকা থেকে ফেরার পথে নিউইয়র্কের ট্রেন স্টেশনে কান হঠাৎ মৃত্যুবরণ করেন।
স্থাপত্যে সাফল্য সত্ত্বেও নকশা সংশোধনে অতিরিক্ত সময়ক্ষেপণ এবং বিশদ গবেষণার বাড়তি খরচ নিজেই বহন করার ফলে কান আর্থিকভাবে নাজুক হয়ে প্রায়ই ঋণগ্রস্ত থাকতেন। জাতীয় সংসদ ভবনেও বারবার নকশা সংশোধন এবং দীর্ঘায়িত নির্মাণের কারণে ব্যয় বৃদ্ধির ফলে কান যথার্থ ফি পাননি। তবে তিনি সল্ক ইনস্টিটিউটের কাজ থেকে প্রাপ্ত অর্থ দিয়ে ঢাকার কাজ এগিয়ে নেন।
বস্তুত, শুধু সৃজনশীলতা নয় বরং স্থপতির ত্যাগ, কনসেপ্টের প্রতি একাত্মতা, মমত্ববোধ, কাজের প্রতি সমর্পিত আবেগ ছাড়া কোনো স্থাপত্যকর্মই পূর্ণাঙ্গ রূপ পায় না। যদিও কানের ৮০০ একরের মাস্টারপ্ল্যান অনুযায়ী সব ভবন নির্মাণ ব্যতিরেকেই ১৮ বছর পর ১৯৮২ সালে প্রকল্পটি শেষ হয়; তথাপি এটি বিংশ শতাব্দীর অন্যতম সেরা স্থাপত্য হিসেবে রয়ে গেছে, যা বাংলাদেশে গণতন্ত্র ও পরিচয়ের প্রতীক।
লেখক: স্থপতি, প্রতিষ্ঠাতা
আর্ক-বাংলা ডট কম