বেশ কয়েকটি কারণে দেশের অর্ধেক মানুষ নিজেদের অনিরাপদ মনে করছেন বলে জানাচ্ছে সরকারি সংস্থা বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর একটি জরিপ। বিষয়টি উদ্বেগের বলাই বাহুল্য। জরিপের নাম ‘সিটিজেন পারসেপশন সার্ভে’ বা নাগরিক অভিমত। জুলাই বিপ্লবের পর গত ফেব্রুয়ারি মাসে জরিপটি পরিচালনা করা হয়, যার প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয় গত মাসের ১৯ জুন। জরিপটিতে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ যে তথ্য দিয়েছেন, তাই তুলে ধরা হয়েছে; প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তির কোনো নিজস্ব মতামত বা মন্তব্য গ্রহণ করা হয়নি বলে জানানো হয়। প্রতিবেদনের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ২০২৪ সালের ৫ আগস্টের গণঅভ্যুত্থানের পর থেকে দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণহীন ছিল। সেই বেসামাল পরিস্থিতি এখন অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। তারপরও দেশের প্রায় অর্ধেক নাগরিক নিজের মূল্যবান সম্পদ চুরি, খোয়া যাওয়া, লুটপাট ও বাড়িঘর এমনকি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে ভাঙচুর আতঙ্কে রয়েছেন। এই আতঙ্ক পুরুষের তুলনায় নারীদের মধ্যে বেশি। প্রায় ৫০ শতাংশ নারী মূল্যবান সম্পদ হারানোর আশঙ্কা করছেন। শারীরিক আঘাত পাওয়ার আতঙ্কে রয়েছেন ৩৪ শতাংশ মানুষ।
জরিপটি ৬৪ জেলার ১ হাজার ৯২০টি প্রাইমারি স্যাম্পলিং ইউনিট (পিএসএল) থেকে ১৮ বছর বা তদূর্ধ্ব বয়সী ৮ লাখ ৩১ হাজার ৮০৭ নারী-পুরুষ উত্তরদাতার সাক্ষাৎকারের মাধ্যমে তথ্য সংগ্রহ করা হয়। জরিপে নাগরিকদের দৃষ্টিভঙ্গি ও অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে নিরাপত্তা, সুশাসন, সরকারি সেবার মান, দুর্নীতি, ন্যায়বিচারে প্রবেশাধিকার এবং বৈষম্যবিষয়ক এসডিজি ১৬-এর ছয়টি সূচকের অগ্রগতি বিষয়ে মূল্যায়ন করা হয়। জরিপের প্রশ্নপত্র জাতিসংঘের নির্ধারিত। এ জরিপ থেকে এসডিজি ১৬-এর ৬ সূচকের তথ্য পাওয়া গেছে। বর্তমান পরিস্থিতিতে নাগরিকরা বসবাসের জন্য নিরাপত্তার প্রশ্নে কতটা নিরাপদ বা তার আবাসস্থল, কর্মস্থল বা ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও মূল্যবান দ্রব্যাদি সুরক্ষায় কতটা নিরাপদে আছেন, ওই অবস্থা উঠে এসেছে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা এবং মব ভায়োলেন্স বন্ধ করা না গেলে নাগরিকদের মধ্যে আতঙ্ক কাটবে না। সরকার, আইনপ্রয়োগকারী সংস্থা বা প্রশাসনের প্রতি জনআস্থা ফেরানো সম্ভব না হলে এ পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে না। সাধারণ মানুষও নিজেদের নিরাপদ মনে করবে না।
আমরা জানি, গত বছর জুলাই-আগস্ট অভ্যুত্থানের পর দেশে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির ব্যাপক অবনতি হয়। বলা চলে একপর্যায়ে আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণ করবে যারা, তারা ছিলেন অনুপস্থিত। তখন সাধারণ মানুষই নিজেদের রক্ষা করেছেন। অভ্যুত্থানের প্রায় এক বছর অতিবাহিত হতে চলেছে। ধীরে ধীরে সেই পরিস্থিতির ভয়াবহতা কমলেও এখনো তা প্রত্যাশিত জায়গায় পৌঁছেনি। কেননা, এখনো প্রায় প্রতিদিন দেশের কোথাও না কোথাও বিভিন্ন কারণ, অভিযোগ বা অজুহাতে মব ভায়োলেন্সের নামে সহিংসতার ঘটনা ঘটছে। পাশাপাশি ঘটছে চুরি-ডাকাতি-ছিনতাই-ধর্ষণের মতো নানা রকমের সামাজিক অপরাধ।
আমরা মনে করি, যে কোনো সমাজের অপরাধপ্রবণতা বৃদ্ধি সেই সমাজের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির দুর্বলতা, জবাবদিহির অভাব কিংবা আইনের শাসনের নাজুকতারই বহিঃপ্রকাশ। এ ছাড়া আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণ করবে যে বাহিনী, জুলাই অভ্যুত্থানের পর এখনো যে তারা নৈতিকভাবে চাঙ্গা হয়ে উঠতে পারেনি—এটা একটা বাস্তবতা। তবে, প্রায় এক বছর পর এ কারণটি আর অতটা সমর্থনযোগ্য নয়। এখানে সরকার ও রাষ্ট্রের দুর্বলতাও রয়েছে—এ কথাও স্বীকার করতে হবে। স্মরণে রাখা জরুরি যে, রাষ্ট্রের প্রথম কাজ হচ্ছে মানুষের জানমালের নিরাপত্তা বিধান করা। আমাদের প্রত্যাশা, সরকার আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি উন্নয়নে যথাযথ উদ্যোগ গ্রহণ করবে। দূর হবে ভয়-আতঙ্ক। জনমনে ফিরবে স্বস্তি।
মন্তব্য করুন