সাঈদ খান
প্রকাশ : ১৩ জুলাই ২০২৫, ১২:০০ এএম
আপডেট : ১৩ জুলাই ২০২৫, ০৯:৪৮ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

সব চক্রান্ত রুখে দেবে জনগণ

ছবি : কালবেলা গ্রাফিক্স
ছবি : কালবেলা গ্রাফিক্স

বাংলাদেশে দীর্ঘদিন ধরেই বিএনপি একটি পরিকল্পিত রাষ্ট্রীয় দমন-পীড়নের শিকার হয়ে আসছে। প্রশাসনিক হয়রানি, গুম-খুন-গ্রেপ্তার এবং মনগড়া মামলার পাশাপাশি দলটির বিরুদ্ধে পরিচালিত হয়েছে এক নির্মম তথ্যযুদ্ধ। মূলধারার মিডিয়া ও ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে ইচ্ছাকৃতভাবে তথ্য গোপন, বিকৃতি ও বিভ্রান্তি ছড়ানো হয়েছে। ‘ডিজিটাল এজেন্ট’ নিয়োগ দিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় গুজব ও অপপ্রচার চালানো হয়েছে, যাতে সাধারণ মানুষ বিএনপির প্রকৃত অবস্থান ও তারেক রহমানের বক্তব্য সম্পর্কে অজ্ঞ থাকে।

বিগত তিনটি নির্বাচনে বিএনপির অংশগ্রহণের চেষ্টা প্রতিবারই রাষ্ট্রীয় ষড়যন্ত্র দিয়ে বাধাগ্রস্ত করা হয়েছে। প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারীবাহিনী ও পক্ষপাতদুষ্ট নির্বাচন কমিশনের সহায়তায় প্রহসনের নির্বাচন আয়োজন করা হয়েছে; যেখানে বিএনপি প্রার্থীদের মনোনয়ন বাতিল, এজেন্টদের কেন্দ্র থেকে বের করে দেওয়া এবং ভুয়া মামলায় গ্রেপ্তার করার ঘটনা নিয়মিত ছিল। এর ফলে জনগণের ভোটাধিকার ও গণতন্ত্র মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

একাধিক মিডিয়া ও রাষ্ট্রীয় প্রচারণায় বিএনপিকে কখনো ধর্মান্ধ, কখনো ধর্মবিরোধী, আবার কখনো কট্টর বা অদক্ষ হিসেবে চিত্রিত করা হয়েছে। এভাবে বিভ্রান্তিকর স্টেরিওটাইপ তৈরি করে একটি বৃহৎ রাজনৈতিক শক্তিকে জনমনে থেকে বিচ্ছিন্ন করার অপচেষ্টা চালানো হয়েছে, যা গণতন্ত্রের ন্যূনতম মানদণ্ডের সংগতিপূর্ণ নয়।

বাংলাদেশের রাজনীতিতে গত দুই দশকে একটি লক্ষণীয় পরিবর্তন ঘটেছে। দেশের প্রধান দুটি রাজনৈতিক দলÑআওয়ামী লীগ ও বিএনপি তাদের সংগঠনে ত্যাগী ও জনসম্পৃক্ত নেতাকর্মীদের জায়গায় স্থান করে নিয়েছে তথাকথিত ‘হাইব্রিড’ নেতৃত্ব। এই নেতারা আদর্শ, আন্দোলন কিংবা জনগণের আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে সম্পৃক্ত নয়; বরং অর্থনৈতিক প্রভাব, লবিং এবং সুবিধাবাদী কৌশলের মাধ্যমে দলীয় নেতৃত্বের শীর্ষে উঠে এসেছেন।

অনেক সময় দেখা যায়, দলের কমিটি গঠনের আগে গুরুত্বপূর্ণ পদ পাওয়ার জন্য নেতাকর্মীরা অর্থ দিয়ে ভোট কেনেন। যারা পদ কেনেন, তাদের লক্ষ্য থাকে বিনিয়োগের সুদে আসলে ফেরত পাওয়া। তাই দল ক্ষমতায় আসার পর তারা নানা অনৈতিক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়েন চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, দখলবাজি—এমনকি খুন-ধর্ষণের মতো ভয়াবহ অপরাধও সংঘটিত হয়। এ অপকর্ম শুধু দলকে কলুষিত করে না, বরং দলের অভ্যন্তরে মারাত্মক কোন্দল, দ্বন্দ্ব ও বিভাজন সৃষ্টি করে।

এ পরিস্থিতিতে ত্যাগী ও জনগণের সঙ্গে নিবিড়ভাবে যুক্ত নেতারা প্রান্তিক হয়ে পড়েন বা দল থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যান। ফলে সংগঠনের মূল শেকড় জনগণের সঙ্গে সংযোগ ভেঙে পড়ে। দল একসময় জনবিচ্ছিন্ন হয়ে যায় এবং জনগণ আর সেই দলকে তাদের মনে করে না। দলের নেতৃত্ব তখন গঠনমূলক সমালোচনা বা মতবিরোধ সহ্য করতে পারে না। নেতৃত্বের চারপাশে ঘিরে থাকে সুবিধাবাদী ‘জি, হ্যাঁ-মানুষ’। বিরুদ্ধ মত দমন করা হয়। গণতন্ত্রের চর্চা স্তব্ধ হয়ে যায়। একপর্যায়ে দলটি স্বৈরতান্ত্রিক মানসিকতা নিয়ে বিকশিত হয় এবং শেষ পর্যন্ত স্বৈরাচারে পরিণত হয়। এর জীবন্ত উদাহরণ হলো আওয়ামী লীগ।

একজন ত্যাগী, আদর্শবান ও জনগণের সঙ্গে যুক্ত নেতা দলের ক্ষতি হয় এমন কাজ থেকে সজ্ঞানে বিরত থাকেন। তার রাজনৈতিক নৈতিকতা, ত্যাগ ও জনগণের প্রতি দায়বদ্ধতা দলকে সঠিক পথে রাখতে সক্ষম হয়। তিনি জানেন, আদর্শচ্যুতি মানেই জনআস্থার পতন, আর জনআস্থার পতন মানেই একটি রাজনৈতিক দলের অস্তিত্ব সংকট।

চলমান রাজনীতির বাস্তবতায় দলীয় কোন্দল, সংঘর্ষ, এমনকি হত্যার ঘটনাগুলো কেবল ক্ষমতার দ্বন্দ্ব নয়; বরং গভীর ষড়যন্ত্রের অংশও হতে পারে। বিশেষ করে বিএনপির মতো বৃহৎ রাজনৈতিক দলে নেতাকর্মীদের মধ্যে অস্থিরতা, হিংসা ও অভ্যন্তরীণ বিভক্তি নিয়ে প্রশ্ন ওঠে—এই দ্বন্দ্ব কি শুধুই ব্যক্তি-স্বার্থের সংঘর্ষ, নাকি এর পেছনে কোনো অদৃশ্য পরিচালনাকারী শক্তি সক্রিয়? বর্তমানে বিএনপির মধ্যে যেসব হাইব্রিড নেতাকর্মী প্রভাবশালী, তাদের আচরণ, পদলিপ্সা ও নৈতিক স্খলন অনেক সময় এমন সব কাণ্ড ঘটায়, যা দলকে ধ্বংসের মুখে ঠেলে দিচ্ছে। এ অবস্থায় ভেবে দেখা প্রয়োজন তারা কি শুধুই সুবিধাবাদী, নাকি কোনো অদৃশ্য শক্তির ছায়ায় পরিচালিত হয়ে সংগঠনের ভিত দুর্বল করছে?

বাংলাদেশের রাজনীতিতে এখন সময় এসেছে আত্মসমালোচনার। রাজনীতিকে যদি সত্যিকার অর্থে গণমানুষের কল্যাণের পথ হিসেবে দেখতে হয়, তাহলে হাইব্রিড নেতৃত্বের জায়গায় ফিরিয়ে আনতে হবে ত্যাগ, আদর্শ ও জনসম্পৃক্ত নেতৃত্বকে। নইলে রাজনৈতিক দলগুলো শুধু তাদের নিজস্ব পতনই ডেকে আনবে না, দেশের গণতন্ত্রকেও গভীর সংকটে ফেলবে। বিএনপি বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দল। দীর্ঘদিন ধরে গণতন্ত্র, মানবাধিকার ও জনগণের অধিকারের জন্য সংগ্রাম করেছে। দলে কিছু ত্রুটি থাকলেও তা সংশোধনে কাজ করছে এবং সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আরও দায়িত্বশীল হচ্ছে। দেশের রাজনীতিতে বিএনপির অবদান অবিস্মরণীয়।

গণঅভ্যুত্থানের পর থেকে বিএনপি জনগণের প্রত্যাশা পূরণে সবচেয়ে দৃঢ় ভূমিকা নিয়েছে। রাজনৈতিক প্রজ্ঞায় দল অন্যদের চেয়ে এগিয়ে রয়েছে। এর ফলে বিএনপির বিরুদ্ধে পরিকল্পিত অপপ্রচার, মিডিয়া ট্রায়াল ও সামাজিক বুলিং চলছে। মতভেদ থাকতেই পারে, কিন্তু কোনো দলকে পরিকল্পিতভাবে হেয় করা বা রাজনীতিকে অবজ্ঞা করা গ্রহণযোগ্য নয়। বিএনপি দেশের গণতন্ত্র রক্ষায় এক অবিস্মরণীয় শক্তি।

আওয়ামী লীগ অনেক আগেই রাজনীতিতে জনবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। বর্তমানে বিএনপিকে পরিকল্পিতভাবে কালিমালিপ্ত করা হচ্ছে। অন্যদিকে দেশের ছোট রাজনৈতিক দলগুলো এখনো শক্তিশালী সংগঠন ও বিকল্প নেতৃত্ব গড়ে তুলতে পারেনি। ফলে দুই বৃহৎ দলকে নিষ্ক্রিয় বা দমন করলে দেশের রাজনীতিতে শূন্যতা তৈরি হবে, যা অনির্বাচিত কর্তৃত্বের উত্থান ঘটাবে। বৈশ্বিক পরাশক্তিরাও চায় একটি ‘পরনির্ভরশীল’ বাংলাদেশ, যেখানে গণতন্ত্র কাগজে-কলমে থাকবে, কিন্তু নীতিনির্ধারণ হবে কিছু গোষ্ঠীর ইচ্ছায়। তারা রাজনীতিকে দুর্বল করে, নেতৃত্বশূন্য রাষ্ট্র গড়ে তুলতে চায়। রাজনৈতিক অস্থিরতা ও একদলীয় শাসনের সুযোগে তারা বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ও নিরাপত্তা স্বার্থে প্রভাব বিস্তার করতে চাইছে।

বাংলাদেশের রাজনীতিতে আন্তর্জাতিক হস্তক্ষেপ নতুন নয়; এটি বহুদিনের বাস্তবতা। বিশেষত যুক্তরাষ্ট্র ও ভারত সময়-সময়ে সরাসরি বা পরোক্ষভাবে রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করেছে, গণতন্ত্র, নিরাপত্তা বা অর্থনৈতিক সহায়তার মোড়কে। যেমন, মিয়ানমারে ‘মানবিক করিডোর’ কিংবা চট্টগ্রাম বন্দর নিয়ে চাপ এসব সুপরিকল্পিত কূটনৈতিক কৌশলের অংশ।

বর্তমান রাজনৈতিক সংকট শুধু অভ্যন্তরীণ নয়; এর পেছনে রয়েছে বৈশ্বিক শক্তির কৌশলগত স্বার্থ ও দ্বৈত নীতি। এ প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের প্রয়োজন সুসংগঠিত, সাহসী, নিরপেক্ষ ও দূরদর্শী কূটনৈতিক অবস্থান এবং একটি ঐক্যবদ্ধ জাতীয় চেতনা, যা বিদেশি চাপের মুখেও স্বাধীন-সার্বভৌম রাজনৈতিক ভারসাম্য বজায় রাখতে সক্ষম।

১৯৭২ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাস শুধু উত্থান-পতনের নয়; বরং সংগ্রাম, প্রত্যাশা ও শিক্ষার এক ধারাবাহিকতা। যদিও অনেক ভুল হয়েছে, দেশ বারবার সংকটে পড়েছে, তবু এই জাতি সংকট মোকাবিলা করে এগিয়ে চলেছে।

বিএনপি বাংলাদেশের জনগণের আশা, আকাঙ্ক্ষা ও অধিকার রক্ষার প্রতীক। বিএনপির বিরুদ্ধে যত ষড়যন্ত্রই হোক না কেন, তা কখনোই সফল হবে না। কারণ জনগণই বিএনপির মূল ভিত্তি, আর এই জনগণই চক্রান্তকারীদের দাঁতভাঙা জবাব দেবে। ইতিহাস বারবার প্রমাণ করেছে—যেখানে জনগণের শক্তি, সেখানে কোনো ষড়যন্ত্রের জায়গা নেই। বিএনপির বিরুদ্ধে চক্রান্ত মানেই জনগণের বিরুদ্ধে, গণতন্ত্রের বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়া, আর সেই চক্রান্ত কখনোই টিকবে না।

গণতন্ত্রের ভিত্তি হলো সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ এবং সময়মতো নির্বাচন, যা জনগণের মতামত প্রতিফলিত করে। জনগণ তাদের অধিকার প্রয়োগের জন্য প্রস্তুত; এখন প্রয়োজন সরকারের উদ্যোগ। নির্বাচনের বিকল্প নেই, এটি অবশ্যই জরুরি। যেখানে রাষ্ট্রের সব ক্ষমতার মালিক জনগণ এবং গণতন্ত্রই শেষ কথা।

লেখক: সাংবাদিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক, সাংগঠনিক সম্পাদক, ডিইউজে

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা হলেই জাতি নিরাপদ বাংলাদেশ পাবে : দেলাওয়ার হোসেন

ঢাকায় আরও অটোরিকশার অনুমতি দিতে চালকদের সড়ক অবরোধ 

জুলাই গণঅভ্যুত্থানের বর্ষপূর্তি উদযাপনে ঢাবিতে নানা আয়োজন 

ময়লাযুক্ত জলাশয়ে মিলল নিখোঁজ তিন শিশুর মরদেহ

স্বেচ্ছাসেবক দলের কর্মসূচি ঘোষণা

‘হানির নিচে সব ডুবি গেছে, ঘরে যাইতাম কেন্নে’

প্রধান বিচারপতি নিয়োগে প্যানেল পদ্ধতির প্রস্তাব এবি পার্টির

মেট্রোরেলের ঢাবি স্টেশন বন্ধ থাকবে সোমবার

অন্তিম মুহূর্তে তৃষ্ণার গোলে নাটকীয় জয় বাংলাদেশের!

চাঁদার টাকাসহ বিএনপি নেতাকে হাতেনাতে ধরল সেনাবাহিনী

১০

ডিম সেদ্ধ না ভাজা, কোনটি বেশি স্বাস্থ্যকর?

১১

রোটারি ক্লাব চিটাগং এরিস্টোক্রেটের নতুন কমিটি

১২

৩৯ প্রভাবশালীর দখলে পাউবোর ৩২০ কোটি টাকার জমি

১৩

দীর্ঘ খরা কাটিয়ে অবশেষে লিটন দাসের ব্যাটে আলো

১৪

বন্যা পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণে বিএনপির ‘মনিটরিং সেল’ 

১৫

বাইকারের জীবন রক্ষার প্রতীক ‘এএইচও’ বাংলাদেশে বাধ্যতামূলক হবে কবে?

১৬

শাজাহান সিরাজের পঞ্চম মৃত্যুবার্ষিকী সোমবার

১৭

দাবি আদায়ে সচিবালয় অভিমুখে তথ্য আপাদের পদযাত্রা ও স্মারকলিপি

১৮

মিয়ানমারে উলফার ৪ ঘাঁটিতে ভারতীয় সেনাদের ব্যাপক হামলার অভিযোগ

১৯

এমপি হচ্ছেন হর্ষবর্ধন শ্রিংলা

২০
X