চট্টগ্রাম নগরের হালিশহর-পাহাড়তলী থানা সংলগ্ন সাগরিকা এলাকায় পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) প্রায় ৩২০ কোটি টাকা মূল্যের ৩২ একর জমি অবৈধভাবে দখল করে রেখেছেন আওয়ামী লীগ নেতাসহ প্রভাবশালী ৩৯ ব্যক্তি।
১৬ বছর ধরে কাভার্ডভ্যান ইয়ার্ড, এক্সকাভেটর ডিপো, ডেইরি ফার্ম, গাড়ির গ্যারেজ ভাড়া দিয়ে সেখান থেকে তারা বছরে প্রায় শত কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
অবশেষে এসব জমি উদ্ধারে উচ্ছেদ অভিযান শুরু করেছে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন। ফলে ১৬ বছর পর নিজের জমি ফিরে পেতে যাচ্ছে পাউবো।
রোববার (১৩ জুলাই) সকাল সাড়ে ১০টার দিকে তিন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের নেতৃত্বে জমি উদ্ধারে উচ্ছেদ অভিযান শুরু করে জেলা প্রশাসন।
অভিযানে নেতৃত্ব দেন কাট্টলী ভূমি সার্কেলের সহকারী কমিশনার হুছাইন মুহাম্মদ, পতেঙ্গা ভূমি সার্কেলের সহকারী কমিশনার ফারিস্তা করিম এবং জেলা প্রশাসন কার্যালয়ের সহকারী কমিশনার মো. ফজলুল হাসান।
বিষয়টি নিশ্চিত করে কাট্টলী সার্কেল ভূমি অফিসের সহকারী কমিশনার হুছাইন মুহাম্মদ কালবেলাকে বলেন, ‘বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের আওতাধীন বিভিন্ন প্রকল্প এলাকার সরকারি জমি দীর্ঘদিন ধরে অবৈধভাবে দখল করা হয়েছে। এসব জায়গায় উচ্ছেদ অভিযান আজকে (রোববার) সকাল সাড়ে ১০টা থেকে শুরু হয়েছে। আমরা সাগরিকা থেকে এ অভিযান শুরু করেছি। জায়গাটি বেশ বড়। তাই এ উচ্ছেদ অভিযান টানা তিন দিন অর্থাৎ ১৫ জুলাই পর্যন্ত চলবে।’
অভিযান সম্পর্কে পানি উন্নয়ন বোর্ড চট্টগ্রাম বিভাগ-১-এর নির্বাহী প্রকৌশলী শওকত ইবনে সাহীদ কালবেলাকে বলেন, ‘দীর্ঘদিন ধরে দখলে থাকা এসব জমি উচ্ছেদে রোববার থেকে অভিযান শুরু করেছি। অনেকেই উচ্ছেদ ঠেকাতে চেষ্টা করেছেন, কিন্তু সরকার অবৈধ দখলদারদের উচ্ছেদে কঠোর অবস্থানে রয়েছে। আজকের অভিযানে জেলা প্রশাসন, পুলিশ, সেনাবাহিনীসহ সরকারি বিভিন্ন সংস্থার সমন্বয়ে তিন ম্যাজিস্ট্রেট কাজ করছেন। স্থাপনা উচ্ছেদের মাধ্যমে জমিগুলো দখলমুক্ত করে সেখানে পিলার ও কাঁটাতার দিয়ে সীমানা নির্ধারণ করা হবে এবং বনায়ন কার্যক্রম শুরু করা হবে।’
যাদের দখলে সরকারি জায়গাগুলো : অবৈধ দখলদারদের মধ্যে আওয়ামী লীগের সাবেক এমপি দিদারুল আলমের দখলে থাকা ৭ একর জায়গাজুড়ে কাভার্ডভ্যান ও এক্সকাভেটর ইয়ার্ড রয়েছে। চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের (চসিক) সাবেক প্যানেল মেয়র নিছার উদ্দিন আহম্মেদ মঞ্জুর দখলে রয়েছে পাউবোর আড়াই একর জায়গা।
আওয়ামী লীগ নেতা মঞ্জু দশমিক ৪২ একর জায়গা বছরে ১৫ লাখ টাকায় মুনছুর মিস্ত্রির কাছে কাভার্ডভ্যান ইয়ার্ড, দশমিক ৩৮ একরের আরেকটি জায়গা আরিফুর রহমান রুবেলের কাছে ১৮ লাখ টাকায়, দশমিক ৫৪ একরের আরেকটি জায়গা আব্দুল মমিনের কাছে ২৪ লাখ টাকায় ভাড়া এবং নিজে দশমিক ৮৫ একর জায়গা দখল করে রেখেছেন। একইভাবে চসিকের সাবেক কাউন্সিলর আবুল হাসেম দশমিক ০১৬২ একর জায়গা ট্রলি ডিপো ভাড়া দিয়ে বছরে ১৮ লাখ টাকা আদায় করছেন।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের তথ্য বলছে, ঠিক এভাবেই ৩৯ প্রভাবশালী ‘ভূমিখেকো’র পেটে চলে গেছে চট্টগ্রামের হালিশহর, পাহাড়তলী এলাকার পাউবোর ৩২০ কোটি টাকার ৩২ একর জমি। ১৯৭২ সালে শহর রক্ষা বাঁধের জন্য জায়গাগুলো অধিগ্রহণ করেছিল পাউবো। ১৬ বছর ধরে কাভার্ডভ্যান ইয়ার্ড, এক্সকাভেটর ডিপো, ডেইরি ফার্ম, গাড়ির গ্যারেজ ভাড়া দিয়ে বছরে প্রায় শত কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে ভূমিখেকোরা।
আরও অভিযোগ রয়েছে, চট্টগ্রাম নগরের দক্ষিণ কাট্টলী এলাকায় পাউবোর দুই একর জায়গা ১৬ বছর ধরে দখল করে ১২টি আধাপাকা ঘর বানিয়ে এরশাদ উদ্দিন বছরে ১৫ লাখ ভাড়া নিচ্ছেন। তার পাশে গোলাপুর রহমানের দখলে আছে দুই একর জায়গা, সেখানে কাভার্ডভ্যান ইয়ার্ড ভাড়া দিয়ে বছরে ৪৫ লাখ টাকা আয় করছেন তিনি। দক্ষিণ কাট্টলীতে দশমিক ৪৯ একর জমি আকরাম সিদ্দিক চৌধুরী এক্সকাভেটর ইয়ার্ড ভাড়া দিয়ে বছরে ১২ লাখ টাকা ভাড়া নেন। হুমায়ুন কবির চৌধুরী দশমিক ৫০ একর দখল করে কাভার্ডভ্যান ইয়ার্ড, নুরুল হুদা চৌধুরী ৭ একর দখল করে কাভার্ডভ্যান, ছালাউদ্দিন ইউছুফ ৪ একর জমি দখল করে মিনি স্টেডিয়াম ও ইয়ার্ড ব্যবসা করছেন।
এ ছাড়া আরাফাত হোসেন, মো. জুয়েল, মো. মোশারফ, কোরবান আলী, মোহাম্মদ আলী, লিটন মিয়া, ইলিয়াছ মিস্ত্রী, আবদুল জলিল, জামাল আহম্মদ, মো. রনি, মো. জনি, মো. নাছির, মো. হোসেন, মো. মনির, মো. ওয়াহিদ, নিজাম উদ্দিন মামুন, ওয়াহিদ, ওমর ফারুক, মিজানুর রহমান, মো. কামরুজ্জামান, জাহাঙ্গীর ও মীর আহাম্মদ, জাকের মিস্ত্রী, জানে আলম বুলু ও হাজি মো. শাহজাহানরা মিলে ৩২ একর জায়গা দখল করে স্থাপনা তৈরি করে ভাড়া ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছেন। এসব সরকারি জমিতে ১৩টি বিশাল কাভার্ডভ্যান ইয়ার্ড, ১০টি গাড়ির গ্যারেজ ডিপো, তিনটি ট্রলি ইয়ার্ড, তিনটি ডেইরি ফার্ম ও চারটি কলোনি গড়ে উঠেছে। এ ছাড়া প্রতিষ্ঠানের মধ্যে রয়েছে মোস্তফা হাকিম গ্রুপসহ আরও কয়েকটি প্রতিষ্ঠান।
তবে মোস্তফা হাকিম গ্রুপের পরিচালক মোহাম্মদ সরওয়ার আলম কালবেলাকে বলেন, সাগরপাড়ে হোসনে আরা মনজুর ওয়েলফেয়ার ট্রাস্টের অর্থায়নে স্টেডিয়াম গড়ে তোলা হয়েছিল। স্টেডিয়ামটির দৈর্ঘ্য ছিল ৩৩০ ফুট ও প্রস্থ ২০০ ফুট। ২০২২ সালের ১৯ অক্টোবর শেখ রাসেলের জন্মদিনে স্টেডিয়ামটি উদ্বোধন করা হয়। স্টেডিয়ামের পেছনের অংশ আমার আত্মীয়ের আরএসভুক্ত জায়গা। আর সামনে তাদের (পানি উন্নয়ন বোর্ডের) কিছু জায়গা দখলে ছিল। ওদের যখন দরকার হয়েছে নিয়ে নিয়েছে (উচ্ছেদ অভিযান চালানো হয়েছে)। কিন্তু এর আগ পর্যন্ত পেছনের জায়গার মালিক হিসেবে এসব জায়গা দখলে রাখা হয়েছিল। তবে এসব বিষয় আমি দেখি না, এ কারণে আমাদের সেখানে কতটুকু জায়গা ছিল, তা আইডিয়া নেই।
দখলে থাকা আকরাম সিদ্দিক চৌধুরী জানান, ‘এগুলো আমাদের পূর্বপুরুষদের জায়গা। পাউবো কিছু জায়গা অধিগ্রহণ করেছিল। কিন্তু আমরা সব টাকা এখনো পাইনি। ফলে দখলে থাকা সবই আমাদের জায়গা।’
জমি দখল করে রাখা এসএ করপোরেশনের মো. মোশাররফ বলেন, ‘এগুলো আমাদের জায়গা। এখানে কোনো সরকারি জায়গা নেই। আমার জায়গা আমি ভাড়া দিয়েছি।’
হাজি মো. শাহাজাহান বলেন, ‘পাউবো বাঁধ করার জন্য আমাদের পূর্বপুরুষদের জমি অধিগ্রহণ করে। কিন্তু তারা বাঁধ না দেওয়ায় এমনিতে খালি পড়ে থাকা জমিতে রেস্টুরেন্ট ব্যবসা করছি।’
পাউবো চট্টগ্রাম বিভাগ-১ এর নির্বাহী প্রকৌশলী শওকত ইবনে সাহীদ জানান, শহর রক্ষা বাঁধ করতে সত্তরের দশকে ২ হাজার ৬৪২ একর জমি অধিগ্রহণ করা হয়েছিল। কিছু অংশ বাঁধ কাম সড়ক হলেও অধিকাংশ জায়গাজমি শ্রেণিতে রয়ে গেছে। সেই জমিতে ৩৯ দখলদার কাভার্ডভ্যান ইয়ার্ডসহ নানা স্থাপনা তৈরি করে ভাড়া দিয়ে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছিলেন।
মন্তব্য করুন