ড. দিলারা রহমান
প্রকাশ : ১৭ জুলাই ২০২৫, ১২:০০ এএম
আপডেট : ১৭ জুলাই ২০২৫, ০৭:৪৪ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

বর্ষা বিপ্লবে নারীর এগিয়ে যাওয়ার গল্প

বর্ষা বিপ্লবে নারীর এগিয়ে যাওয়ার গল্প

গ্রিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানী অ্যারিস্টটল বিপ্লবকে একটি দার্শনিক ভিত্তির ওপর দাঁড় করিয়েছিলেন, রাজনৈতিক আলোচনায় যা Philosophy of Sedition হিসেবে সমাদৃত। অ্যারিস্টটলের মতে, Sedition শব্দের অর্থ হলো—সম্মিলিতভাবে জনগণের সেসব বিক্ষুব্ধ কার্যাবলি, যা রাজনৈতিক উদ্দেশ্য সাধনের জন্য, বিশেষ করে সরকার উচ্ছেদ এবং সংবিধান পরিবর্তনের জন্য পরিচালিত হয়। অ্যারিস্টটল বিপ্লবকে সংবিধান সংশোধনের জন্য বৈধ পন্থা হিসেবে দেখেছেন। তিনি এ প্রসঙ্গে যুক্তি দেখিয়েছেন এ বলে যে, একটি সরকার যখন তার স্বাভাবিক ও শুদ্ধ কাজের প্রকৃতি লঙ্ঘন করে বিকৃত হয়ে যায়, রাষ্ট্রে বৈষম্যমূলক অবস্থা তৈরি করে এবং জনগণের আকাঙ্ক্ষার প্রতি অবজ্ঞা প্রদর্শন করে, তখন অবশ্যই জনগণের নৈতিক অধিকার থাকে সে সরকারকে উচ্ছেদ সাধনের কার্যাবলিতে অংশগ্রহণ করার। অ্যারিস্টটলের Philosophy of Sedition-কে ব্যাখ্যা করতে গিয়ে আর্নেস্ট বার্কার তার বিখ্যাত গ্রন্থ ‘The Political Thought of Plato and Aristotle’-এ বলেছেন যে, অ্যারিস্টটল মুনাফা, বস্তুগত দ্রব্যাদি, সম্মান ও ন্যায্যতা প্রাপ্তি প্রভৃতি কারণে বিপ্লব হতে পারে বলে মত দিয়ে থাকলেও অন্যায্যতাকে তিনি সবচেয়ে বেশি সংবেদনশীল কারণ হিসেবে দেখেছেন। অর্থাৎ বিপ্লবের জন্য কারণ হিসেবে অ্যারিস্টটল দরিদ্র অবস্থা থেকে উত্তরণ, ঋণ থেকে মুক্তি, অর্থনৈতিকভাবে লাভজনক বিষয়ের চেয়ে ‘Sense of Political Injustice’ এবং ‘Dishonour’-এর ওপর গুরুত্ব আরোপ করেছেন। অতিসম্প্রতি বাংলাদেশের জুলাই-আগস্টের গণজাগরণ বা শ্রাবণ বিপ্লব অ্যারিস্টটলের বর্ণনানুযায়ী Sense of Political Injustice মধ্য থেকে ক্রিয়াজাত বিপ্লবের একটি চমৎকার উদাহরণ।

বিগত সাড়ে ১৫ বছর আওয়ামী লীগ সরকার এমন একটি কর্তৃত্ববাদী শাসনব্যবস্থা বাংলাদেশের জনগোষ্ঠীর ওপর চাপিয়ে দিয়েছিল, যা মানুষের মধ্যে Sense of Political Injustice-কে ক্রমান্বয়ে তীব্রতর করেছিল। ফলে ২০২৪-এর জুন থেকে জন্ম নেওয়া শিক্ষার্থীদের সরকারি চাকরিতে প্রবেশের প্রচলিত কোটা ব্যবস্থার সংস্কারের মতো একটি অরাজনৈতিক দাবি বাংলাদেশের সব পেশাজীবী এবং শ্রেণির মানুষকে সম্পৃক্ত করে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে পরিণত হয়েছে এবং সরকার পতনের সফল কর্মসূচির মধ্য দিয়ে এর পরিসমাপ্তি ঘটেছে। গত সাড়ে ১৫ বছরে সব স্তরে দুর্নীতি, জবাবদিহির অভাব, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা হরণ, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা না করা, নির্বাচনহীন শাসনব্যবস্থা কায়েম প্রভৃতির মাধ্যমে শেখ হাসিনা সরকার ক্রমেই স্বৈরশাসন প্রতিষ্ঠা করে জনগণের ওপর একটি বিকৃত শাসনতন্ত্র চাপিয়ে দিয়েছিল। এ প্রসঙ্গে দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক অপূর্বানন্দ ঝা তাই যথার্থই বলেছেন, ‘কেবল ভাত-রুটি দিয়ে আপনি আমার স্বাধীনতা কেড়ে নিতে পারেন না। শেখ হাসিনা ১৫ বছর ধরে সেটাই করে গিয়েছেন। নির্বাচনকে একটি তামাশা বানিয়েছেন আর আজকের যে তরুণ রাজপথে এসেছে, সে কখনোই তার ভোটাধিকার প্রয়োগের সুযোগ পায়নি।’

শুধু ভোটাধিকার হরণ নয়; সরকার বিগত বছরগুলোতে সব রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের আইনগত কাঠামো প্রায় ভেঙে দিয়েছিল। এর মধ্যে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো ছিল শীর্ষে। ৩ আগস্ট দৈনিক বণিক বার্তার একটি প্রতিবেদন থেকে জানা যায় যে, গত ৩০ জুন আন্তর্জাতিক মানদণ্ড (বিপিএম ৬) অনুসারে, দেশের রিজার্ভ ছিল ২১.৭৮ বিলিয়ন ডলার এবং ব্যবহারযোগ্য নিট রিজার্ভ ছিল ১৫ বিলিয়ন ডলারেরও কম; যা বিশেষজ্ঞদের মতে, ধারাবাহিকভাবে একটি দেশের অর্থনৈতিক ভঙ্গুরতা নির্দেশ করে। জুলাই-আগস্টের বিপ্লব বা গণজাগরণের মধ্য দিয়ে শেখ হাসিনার সরকারের পতনের পর নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে একটি অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হয়। প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমান এবং কূটনৈতিক প্রতিবেদক রাহিদ এজাজ ড. ইউনূসের একটি সাক্ষাৎকার নিয়েছেন। বাংলাদেশের ভঙ্গুর প্রশাসনিক ও অর্থনৈতিক অবস্থা সম্পর্কে তিনি সে সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ‘ভাঙা হাট। কোনো জিনিস ফাংশন করে না। এক ব্যক্তি পূজার জন্য যা যা লাগে, সে ব্যবস্থাগুলো আছে। ওনার (শেখ হাসিনার) হুকুমে কী কী হয়, ওনার ইচ্ছা পূরণের জন্য সব ব্যবস্থা। রাষ্ট্রের ইচ্ছা পূরণের জন্য তাদের কোনো ব্যস্ততা নেই। কাজেই এরকম একটা ভাঙাচোরা জনপ্রশাসন নিয়ে আমাদের যাত্রা শুরু করতে হয়েছে।’

সুতরাং বলার অপেক্ষা রাখে না যে, জুলাই-আগস্টের সফল গণজাগরণ ছিল সত্যিকার অর্থে একটি বিকৃত শাসনব্যবস্থার প্রতি তীব্র প্রতিবাদ। অতিমাত্রায় কর্তৃত্ববাদী শাসন প্রতিষ্ঠা করে প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা স্বয়ং এই বিপ্লবের বা গণজাগরণের নৈতিক ভিত্তি তৈরি করে দিয়েছিলেন। আমরা যদি বুদ্ধিবৃত্তিক পরিসরে এ গণজাগরণকে মূল্যায়ন করি, তাহলে সফল এ আন্দোলনের কতগুলো স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য দেখতে পাই। যেমন—

প্রথমত, এ আন্দোলন ছিল অ্যারিস্টটলের বর্ণনাকৃত Philosophy of Sedition-এর এক চমৎকার উদাহরণ।

দ্বিতীয়ত, এ আন্দোলনের সূচনা হয়েছিল শিক্ষার্থীদের মধ্য থেকে সম্পূর্ণ অরাজনৈতিক একটি বিষয় কেন্দ্র করে।

তৃতীয়ত, কোনো রাজনৈতিক দলের প্রত্যক্ষ নেতৃত্ব ছাড়া এ আন্দোলন ক্রমেই তীব্রতর হয়ে সাধারণ জনগোষ্ঠীর মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছিল।

চতুর্থত, নারীদের অংশগ্রহণ বিশেষ করে নারী শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণ এ আন্দোলনকে একটি ভিন্নমাত্রা দিয়েছিল, যা সারা বিশ্বে প্রায় বিরল একটি ঘটনা।

আলোচ্য প্রবন্ধে জুলাই-আগস্টের সফল গণজাগরণে নারীদের অংশগ্রহণের বিষয়টিকে মূল প্রতিপাদ্য করা হয়েছে। বাংলাদেশের নারী উন্নয়ন ও তাদের ক্ষমতায়নের প্রেক্ষাপটে এবারকার আন্দোলনে তাদের সম্পৃক্ততা, নিশ্চয়ই সমতাভিত্তিক রাষ্ট্র গঠনের ইঙ্গিত বহন করে। সংগত কারণেই এ প্রবন্ধটিতে এটিকে আলোচনার বিষয় হিসেবে বেছে নেওয়া হয়েছে এবং এর পেছনের কারণগুলো খোঁজার চেষ্টা করা হয়েছে। তথ্যের উৎস হিসেবে প্রাথমিক ও দ্বিতীয় বা গৌণ দুটো উৎসই ব্যবহার করা হয়েছে। আন্দোলন চলাকালে বিভিন্ন প্রিন্টিং ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় প্রচারিত নারীদের অংশগ্রহণের তথ্য, ভিডিও ও বক্তব্য এবং আন্দোলন পরবর্তী সময়ে বিভিন্ন মিডিয়ায় প্রচারিত হওয়া নারী সমন্বয়ক ও নারী অংশগ্রহণকারীদের সাক্ষাৎকার গৌণ উৎস হিসেবে এবং শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত নারী শিক্ষার্থীদের (যারা আন্দোলনে অংশ নিয়েছিল) নিয়ে একটি ফোকাস গ্রুপ ডিসকাশন করা হয়েছে, যা প্রাথমিক তথ্য হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। তথ্য প্রাপ্তির সুবিধার জন্য প্রাথমিক তথ্যের উৎস হিসেবে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়কে বেছে নেওয়া হয়েছে। [চলবে]

লেখক: অধ্যাপক, পলিটিক্যাল স্টাডিজ বিভাগ, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

ঢাকায় বৃষ্টি নিয়ে আবহাওয়া অফিসের নতুন বার্তা

১৯ জুলাই : কী ঘটেছিল ইতিহাসের এই দিনে

শনিবার রাজধানীর যেসব এলাকার মার্কেট বন্ধ

১৯ জুলাই : আজকের নামাজের সময়সূচি

স্ত্রীকে তালাক দিয়ে ২৫ কেজি দুধ দিয়ে গোসল 

সেনাবাহিনীর হাতে ইয়াবাসহ পুলিশ সদস্য আটক 

ইবি ছাত্রের রহস্যজন্যক মৃত্যুর তদন্তের দাবিতে ছাত্রশিবিরের টর্চ মিছিল

বাঙলা কলেজ শিক্ষার্থী শহীদ সাগরের মৃত্যুবার্ষিকী আজ

কেশবপুরে ৩১ দফার প্রচারণায় বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতা অমলেন্দু দাস অপু

মাদ্রাসা টিকে আছে বলেই আমাদের ওপর বিভিন্ন ঝড় ঝাপটা আসে : ধর্ম উপদেষ্টা 

১০

ইউনিভার্সিটি ইনোভেশন হাব স্বপ্ন গড়ার সূতিকাগার

১১

রাজবাড়ী জেলা ছাত্র কল্যাণ পরিষদ বাঙলা কলেজ শাখার কমিটি গঠন

১২

গণঅভ্যুত্থান মেহনতি মানুষের কষ্ট লাঘব করেনি : সাইফুল হক 

১৩

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রশিবিরের সাবেক সাধারণ সম্পাদকের ফেসবুক পোস্ট

১৪

মাদকাসক্ত যুবককে পিটিয়ে হত্যা করল মা ও ভাই

১৫

এবার পুলিশের সামনেই চাপাতি দেখিয়ে ছিনতাইয়ের ভিডিও ভাইরাল 

১৬

বৃষ্টির দেখা নেই, আমন চাষে বিপাকে কৃষক

১৭

প্রাথমিকে বৃত্তি পরীক্ষায় কারা সুযোগ পাবে, বাছাই হবে যেভাবে

১৮

হাসপাতালের লিফটের নিচে পড়ে ছিল রোগীর অর্ধগলিত লাশ

১৯

পরিবারের সবাই ইয়াবা বিক্রেতা, অতঃপর…

২০
X