প্রযুক্তির অভাবনীয় সাফল্যে সময়ের দ্রুত পরিবর্তনে বৈশ্বিক বাজার ব্যবস্থাপনায় এসেছে নতুন আঙ্গিক। আজকের তরুণ ‘নিজের বিজনেস শুরু করেছি’ না বলে ‘নিজের স্টার্টআপ শুরু করেছি’ বলতে পছন্দ করে। তরুণ মেধা নিত্যনতুন উদ্ভাবনের দিকে ঝুঁকছে। কিন্তু উদ্ভাবনকে ব্যবসা হিসেবে পরিণত করতে গবেষণার প্রয়োজন আছে। এ প্রয়োজনকে সামনে রেখে আইসিটি বিভাগের অধীন বাংলাদেশ হাই-টেক পার্ক কর্তৃপক্ষের ‘ডিজিটাল উদ্যোক্তা এবং উদ্ভাবন ইকোসিস্টেম উন্নয়ন প্রকল্পের (DEIED) মাধ্যমে দেশের দশটি বিশ্ববিদ্যালয়ে চালু করেছে দশটি স্বপ্ন গড়ার সূতিকাগার- ইউনিভার্সিটি ইনোভেশন হাব।
এখানে নেই সাদা অ্যাসিড আর রিঅ্যাকশন টিউব, নেই কাচের বোতলে ভরা রাসায়নিক দ্রব্য। এখানে যা আছে, তা হলো চিন্তা, কল্পনার সমন্বয়ে গড়ে ওঠা প্রযুক্তির রসায়ন চর্চা।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট), বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (শাবিপ্রবি), রাজশাহী প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (রুয়েট), গোপালগঞ্জ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, বরেন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়, ইউনাইটেড ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি (UIU) এবং ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়- এই দশটি বিশ্ববিদ্যালয়ে শুরু হওয়া এইসব ইনোভেশন হাবে তরুণরা কেবল পড়বে না, নিজের আইডিয়াকে বাস্তবে পরিণত করবে হাতে-কলমে। আগে ক্লাস শেষে যখন চায়ের দোকানে এক কাপ চা নিয়ে বন্ধুদের সঙ্গে নিজের বিজনেস আইডিয়া নিয়ে আলোচনায় কটাক্ষের শিকার হতো, এখন সেই আইডিয়াকে বাস্তবে রূপ দিতে তারুণ্য তার সহপাঠী বন্ধুদের সাথে নিয়ে ইউনিভার্সিটি ইনোভেশন হাবে প্রশিক্ষণ নিচ্ছে- বিজনেস মডেল, ব্রান্ডিং, ভেলুয়েশন-সহ অর্জন করছে ব্যবসার মৌলিক জ্ঞান এবং তাদের আইডিয়াকে বাস্তবে রূপায়নের জন্য তৈরি করছে প্রোটোটাইপসহ বাজার উপযোগী ব্যবসা।
এই প্রশিক্ষণ কার্যক্রমে শিক্ষার্থীরা নির্দিষ্ট সময়ব্যাপী দলবদ্ধভাবে অংশ নিচ্ছে, যেটি ‘কোহর্ট’ নামে পরিচিত। প্রতিটি কোহর্টে নির্দিষ্ট সংখ্যক টিম একটি নির্দিষ্ট সময়জুড়ে ধারাবাহিকভাবে প্রশিক্ষণ, মেন্টরিং এবং প্রজেক্ট ডেভেলপমেন্টে অংশগ্রহণ করে। এ পর্যন্ত ৩০টি কোহর্ট সফলভাবে সম্পন্ন হয়েছে, যেখানে ৩৫৬টি টিমে ১৪৭০ জন অংশগ্রহণকারী যুক্ত ছিলেন। বর্তমানে ২১টি কোহর্ট চলমান, যেখানে ২৫৮টি টিমে ১০৮৩ জন শিক্ষার্থী অংশ নিচ্ছেন। মোট ৬০টি কোহর্টে প্রায় ৩০০০ জন শিক্ষার্থী ইনোভেশন হাবের অংশ হবে।
এই কোহটে শিক্ষার্থীরা দলগভাবে আবেদন করে এবং সেইসব দলগুলোর মধ্য থেকে যাচাই বাছাই এর মাধ্যমে সম্ভাবনাময় দলগুলোকে নির্বাচন করা হয়।নির্বাচিত দলগুলোকে ১৪ সপ্তাহব্যাপী একটি কাঠমোগত প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয়, যেখানে তারা তাদের ব্যবসায়িক চিন্তা, বাজার বিশ্লেষণ ও প্রোটোটাইপ তৈরি ইত্যাদি বিষয়ে প্রশিক্ষণ লাভ করে।
প্রশিক্ষণ শেষে অংশগ্রহণকারীরা তাদের প্রোটোটাইপ জুরিদের সামনে উপস্থাপন করে। জুরিদের বিচারিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে উত্তীর্ণ টিমকে প্রি-সিড মানি প্রদান করা হয়।
পরবর্তীতে যেসব দল বিনিয়োগ উপযোগী মডেল তৈরি করতে আগ্রহী বা যাদের আরও প্রশিক্ষণের প্রয়োজন সেই সকল শিক্ষার্থীদের ঢিম ভিত্তিক ১৫ ঘণ্টার কাউন্সেলিং প্রদান করা হয়। এই পর্যায়ে তারা বাজারে প্রবেশের জন্য পণ্য বা সেবা চালু এবং বিনিয়োগ আকর্ষণের লক্ষ্যে নিজেদের প্রস্তুত করে। শেষ পর্যায়ে পুনরায় জুরিদের বিচার প্রক্রিয়ার মাধ্যমে বিজয়ী দল নির্বাচন করা হয়, পরবর্তীতে তাদেরকে সিড মানি প্রদান করা হয়।
প্রি-সিড পর্যায়ের ৩০০টি বিজয়ী টিম এবং সিড পর্যায়ের ১০০টি বিজয়ী টিম নির্বাচিত করা হবে, যারা নিজেদের উদ্ভাবনকে বাস্তবতার পথে এগিয়ে নিচ্ছে এবং দেশের উদ্ভাবন ও স্টার্টআপ ইকোসিস্টেমে নতুন মাত্রা যোগ করছে।
এই ইনোভেশন হাবগুলো শুধুই বসে কাজ করার জায়গা নয়, বরং এখানে আছে লার্নিং কর্নার, যেখানে নতুন প্রযুক্তির ট্রেনিং চলছে প্রতিনিয়ত। এক প্রান্তে মেন্টররা তরুণদের শিখাচ্ছেন কিভাবে একটি আইডিয়াকে প্রজেক্ট প্রপোজালে রূপান্তর করতে হয়, আর অন্য প্রান্তে প্রেজেন্টেশন চলছে ছোট্ট একটা থিয়েটার কক্ষের মতো সাজানো জায়গায় যেখানে নতুন স্টার্টআপরা তাদের পিচ দিচ্ছে। কৃষিতে ড্রোনের ব্যবহার, দূযোর্গ প্রতিরোধে রোবট, ইলেকট্রিক বাইসাইকেল, এআই সার্পোটেড ট্রাফিক সিস্টেম এমনি শত সহস্র উদ্ভাবনী কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে এই ইনোভেশন হাবে।
তরুণদের চোখের সামনে তাদের আইডিয়া ধীরে ধীরে বাস্তব রূপ নিচ্ছে। তার জন্য যা দরকার সবই আছে এখানে। প্রেজেন্টেশনের জন্য আধুনিক প্রজেকশন সিস্টেম, ডিজিটাল বোর্ড, ভিডিও রেকর্ডিংয়ের সুবিধা; আবার আইডিয়াটা যদি সফটওয়্যারের বাইরেও হয় তাহলে প্রটোটাইপ তৈরির জন্য রয়েছে ফ্যাব্রিকেশন ল্যাব।
এই ইনোভেশন হাবে ঢুকলেই যেন কল্পনার চোখে ভবিষ্যত দেখতে পাওয়া যায়। কাচে ঘেরা একটা কক্ষ, যেখানে থ্রিডি প্রিন্টিং হচ্ছে নিঃশব্দে। পাশেই কাটিং ও এনগ্রেভিং মেশিনে তরুণেরা তৈরি করছে তাদের নিজস্ব উদ্ভাবন, কখনো ড্রোনের খুচরো যন্ত্রাংশ, কখনোবা ভিআর গিয়ারস। পুরো জায়গাটা যেন এক মায়াবী জাদুঘর, যেখানে বস্তু নেই চিন্তাই আসল সম্পদ।
এই ইনোভেশন হাবগুলো বিশ্ববিদ্যালয়ভিত্তিক, কিন্তু তাদের উদ্দেশ্য একটাই তরুণদের ভাবতে শেখানো, তৈরি করতে শেখানো এবং নিজেকে নিজের মতো গড়ে তোলার সুযোগ দেওয়া। বিভিন্ন ইনোভেটিভ আইডিয়া নিয়ে ভাবতে শেখানো এবং বিভিন্ন ব্যবসায়ীক মডেল ভ্যালুয়েশন ও ব্র্যান্ডিং সম্পর্কিত জ্ঞান অর্জনের মাধ্যমে নিজেকে ব্যবসায়ী হিসেবে গড়ে তোলার সুযোগ দেয়া।
এখানকার লাইব্রেরিতে রাখা আছে স্টার্টআপ পরিচালনার বই, উদ্ভাবনী ভাবনার ইতিহাস এবং প্রযুক্তি-নির্ভর বিশ্ব অর্থনীতির ভবিষ্যৎ দিকনির্দেশনা। এই ইনোভেশন হাবগুলো হলো ভাবনার পরিচর্যার বাগান।
একটি সফটওয়্যার তৈরির পরিকল্পনা হোক কিংবা সমাজ পরিবর্তনের অ্যাপ; কৃষিকে প্রযুক্তির সঙ্গে যুক্ত করার চিন্তা হোক বা স্বাস্থ্যসেবাকে সবার কাছে সহজলভ্য করার স্টার্টআপ- সব ধরনের উদ্যোগের বীজ বপনের স্থান হতে যাচ্ছে এই ইউনিভার্সিটি ইনোভেশন হাব।
তরুণদের হাতে শুধু বই নয়, এখন আছে কোডিং, মেকানিক্স, মডেলিং এবং আইডিয়ার শাক্তি। পরিবর্তনের এই যুগে উচ্চশিক্ষা এখন শুধু ডিগ্রিতে সীমাবদ্ধ নয়, এরসাথে যুক্ত হয়েছে প্রযুক্তি, গবেষণা আর উদ্যোক্তা ভাবনা। আর তাই এই হাবগুলো শিক্ষার্থীদের জন্য তৈরি করছে উদ্ভাবনের বাস্তব প্ল্যাটফর্ম। একদিকে যেমন আইডিয়া নিয়ে কাজ করার সুযোগ, অন্যদিকে তৈরি হচ্ছে দেশের জন্য একটি শক্তিশালী উদ্ভাবন-ইকোসিস্টেম। প্রযুক্তি, সহযোগিতা, গবেষণা আর প্রয়োগ- এই চার ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে ইউনিভার্সিটি ইনোভেশন হাব হয়ে উঠছে উন্নত বাংলাদেশ গড়ার সূতিকাগার। সরকার, একাডেমিয়া ও ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানগুলোর সম্মিলিত উদ্যোগ ও নিবিড় পরিচর্চার মাধ্যমে তরুণদের এই উদ্ভাবনী মেধা ও শক্তিকে প্রকৃত অর্থে কাজে লাগানো সম্ভব হবে।
লেখক : প্রকল্প পরিচালক, ডিজিটাল উদ্যোক্তা ও উদ্ভাবন ইকো সিস্টেম উন্নয়ন প্রকল্প, বাংলাদেশ হাইটেক পার্ক অথরিটি, আইসিটি বিভাগ
মন্তব্য করুন