মাথিয়ে রিগুস্ত
প্রকাশ : ১৮ জুলাই ২০২৫, ১২:০০ এএম
আপডেট : ১৮ জুলাই ২০২৫, ০৭:৪৭ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

ঔপনিবেশিক যুদ্ধকৌশল শিখেছে ইসরায়েল

ঔপনিবেশিক যুদ্ধকৌশল শিখেছে ইসরায়েল

ফিলিস্তিন এখন সাম্রাজ্যবাদী বুমেরাংয়ের মূল আঘাত বহন করছে। বিশ্বায়িত পুঁজিবাদে শাসনব্যবস্থা প্রতিরোধকে দমন করতে যুদ্ধ, নজরদারি আর দমনপীড়নের কৌশল এক যুদ্ধক্ষেত্র থেকে আরেকটিতে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে প্রয়োগ করে। এ সাম্রাজ্যবাদী ব্যবস্থা ফিলিস্তিন দখলের সূচনা থেকেই সক্রিয় ছিল। তবে তা কখনোই ফিলিস্তিনিদের প্রতিরোধের শিল্প বা লড়াইয়ের মনোভাব—‘সুমুদ’ নিঃশেষ করতে পারেনি।

ব্রিটিশ ম্যান্ডেট আমলে ফিলিস্তিনে ঔপনিবেশিক শাসন প্রতিনিয়ত প্রতিরোধের মুখে পড়েছে। শাসন টিকিয়ে রাখতে ঔপনিবেশিক শক্তি দমনপীড়নের যে পদ্ধতি ব্যবহার করেছে, তা মূলত ছিল জনসাধারণের মধ্যেই যুদ্ধ চালানোর কৌশল—এ পদ্ধতি তাদের সাম্রাজ্যের অন্যান্য জায়গায়ও ব্যবহৃত হয়েছিল।

১৯৩৬ থেকে ১৯৩৯ সাল পর্যন্ত আরব বিদ্রোহ চলাকালে এ কৌশল আরও জোরদার হয়। এ বিদ্রোহ ছিল ব্রিটিশ ম্যান্ডেটের বিরুদ্ধে এবং তারা যেভাবে জায়নবাদের পৃষ্ঠপোষকতা করছিল, তার প্রতিবাদে।

চার্লস টেগার্ট নামের এক ব্রিটিশ গোয়েন্দা অফিসার আগে আইরিশ স্বাধীনতা যুদ্ধকালে উত্তর আয়ারল্যান্ডে কাজ করেছেন, পরে কলকাতা পুলিশের দায়িত্বে ছিলেন, যেখানে তিনি বিচ্ছিন্নতাবাদীদের ওপর ব্যাপক নির্যাতনের জন্য কুখ্যাত ওয়ে ওঠেন। ফিলিস্তিনে পাঠানো হলে তিনি দুর্গনির্মিত পুলিশ ফাঁড়ি, সীমানা বেড়া এবং নির্যাতন কেন্দ্র গড়ে তোলার নির্দেশ দেন।

অন্যদিকে অর্ড উইনগেট, যিনি একজন ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক পরিবারে জন্মেছেন, আগে সুদানে কাজ করতেন। পরে ফিলিস্তিনে গিয়ে তিনি গড়ে তোলেন ‘স্পেশাল নাইট স্কোয়াড’, যারা ইহুদি বসতি স্থাপনকারীদের নিয়ে গঠিত পুলিস কমান্ডো দল, যারা ফিলিস্তিনি গ্রামে শাস্তিমূলক অভিযান চালাত। এই দল পরবর্তীকালে ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর ভিত্তি গড়ে দেয়।

ফরাসি ঔপনিবেশিক কৌশলও ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ। হাইতিতে দাসত্ব পুনঃস্থাপনে, সিরিয়া-আলজেরিয়ায় দমনমূলক পদ্ধতি প্রয়োগ করে, ফ্রান্স ব্যবহার করেছিল গণনিবন্ধন, গণগ্রেপ্তার, প্রশাসনিক বন্দিত্ব, নির্যাতন, সমষ্টিগত শাস্তি, নির্বাসন এবং তাৎক্ষণিক মৃত্যুদণ্ড। এসব কৌশল ইসরায়েলের প্রাথমিক সামরিক-নিরাপত্তা ব্যবস্থার ওপর গভীর প্রভাব ফেলে। কিন্তু এসব কিছু সত্ত্বেও ফিলিস্তিনিদের ‘সুমুদ’—প্রতিরোধের চেতনা নিভিয়ে ফেলা যায়নি।

ইসরায়েলি রাষ্ট্র গড়ে উঠেছে উপনিবেশবাদী ধ্বংসযজ্ঞের ভিত্তিতে—অসংখ্য গ্রাম ধ্বংস, ব্যাপক উচ্ছেদ ও গণহত্যা চালিয়ে। ১৯৪৮ সালের আগস্টে হাইফায় ‘আরব-মুক্তকরণ’ অভিযানে নিয়োজিত কারমেলি ব্রিগেডের একজন অফিসার আদেশ দেন—যে কোনো আরবকে হত্যা করতে, বাড়িঘরে আগুন দিতে এবং দরজা উড়িয়ে দিতে। শরণার্থীদের ওপর মর্টার নিক্ষেপ করা হয়।

প্রতিরোধ পুনর্গঠনের মুখে ইসরায়েলি দমননীতির বিবর্তন চলতে থাকে পশ্চিমা ঔপনিবেশিক শক্তিগুলোর সঙ্গে সমন্বয়ের মাধ্যমে। ১৯৬০ সালে দুই ইসরায়েলি জেনারেল, ভবিষ্যতের প্রধানমন্ত্রী ইৎজাক রবিন এবং প্রেসিডেন্ট খাইম হেরজোগ, ফ্রান্সের আলজেরিয়ায় ব্যবহৃত ‘প্রতিরোধবিরোধী যুদ্ধ’ কৌশল পর্যবেক্ষণ করেন—যেখানে ছিল দেয়াল নির্মাণ, জনসংখ্যা উচ্ছেদ, গণবন্দিত্ব, ধর্ষণ, নির্যাতন, রাসায়নিক অস্ত্র প্রয়োগ এবং প্রচারযন্ত্রের মাধ্যমে সমাজের প্রতিটি স্তরে সেনা নিয়ন্ত্রণ ও সামরিক ভাবধারা প্রবেশ করিয়ে দেওয়া হয়।

এ পদ্ধতি আলজেরিয়ায় ব্যর্থ হলেও ফিলিস্তিনে দমন চালিয়ে যাওয়া হয়। ১৯৬৭ সালের ছয় দিনের যুদ্ধে গাজায় পাঠানো সৈন্যদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়—ঘরের মধ্যে ঢোকার আগে গ্রেনেড ছুড়ে মারা এবং প্রতিরোধকারী যে কাউকে গুলি করে হত্যা করার। এ সহিংসতা ১৯৮২ সালে লেবাননে হামলা ও ২০০২ সালে আল-আকসা ইন্তিফাদার সময় ‘অপারেশন ডিফেন্সিভ শিল্ড’ অভিযানেও ব্যবহার করা হয়। জেনিন শহরে সেনা-পুলিশ অভিযানে তারা ব্যর্থ হয় প্রতিরোধ থামাতে। এ কৌশল এখন বিশ্বের বিভিন্ন দেশের নিরাপত্তা বাহিনীর প্রশিক্ষণে অন্তর্ভুক্ত এবং বিশ্বজুড়ে আধুনিক দমননীতির উদাহরণে পরিণত হয়েছে। এ কৌশল নতুন সাম্রাজ্যিক যুদ্ধ—ইরাক, আফগানিস্তান এমনকি শহরভিত্তিক দমনপদ্ধতি পরিকল্পনার মডেল হয়েছে।

বর্ণভিত্তিক গণবন্দিত্বের ধারণা বিশ্বজুড়ে প্রতিরোধ দমনে ব্যবহৃত হয়েছে ১৯ শতকের শেষে কিউবা, নামিবিয়া কিংবা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধপূর্ব জার্মানির মতো। ইসরায়েল এটিকে ‘সামাজিক প্রকৌশল’ কৌশল হিসেবে ব্যবহার করে ‘মানবিক প্রান্তর’ শূন্য করার লক্ষ্যে এবং বন্দিদের মানসিক পুনর্গঠনে। হাজার হাজার ফিলিস্তিনিকে যথেচ্ছ ও অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্দি রাখা হয় এবং গাজাকে উন্মুক্ত বন্দিশিবিরে রূপান্তর করা হয়েছে। তবু প্রতিরোধ ভেঙে পড়েনি, বরং দেয়ালের ওপারে নতুন করে সংগঠিত হচ্ছে।

২০১০ সালেই গবেষক লালে খালিলি ফিলিস্তিনকে একটি ‘গ্লোবাল দমন-গবেষণাগার’ বলে চিহ্নিত করেন। আর জেফ হ্যালপার বলেন, ইসরায়েল একটি স্থায়ী ‘নিরাপত্তা রাষ্ট্র’, যার ভিত্তি ‘স্থায়ী দমন’। বেসামরিক জনগণের ওপর চূড়ান্ত সহিংসতা সেখানে একটি র্যাশনাল নীতি হিসেবে গৃহীত।

ইসরায়েল মাথায় গুলি করে হত্যা করার নির্দেশ দেয় (শুট-টু-কিল), কিংবা এমন বলপ্রয়োগকে স্বাভাবিক করে, যা প্রতিপক্ষকে থামিয়ে দেয়। এসব কৌশল ‘কিউমুলেটিভ ডিটারেন্স’-এর অন্তর্ভুক্ত যেখানে সহিংসতা ধারাবাহিকভাবে প্রয়োগের মাধ্যমে শাসন কায়েম করা হয়। এ যুদ্ধ বেসামরিক জনগণের ওপর চালিয়ে মিলিটারি-সিকিউরিটি ইন্ডাস্ট্রিকে ব্যাপকভাবে লাভবান করেছে, কিন্তু দমাতে পারেনি মুক্তির আকাঙ্ক্ষাকে। এ কৌশল রপ্তানি হয়ে বিশ্বজুড়ে প্রশিক্ষণ ও হথিয়ার বাজারে ‘কমব্যাট-প্রোভেন’ (যুদ্ধ-পরীক্ষিত) হিসেবে বিক্রি হয়। নিরাপত্তা পুঁজিবাদ যুগে ফিলিস্তিনের ধ্বংস একটি বৈশ্বিক অর্থনীতির অংশ।

২০২৩ সালের ৭ অক্টোবরের প্রতিরোধ-আক্রমণের পর এ অর্থনীতি সম্পূর্ণভাবে সক্রিয় হয়ে ওঠে, যেখানে গাজার পুরো অঞ্চল ধ্বংস করে ‘গ্রেটার ইসরায়েল’ গড়ার পরিকল্পনা চলছে। পশ্চিমা শক্তিগুলোর অস্ত্র, অর্থ ও দায়মুক্তির মাধ্যমে ইসরায়েল এখন একটি নিরবচ্ছিন্ন গণহত্যার পর্যায়ে। সাধারণ মানুষকে লক্ষ্য করে বোমাবর্ষণের এ কৌশলের শিকড় রয়েছে ১৯১১ সালে, যখন ইতালির বিমান লিবিয়ার একটি ক্যাম্পে প্রথম বোমা ফেলেছিল।

ইসরায়েল এখন আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স প্রযুক্তি ব্যবহার করে গণহত্যার গতি বাড়াচ্ছে—একটি স্বয়ংক্রিয় ‘অ্যালগরিদমিক এক্সটারমিনেশন’ প্রক্রিয়া গড়ে তুলছে, যা বিশ্বব্যাপী দমননীতির নতুন রূপ। গাজায় এখন বাড়িঘর, স্কুল, হাসপাতাল, শরণার্থীশিবির ধ্বংস করে দেওয়া হচ্ছে। খাদ্য ও চিকিৎসাসেবার প্রবেশ রোধ করা হচ্ছে। এই ‘খাদ্য ও সম্পদ নিয়ন্ত্রণ’ কৌশল ব্রিটিশরা দক্ষিণ আফ্রিকায়, আমেরিকান সেনারা কিউবা, ফিলিপাইন ও ভিয়েতনামে প্রয়োগ করেছে। ইসরায়েল এ মানবিক সাহায্যকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করছে—অনাহারি জনগণকে ধ্বংস করতে।

রাসায়নিক অস্ত্র যেমন হোয়াইট ফসফরাস বা বিষাক্ত গ্যাস ব্যবহার করে ফিলিস্তিনকে বসবাসের অযোগ্য করে তোলা হচ্ছে। ফ্রান্স ও স্পেন মরক্কোর রিফ বিদ্রোহ, কিংবা আলজেরিয়া ও ভিয়েতনামের ওপর ন্যাপালম ও এজেন্ট অরেঞ্জ প্রয়োগ করেছিল, সেই ইতিহাসই এখানে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে। এই প্রতিটি যুদ্ধক্ষেত্রে সাধারণ মানুষের বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালিয়ে সামরিক-শিল্পের মুনাফা বাড়ানো হয়েছে। কিন্তু কোথাও প্রতিরোধকে নিঃশেষ করা যায়নি। হাইতি, ভিয়েতনাম, আলজেরিয়ার পথ অনুসরণ করে ফিলিস্তিন এখন একটি প্রতীকের নাম—একটি প্রতিরোধ, যা বিশ্বজনীন দমননীতির বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে থাকে, অটল থাকে এবং মুক্তির জন্য আন্তর্জাতিক সংহতির ডাক দেয়।

লেখক: একজন স্বাধীন সমাজবিজ্ঞান গবেষক। তিনি The Enemy Within গ্রন্থের লেখক, যেখানে ফ্রান্সের নিরাপত্তা ব্যবস্থার বিশ্লেষণ করা হয়েছে। আলজাজিরার মতামত বিভাগ থেকে অনুবাদ করেছেন তারেক খান

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

ঢাকায় বৃষ্টি নিয়ে আবহাওয়া অফিসের নতুন বার্তা

১৯ জুলাই : কী ঘটেছিল ইতিহাসের এই দিনে

শনিবার রাজধানীর যেসব এলাকার মার্কেট বন্ধ

১৯ জুলাই : আজকের নামাজের সময়সূচি

স্ত্রীকে তালাক দিয়ে ২৫ কেজি দুধ দিয়ে গোসল 

সেনাবাহিনীর হাতে ইয়াবাসহ পুলিশ সদস্য আটক 

ইবি ছাত্রের রহস্যজন্যক মৃত্যুর তদন্তের দাবিতে ছাত্রশিবিরের টর্চ মিছিল

বাঙলা কলেজ শিক্ষার্থী শহীদ সাগরের মৃত্যুবার্ষিকী আজ

কেশবপুরে ৩১ দফার প্রচারণায় বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতা অমলেন্দু দাস অপু

মাদ্রাসা টিকে আছে বলেই আমাদের ওপর বিভিন্ন ঝড় ঝাপটা আসে : ধর্ম উপদেষ্টা 

১০

ইউনিভার্সিটি ইনোভেশন হাব স্বপ্ন গড়ার সূতিকাগার

১১

রাজবাড়ী জেলা ছাত্র কল্যাণ পরিষদ বাঙলা কলেজ শাখার কমিটি গঠন

১২

গণঅভ্যুত্থান মেহনতি মানুষের কষ্ট লাঘব করেনি : সাইফুল হক 

১৩

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রশিবিরের সাবেক সাধারণ সম্পাদকের ফেসবুক পোস্ট

১৪

মাদকাসক্ত যুবককে পিটিয়ে হত্যা করল মা ও ভাই

১৫

এবার পুলিশের সামনেই চাপাতি দেখিয়ে ছিনতাইয়ের ভিডিও ভাইরাল 

১৬

বৃষ্টির দেখা নেই, আমন চাষে বিপাকে কৃষক

১৭

প্রাথমিকে বৃত্তি পরীক্ষায় কারা সুযোগ পাবে, বাছাই হবে যেভাবে

১৮

হাসপাতালের লিফটের নিচে পড়ে ছিল রোগীর অর্ধগলিত লাশ

১৯

পরিবারের সবাই ইয়াবা বিক্রেতা, অতঃপর…

২০
X