কথা রেখেছেন মাহরীন। জেট ফুয়েলের উত্তপ্ত অগ্নিকুণ্ডে নিজের শরীর পুরোপুরি অঙ্গার হয়ে যাওয়ার আগ পর্যন্ত বুকে আগলেছেন একটা-একটা করে ২০ শিশুকে। কদিন আগেই অভিভাবকদের কথা দিয়েছিলেন, কোনো একটা শিশুর কিছু হওয়ার আগে সেটা তার বুকের ওপর দিয়ে যাবে।
মাঝেমধ্যে ভাবতে চেষ্টা করি, ওই জ্বলন্ত আগুনের শিখা যখন সহস্র নাগিনীর বিষবাষ্প হয়ে তাকে ঘিরে ফেলেছিল, তখনো অকস্মাৎ বিভীষিকায় বিপর্যস্ত স্থবির শিশুদের একজন একজন করে নিরাপদে সরিয়ে নিতে গিয়ে একবারও কি তার মনে হয়নি—আর নয়, এখন নিজেকেই সরিয়ে নিই। তার কি একবারও মনে হয়নি—তার বাড়িতেও তো রয়েছে উদ্বিগ্ন পরিজন, যারা হয়তো ছুটে এসেছে স্কুল ক্যাম্পাসের সামনে। একে একে বেরিয়ে আসা দগ্ধ বীভৎস শিশু-কিশোরদের সারিতে হয়তো তাকে দেখার তীব্র প্রতীক্ষা নিয়ে। হয়তো আর কোনো শিশুকে উদ্ধার করে নিরাপদে পৌঁছানোয় বাকি নেই ভেবে নিজে দরজার দিকে এগোতেই শুনেছেন কোনো এক অসহায় শিশুর আর্ত-আকুতি, ‘ম্যাম আমি এখানে।’ ফুটন্ত আগুন, ঝলসানো বাতাস, পোড়া তেলের তীব্র জ্বলুনি আর ধোঁয়ার আড়ালে শেষ বেঞ্চের কোনায় জড়সড়ো এক জ্বলন্ত শিশু। পারেননি সেই অসহায় আকুতিকে এড়াতে। এগিয়ে গেছেন অন্ধকার ঠেলে বেঞ্চ হাতড়ে হাতড়ে, তার নিজের পরনের জামা কাপড় ততক্ষণে পুড়ে ছাই, নিজের চোখের সামনেই হাত-পা মুখ থেকে তার চামড়াগুলো হারিয়ে যাচ্ছে, তীব্র যন্ত্রণা অসাড় করে ফেলছে তার পা দুটো। তবুও উপায় নেই থেমে যাওয়ার, কথা দিয়েছেন তার বুক এড়িয়ে যেতে পারবে না একটা শিশুও। নিজের দু’হাত বাড়িয়ে আগলে ধরলেন—বাড়িয়ে দেওয়া কোমল হাত দুটো, জ্বলন্ত দুই জোড়া হাতের কম্পিত মহামিলন। মায়ের হাতের মুঠোয় সন্তানের ছোট্ট দু-হাত। ভীত, সন্ত্রস্ত, বিধ্বস্ত ক্লাসরুমের কোনায় জড়সড়ো জ্বলন্ত শিশুকে পরম মাতৃস্নেহে তুলে নিলেন নিজের ভস্মীভূত কোলে। চামড়াহীন ছোট হাত দুটো তখন মাহরীনের গলা আঁকড়ে পরম নিরাপদ আশ্রয়ে। পৃথিবী প্রত্যক্ষ করল ইতিহাসের শ্রেষ্ঠতম আলিঙ্গন। মানবতা পৌঁছে গেল তার শ্রেষ্ঠত্বে।
মাহরীন চৌধুরী শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান বীরউত্তম কিংবা তারেক রহমানের আত্মীয় কি না, সে পরিচয় তখন অর্থহীন। তিনি নিজেও সেটা জনসম্মুখে আনেননি কখনোই, মানবতার জন্য সর্বস্ব বিসর্জনের সাহসিকতা তখন আত্মীয়তার পরিচয় ছাপিয়ে অনেক উঁচুতে, দেশের জন্য সবকিছু বিসর্জনের আত্মিক সম্পর্ক আত্মার আত্মীয় হয়ে রক্ত সম্পর্ককে এমনি ভাবেই ম্লান করে ফেলে বারবার। পুরো বিষয়টি জানার পরও চিকিৎসকের কাছে তারেক রহমানের শান্ত প্রত্যাশা—উনার অবস্থার গুরুত্ব বিবেচনায় যা করণীয় সেটুকুরই। ব্যাংকক, সিঙ্গাপুর, জার্মানি পাঠানোর দাবি নয়। এমনকি মৃত্যুর খবরের পরও চিকিৎসকদের ধন্যবাদ দিয়েছেন যথাসাধ্য করার জন্য, এমন রাজনীতিই চায় জনগণ।
মাহরীন ম্যামের হাত ধরে, কোলে উঠে সেই জ্বলন্ত অগ্নিকুণ্ড থেকে বেঁচে যাওয়া শিশুরা হয়তো সারাজীবন তাদের শৈশবের সেই বীভৎস স্মৃতির ভয়াবহতা বয়ে বেড়াবে সত্যি; কিন্তু নিশ্চিতভাবে দূর আকাশ থেকে ভেসে আসা ছয়টি শব্দে বারবার প্রদীপ্ত হবে, হবে প্রত্যয়ী। চারদিকে আগুনের তীব্র হলকা আর গাঢ় ধোঁয়ায় মধ্যে দিশেহারা শিশুদের পাশে মাহরীন ম্যামের চিৎকার—‘দৌড়াও—ভয় পেয়ো না, আমি আছি।’ জীবনের প্রতিটি থেমে যাওয়ার মুহূর্তে মাহরীন ম্যাম সকল শিশুকে এগিয়ে যাওয়ার সাহস জুগিয়ে যাবেন—প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে।
চারদিকে সুনসান নিস্তব্ধ নীরবতায় শতভাগ দগ্ধ আপাদমস্তক ব্যান্ডেজে মোড়া বার্ন ইনস্টিটিউটের আইসিইউতে হাত নামের দুটো অতীত প্রত্যঙ্গ দিয়ে স্বামীর হাত জোড়া ধরে বলেছিলেন ‘আর দেখা হবে না।’ হতভম্ব নির্বাক স্বামীর জিজ্ঞাসা—কেন বেরিয়ে এলে না? আমাদেরও তো দুটো সন্তান রয়েছে। মাহরীনের কাঁপা-কাঁপা উত্তর—কী করব, ওরাও যে আমার সন্তান, আমি যে অভিভাবকদের কথা দিয়েছি ওদের কিছু হলে আমার বুকের ওপর দিয়ে যাবে। পৃথিবী থেকে চিরতরে চলে যাওয়ার আগে কথোপকথন আর শব্দে থাকে না, নির্বাক চোখের ভাষায় রূপান্তরিত হয়।
মাহরীন—পৃথিবীর এ বাক্যগুলো আপনার কাছে পৌঁছাবে কি না জানি না, আপনি আপনার প্রতিশ্রুতি থেকে বিচ্যুত হননি। সম্পূর্ণ দগ্ধ ওই শ্রেণিকক্ষের সবাইকে আপনি নিরাপদে পৌঁছে দিয়েছেন। মাহরীন, আর দেখা হবে না বলে আপনার আক্ষেপ একদম সত্যি নয়, এই পৃথিবীতে শিক্ষা নামের সকল প্রতিষ্ঠানের প্রবেশদ্বারে আপনি থাকবেন নিরাপত্তার প্রতীক হয়ে, শ্বেতশুভ্র বসনে স্মিত হাসিতে শাশ্বত উজ্জ্বলতায়।
পুলিশ আর সেনাবাহিনীর কড়া নিরাপত্তা বেষ্টনী ভেদ করে ধ্বংসস্তূপ থেকে নিথর নিষ্প্রাণ বন্ধুকে পাঁজাকোলা করে বেরিয়ে আসা কিশোর সভ্যতাকে হতবাক করে দেয়। ‘বলেছিলাম তো কেউ বেঁচে নেই’, হতাশ দর্শকদের এমন জাগতিক মন্তব্যে কিশোরের দৃঢ় স্বর্গীয় উচ্চারণ ‘না’! আমি পৌঁছানো পর্যন্ত ও বেঁচে ছিল। আমাকে বলেছে, ‘জানতাম দোস্ত তুই আসবি।’ কিশোরের ওই ঋজু উচ্চারণে পৃথিবী কেঁপে ওঠে, প্রত্যয়ের বজ্রপাতে বাতাস স্তব্ধ হয়, আমাদের সামনে প্রশ্ন এসে দাঁড়ায়—‘আমরা মানুষ তো’!
তার বিপরীতে কেতাদুরস্ত ইউনিফর্ম আর অজস্র মেডেলে বুক ঢেকে যাওয়া আইনশৃঙ্খলা আর সশস্ত্র বাহিনীর দুর্বৃত্ত সেই কতিপয় নপুংসকদের কথা বলি, এত জমকালো ইউনিফর্ম আর মেডেলের অলংকারও যাদের নগ্নতা আড়াল করতে পারছে না এতটুকুও।
শ্রাবণের এই বর্ষায় নীলফামারীর জলঢাকার চৌধুরী বাড়ির কিংবা ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়—‘মাহরীন আর মাসুকা ম্যামের কবর’ দেশের বিশ কোটি মানুষের শ্রদ্ধার অশ্রু জলের ফোঁটায় সিক্ত হচ্ছে প্রতিনিয়ত। শুধু শ্রাবণ কিংবা আষাঢ়ই নয়, চৈত্রের দাবদাহে কবরের ভেজা মাটি শুকিয়ে শুষ্ক জলহীন হলেও দেশের সকল শিশু-কিশোর আর জনতার শ্রদ্ধার অশ্রুজলে মাটির গভীরে আপনাদের প্রশান্তির হাসি এমনি মমতায় অভিষিক্ত হবে বারবার, সৃষ্টিকর্তা মহান আল্লাহ প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন আপনাদের কবর হবে নিরাপদ আর যন্ত্রণাহীন। পৃথিবীর সকল যন্ত্রণা বুকে নিয়ে ওপারে চলে যাওয়া মাহরীনরা যদি কখনো হারিয়ে যায় আমাদের স্মৃতি থেকে; তাহলে পৃথিবীর সবচাইতে কলঙ্কিতদের তালিকায় স্থান হবে আমাদের।
আপনাদের জন্য রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতির আলোকিত চাকচিক্য নিতান্ত তুচ্ছ আর আটপৌরে। এক টুকরো মেডেল আর কাগজের একটা পাতার চাইতে অনেক বড় মর্যাদার ইতিহাস আপনাদের উত্তরাধিকারে।
মাহরীন-মাসুকা আপনাদের ভীষণ প্রয়োজন; আমাদের কথা দিন—যখনই বাংলাদেশ ক্লান্ত হবে, আপনারা চিৎকার করে বলবেন ওপার থেকে— ‘দৌড়াও, থেমো না, আমি আছি। এদেশের কৈশোর আর তারুণ্য কথা দাও—তোমরাও থামবে না।’
লেখক: অধ্যাপক, বিএনপির মিডিয়া সেলের আহ্বায়ক
মন্তব্য করুন