নবাব খাজা সলিমুল্লাহ বাহাদুর তখন ঢাকার চতুর্থ নবাব। নবাব স্বল্প পরিসরের এ ঢাকা শহরকে সাজিয়েছেন নিজের মনের মতো করে। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতায় ঢাকার এ ছোট পরিসরের যত্নে নবাব সদা সচেতন। নবাব সবচেয়ে যেটার প্রতি বেশি গুরুত্ব প্রদান করেছেন, সেটি হচ্ছে বুড়িগঙ্গা নদী। কারণ এ নদী কেন্দ্র করেই গড়ে উঠেছে এই শহর ও তার সমৃদ্ধি। বুড়িগঙ্গার চারপাশে নবাব নিজের তত্ত্বাবধানে বৃক্ষরোপণ ফুল ও ফল গাছের সমাহারে শোভাময় করে তুলেছেন। এ এক অপরূপ সৌন্দর্যের অবতারণা। নবাবের মন খারাপ হলেই তিনি বুড়িগঙ্গার তীরে বসে নদীর বুকে ভাসমান জেলে নৌকা দেখে দেখে মন শান্ত করেন এবং নদীর সুমিষ্ট বাতাসের পরশে জুড়িয়ে নেন তপ্ত চিন্তিত হৃদয়। আর যদি বেশি মন খারাপ হয় তাহলে নবাব নদীর জলে গা ভিজিয়ে দীর্ঘ সময় বসে থাকেন যতক্ষণ শরীর ও মন দুই-ই সুশীতল না হয়। নদীর পাড়ঘেঁষা ফুলের ঘ্রাণ নাকে এসে পৌঁছালে এক অন্যরকম প্রশান্তি আসে নবাবের মনে। জেলেদের ধরা সবচেয়ে বড় রুই ও রুপালি ইলিশ নবাবের ভোজের প্রতিদিনকার আয়োজনের সঙ্গী। ইলিশের পেটি নবাবের অত্যধিক পছন্দের খাবার। বড় বড় লম্বা শুভ্র ভাতের সঙ্গে ইলিশের মিতালি না ঘটিয়ে নবাব ভোজন শান্তি অনুভব করেন না; তাই বুড়িগঙ্গার প্রতি নবাবের একটু আলাদা দরদ, আলাদা মায়া।
ওপরের অংশটুকু আমার কল্পিত গল্পের অংশ হলেও একটা সময় ঢাকার চিত্র এমনই ছিল। এমনই ছিল তার বাতাস, জল ও জলবায়ু। শহর বলতে আমরা এখন যেটা বুঝি সেটা হচ্ছে, একগাদা কলকারখানা, গাড়ির কালো ধোঁয়া, দূষিত বাতাস, গায়ে গায়ে ধাক্কা লাগা মানুষের ঘামের সংক্রমণ, কংক্রিটের খাঁচায় আবদ্ধ কিছু মানবশিশু পাখির সীমাবদ্ধ বিচরণ, পুকুর ভরাট করে মাছের কঙ্কালের ওপর নির্মিত বহুতল ভবন, নদী ভরাট করে এর ওপর নির্মিত নদী গবেষণা কেন্দ্র—এই এখন শহর। আমরা এখন শহর বলতে এমনটিই বুঝি। কিন্তু একটা সময় এ শহরেরও প্রাণ ছিল, ছিল মন-মাতানো জৌলুস। একটা সময় ঢাকা শহর ভারতবর্ষের ভেতর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শহরগুলোর মধ্যে অন্যতম। নৌপথে বুড়িগঙ্গার তীরে এসে নোঙর ফেলত ভারতবর্ষের সবচেয়ে নামিদামি বণিকের দল।
পৃথিবীর আদি সব বড় বড় শহরের গোড়াপত্তনের ইতিহাস যদি আমরা বিশ্লেষণ করি, তাহলে দেখতে পাব যে, তার প্রাণ হচ্ছে তার পাশ দিয়ে বয়ে চলা কোনো প্রাণসঞ্চারি নদী। ঠিক তেমনি আমাদেরও এই শহর নির্মাণ হয়েছিল বুড়িগঙ্গা নদীর দৃষ্টির ওপর ভর করে অথচ আমরা এতটাই অকৃতজ্ঞ যে, সেই বুড়িগঙ্গার দৃষ্টি আমরা সময়ের পরিক্রমায় কেড়ে নিয়ে তাকে অন্ধ করে দিয়েছি। বুড়িগঙ্গা তার নিজের কারণে অন্ধ নয়, বুড়িগঙ্গাকে অন্ধ করেছে মানুষের দল। বুড়িগঙ্গা এখন মুখ থুবড়ে পড়ে আছে পঁচা নর্দমার মতো। অথচ কী সতেজতায় পরিপূর্ণ ছিল একটা সময় এই নদী। কী দারুণ প্রাণে ভরপুর ছিল তার তারুণ্য।
চোখের সামনে একটা নদীর এমন ক্রমাগত হত্যাচেষ্টা, অথচ কখনোই কেউ তাকে উদ্ধারের জন্য এগিয়ে আসেনি। যে কোনো শহরের প্রাণ হচ্ছে তার পাশ দিয়ে বয়ে চলা জলের প্রবাহ, অথচ সে প্রবাহের সব পথ মনুষ্য কর্তৃক এমন অবরুদ্ধতার ইতিহাস আর কোথাও আছে কি না, আমার জানা নেই। বুড়িগঙ্গার মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে ঢাকারও মৃত্যু হয়েছে ক্রমান্বয়ে। ঢাকা এখন আর প্রাণ ফোয়ারার কোনো শহর নয়, ঢাকা শুধুই একটি খাঁচা; যেখানে প্রতিটি প্রাণ ছটফট করে সে খাঁচা থেকে বের হওয়ার জন্য।
পৃথিবীর ভেতর শহরের অভাব নেই। লাখ লাখ শহর রয়েছে, অথচ যে কোনো নেতিবাচক হিসাবের খাতা টান দিলে সেখানে এগিয়ে থাকে ঢাকা। বিশ্বের জনবহুল শহরের তালিকায় সপ্তম তার অবস্থান। তার একটি উদাহরণ হচ্ছে, নীলক্ষেতের এক পাশ থেকে আরেক পাশে যেতে সময় লাগে বিশ মিনিট, যা শুধু দুই মিনিটের পথ। মানুষের ধাক্কায় দুই বাহু চ্যাপ্টা হওয়ার উপক্রম হয়ে যায় প্রায়। এমন আরও হাজারটা উদাহরণ রয়েছে। বায়ুদূষণের দিক দিয়ে ঢাকার অবস্থান তৃতীয়, যা এক প্রকার ভীতিকর বিষয়। এ নিয়ে কারও কোনো মাথাব্যথা নেই। নেতিবাচক দিক দিয়ে এভাবেই এগিয়ে আছে ঢাকা।
কোথাও ভালো একটা স্বাস্থ্যকর পরিবেশ নেই, কোথাও ভালো একটা খেলার মাঠ নেই, কোথাও প্রাণ ভরে নিঃশ্বাস নেওয়ার জায়গা নেই, নেই কোনো পর্যাপ্ত বৃক্ষ লতাপাতা, নেই কোনো প্রাকৃতিক আনন্দের সম্ভার। আছে শুধু মানুষ আর মানুষের মাথা। কোথাও একটু নিরিবিলি সময় কাটানোর উপায় নেই। এক জায়গায় যখন একত্রে মানুষের এমন অপরিকল্পিত স্তূপের পাহাড় জমে ওঠে, তখন তার চারপাশের বাস্তুসংস্থান আপনাআপনি নিজ ভারসাম্য হারিয়ে বিলুপ্ত হতে থাকে এবং প্রাকৃতিক সুপরিবেশের মৃত্যু ঘটে।
যখন একটি শহরের অবস্থা এমন অবস্থানে এসে পৌঁছে, তখন ধরে নিতে হবে শহরটি এরই মধ্যে মৃতপ্রায় অবস্থায় এসে পৌঁছেছে। সে ক্ষেত্রে শহরকে বাঁচাতে হলে শহরের গা ঘেঁষে বয়ে চলা সব নদীপথ ও নদীকে বাঁচাতে হবে। নিজের পুনঃনিরাময়ের জন্য শহরকে প্রচুর সময় দিতে হবে। তাকে একা আত্মপ্রাকৃতিক নিরাময়কল্পে ছেড়ে দিতে হবে আত্মশুশ্রূষার জন্য। প্রচুর বৃক্ষের রোপণ ও পরিচর্যার সুযোগ দিতে হবে এবং তার জন্য চাই অবশ্যই শহরের বিকেন্দ্রীকরণ ও স্থানান্তর। শুধু জরুরি বলব না, সেই সঙ্গে বলব পরিকল্পিত ও একান্ত কর্তব্য। শহরের বিকেন্দ্রীকরণ ও স্থানান্তর না হলে এ শহরের আর প্রাণ ফেরানো যাবে না, ধীরে ধীরে পচে-গলে মরা মাছের মতো গন্ধ ছড়াবে। তখন কিন্তু নিরুপায় হয়ে একপ্রকার বাধ্য হয়ে শহর ত্যাগ করতে হবে। তার চেয়ে বরং নিজেরা সিদ্ধান্ত নিয়ে শহরকে সেরে ওঠার সুযোগ দেওয়া কি বেশি শোভনীয় নয়?
আমরা আশা করব কর্তৃপক্ষ বিষয়টি অতি গুরুত্বপূর্ণ বিবেচনায় গ্রহণ করে যত দ্রুত সম্ভব এ বিষয়ে পদক্ষেপ গ্রহণ করবে। কারণ, যেটা করতে হবে এবং যার কোনো অন্য বিকল্প পথ নেই, সেটা যত দ্রুত সুপরিকল্পিত সিদ্ধান্তের মাধ্যমে করা যায় ততই মঙ্গল।
অনেকের অনেক ধরনের অসুবিধা ও সাময়িক ক্ষতি হলেও বিরাট ক্ষতি ও বড় ক্ষতির পথ থেকে মুক্তির ক্ষেত্রে আর অন্য কোনো বিকল্প পথ নেই। তাই আমাদের এ ঢাকা শহরকে এই মুমূর্ষু অবস্থা থেকে উদ্ধারের নিমিত্তে সবার সহযোগিতা একান্ত কাম্য। সবাই কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে যদি শহরকে একটু আত্মনিরাময়ের সুযোগ দিই, তাহলে এ ঢাকা আবার হয়তো তার পুরোনো যৌবনে ফিরে যেতে পারবে; ঠিক নবাবের সময়কার ঢাকার মতো।
লেখক: প্রাবন্ধিক ও সাংস্কৃতিককর্মী
মন্তব্য করুন