আজ ঐতিহাসিক ৫ আগস্ট। ফ্যাসিস্ট পতন দিবস। গত বছর এই দিনে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা ভারতে পালিয়ে যান। সেদিন ছিল সোমবার। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের পূর্বঘোষিত কর্মসূচি ‘মার্চ ফর ঢাকা’ উপলক্ষে এদিন সকাল থেকেই রাজধানী ঢাকার চারপাশে হাজার হাজার নিপীড়িত মানুষ সমবেত হতে শুরু করে। বিক্ষুব্ধ জনতার ভয়াল গর্জনে স্তম্ভিত হয়ে যায় শাসকশ্রেণি। তারা বুঝতে পারে, দেশ থেকে পালিয়ে যাওয়া ছাড়া তাদের সামনে আর কোনো পথ খোলা নেই। নানা নাটকীয়তার পর বিকেল ৩টার দিকে খবর আসে ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা ভারতে পালিয়ে গেছেন। এ খবরে সঙ্গে সঙ্গে সারা দেশে আনন্দের বন্যা বয়ে যায়। হাজার হাজার বিক্ষুব্ধ জনতা ঢুকে পড়ে ফ্যাসিবাদের দম্ভের প্রতীক গণভবনে।
এর আগে মাসব্যাপী আন্দোলন প্রতিহত করতে করতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সহস্রাধিক বিক্ষোভকারীকে গুলি করে হত্যা করে। এ হত্যাকাণ্ডের নির্দেশ খোদ শেখ হাসিনা দিয়েছেন বলে জাতিসংঘ, বিবিসি এবং আলজাজিরার প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বিচারে গঠিত বিশেষ ট্রাইব্যুনালে শেখ হাসিনার বিচার শুরু হয়েছে। এ বিচারে তার শাস্তি কার্যকর হলে শহীদদের আত্মা শান্তি পাবে।
শেখ হাসিনা দেশের প্রশাসন, সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী, বিচার বিভাগ, গণমাধ্যম এবং লেখক, সাংবাদিক, বুদ্ধিজীবী ও সাংস্কৃতিক কর্মীদের মাধ্যমে দেশে একটি মাফিয়াতন্ত্র গড়ে তুলেছিলেন। তারা সবাই ছিল শেখ হাসিনার মাফিয়াতন্ত্রের উচ্ছিষ্ট ভোগী। দুর্নীতি ছাড়া শেখ হাসিনার কোনো নীতি ছিল না। মেগা দুর্নীতির উদ্দেশ্যে নেওয়া হয়েছিল মেগা প্রজেক্ট। এসব প্রজেক্ট থেকে ৪০ শতাংশ অর্থ লুট করা হয়। দেশের বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা লুট করে সেই টাকা বিদেশে পাচার করা হয়েছে। শেখ হাসিনার আমলে যে পরিমাণ টাকা বিদেশে পাচার হয়েছে, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির আমলেও এত টাকা বিদেশে পাচার হয়নি। লুটপাট এবং সেই অর্থ পাচারের মাধ্যমে দেশকে তারা দেউলিয়ার দ্বারপ্রান্তে নিয়ে যায়। শেখ হাসিনা পুলিশ বাহিনীকে ব্যবহার করতেন দলীয় লাঠিয়ালের মতো। আক্ষরিক অর্থেই তিনি দেশটাকে একটি পুলিশি রাষ্ট্রে পরিণত করেছিলেন। তাই শেখ হাসিনা দেশ থেকে পালিয়ে যাওয়ার পর পুলিশ বাহিনীর আত্মগোপনে যাওয়া ছাড়া আর কোনো গত্যন্তর ছিল না। সংগত কারণেই তারা সে কাজটিই করেছিল। শুধু পুলিশ নয়, শেখ হাসিনার পতনের আগেই দেশের অধিকাংশ মন্ত্রী, সংসদ সদস্য, আওয়ামী লীগের বিভিন্ন স্তরের নেতা, এমনকি মসজিদের ইমাম পর্যন্ত আত্মগোপন করেন।
শেখ হাসিনা দেশের সব সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান ধ্বংস করে দিয়েছেন। তার অধীনে অনুষ্ঠিত তিনটি সাধারণ নির্বাচনে নজিরবিহীন জালিয়াতি হয়। এই তিনটি নির্বাচন সারা বিশ্বে ‘ভোটারবিহীন নির্বাচন’, ‘নিশিরাতের নির্বাচন’ এবং ‘ডামি-আমি নির্বাচন’ হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে।
হাসিনা ভারতে পালিয়ে যাওয়ার পর তিন দিন দেশে কোনো সরকার ছিল না। শান্তিতে নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে ৮ আগস্ট অন্তর্বর্তী সরকার যাত্রা শুরু করে। একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র এবং সমাজ বিনির্মাণে তার সরকার সংস্কারের প্রয়োজনে ১১টি কমিশন গঠন করেছে। আমাদের প্রত্যাশা, বর্তমান সরকারের আমলে সংস্কার প্রস্তাবের বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হবে। সেইসঙ্গে একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে দেশ আবার গণতান্ত্রিক যাত্রায় শামিল হবে।
মন্তব্য করুন