আগস্ট মাসের ৩১ তারিখ এবং সেপ্টেম্বর মাসের ১ তারিখ—এই দুদিনব্যাপী চীনের তিয়ানজিন শহরে অনুষ্ঠিত হলো সাংহাই সহযোগিতা সংস্থার ২৫তম শীর্ষ সম্মেলন। ২৪টি দেশের রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধানদের পাশাপাশি এ আয়োজনে উপস্থিতি ছিলেন বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা ও জোটের মহাসচিব এবং পরিচালকরা। সম্মেলন সমাপ্ত হওয়ার পরদিনই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাপানের বিরুদ্ধে বিজয়ের ৮০ বছর পূর্তি উপলক্ষে চীনের রাজধানী বেইজিংয়ে চমকপ্রদ কুচকাওয়াজের আয়োজন করে চীনের সামরিক বাহিনী, যেখানে ত্রিপক্ষীয় বন্ধুত্বের একটি অভূতপূর্ব দৃষ্টান্তের দেখা মেলে।
গণপ্রজাতন্ত্রী চীনের কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক শি জিনপিং, বিশ্বের বৃহত্তম দেশ রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন এবং বর্তমান বিশ্বের সবচেয়ে প্রভাবশালী একনায়ক নেতা, উত্তর কোরিয়ার কিম জং উন একসঙ্গে কুচকাওয়াজের মঞ্চে পদচারণা করেন। পূর্বানুমেয়ভাবেই চীনের বিশাল ও দৃষ্টিনন্দন সামরিক প্যারেডের লালগালিচায় এ দৃশ্য দেখে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রথম প্রতিক্রিয়া ছিল আত্মকেন্দ্রিক। এ সংহতি ও শক্তির প্রদর্শনকে তিনি আমেরিকার বিরুদ্ধে একপ্রকারের ষড়যন্ত্র বলে অভিযোগ করলেন।
এখানে তিনটি বিষয় উল্লেখ করা দরকার। প্রথমত, ট্রাম্প সামরিক কুচকাওয়াজ শুধু তখনই পছন্দ করেন, যখন সেটা আয়োজন করা হয় তার জন্য। দ্বিতীয়ত, এ জাতীয় অনুষ্ঠানের দরুন তিনি মঞ্চের কেন্দ্রবিন্দুতে থেকে সব দর্শকের মনোযোগ নিজের দিকে আকৃষ্ট করতে ভালোবাসেন। তৃতীয়ত, তিনি বরাবরের মতো এখনো নিজেকে বিশ্বের এক নম্বর এবং সবচেয়ে ক্ষমতাধর নেতা হিসেবে উপস্থাপন করতে আগ্রহী। কিন্তু এ সপ্তাহে বেইজিং থেকে সম্প্রচারিত চিত্রগুলো তার আত্মপ্রদর্শনের প্রবণতাকে একযোগে তিন দিক থেকে চ্যালেঞ্জ করেছে।
এভাবে ট্রাম্পের অনিশ্চিত অহমিকার আঘাত পাওয়া এবং তার প্রতিক্রিয়ায় স্পষ্ট হয়ে ওঠা অসহায়ত্ব নিঃসন্দেহে শি জিনপিংকে সন্তুষ্ট করেছে। চলতি বছরের জানুয়ারি মাস থেকেই চীনের প্রতি ট্রাম্পের আচরণ ছিল কখনো আক্রমণাত্মক, কখনো প্রতিহিংসাপরায়ণ, আবার কখনো ঔদ্ধত্যপূর্ণ। বিশেষত তার শুল্কনীতির শাস্তিমূলক পদক্ষেপ বিশ্বব্যাপী নজিরবিহীন বিঘ্ন ঘটাতে শুরু করেছে। যদিও নভেম্বর মাস পর্যন্ত সবচেয়ে কঠোর শুল্কগুলো স্থগিত রাখা হয়েছে, তবুও চলমান ঘটনাপঞ্জি স্পষ্ট করে দেয় যে, কী কারণে শি বারবার চীনা জাতীয়তাবাদের ওপর জোর দিয়ে বক্তব্য রেখে চলেছেন।
শি বলেছেন, ‘চীনারা একটি গর্বিত জাতি, তাদের ভয় দেখিয়ে দমন করা সম্ভব নয়।’ ট্রাম্প বেশ কয়েকবার অস্পষ্টভাবে চীনের সঙ্গে ব্যক্তিগত পর্যায়ে বৈঠক করার প্রস্তাব দিয়েছেন, কিন্তু সেটাকে তিনি সহযোগিতার উদ্যোগ হিসেবে নয়, বরং তার দয়ার্ঘ্য কোনো দান হিসেবে উপস্থাপন করেছেন, যার কারণে চীনের সরকার বেশ অপমান বোধ করেছে। তাই বেইজিংয়ে ত্রিমূর্তির এ শোভাযাত্রা ছিল ট্রাম্পের সাম্প্রতিক কর্মকাণ্ডের প্রতি শির প্রত্যক্ষ জবাব।
রাশিয়ার লাল চত্বর ঐতিহাসিকভাবে কুচকাওয়াজের জন্য প্রখ্যাত। তার মানদণ্ডে বিচার করলেও বলতে হয় যে, চীনা প্রেসিডেন্টের এ সামরিক শক্তির প্রদর্শনী ছিল অতুলনীয়। সামরিক প্রদর্শনী, সংগীত পরিবেশন, নিখুঁত সাযুজ্যে পদক্ষেপ ফেলা সৈন্য, ট্যাঙ্ক, কামান, এমনকি ৮০ হাজার কবুতর ওড়ানোর পর্ব—সবকিছুই ইঙ্গিত করছিল যে, বেইজিং দ্রুতই ওয়াশিংটন ডিসির সঙ্গে সামরিক প্রতিদ্বন্দ্বিতার লক্ষ্যে এগিয়ে চলেছে। তবে এ মহড়ায় মার্কিন নৌবাহিনীর জন্য সবচেয়ে উদ্বেগজনক প্রদর্শনী ছিল চীনের হাইপারসনিক ও পারমাণবিক সক্ষমতাসম্পন্ন দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র এবং সমুদ্রের নিচ দিয়ে চালিত ড্রোনের উন্মোচন। অনুষ্ঠান শেষে শি জিনপিং ঘোষণা করেন, ‘চীন এখন অপ্রতিরোধ্য।’ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সমাপ্তিকালের কথা স্মরণ করে তিনি বলেন, ‘মানবজাতি এখন আবারও শান্তি কিংবা যুদ্ধ, সংলাপ কিংবা সংঘাত, পারস্পরিক জয় কিংবা পরাজয়ের অঙ্ক কষতে শুরু করেছে।’ তার এ বক্তব্য নিঃসন্দেহে ছিল ট্রাম্পের উদ্দেশে এক সতর্কবার্তা। ট্রাম্প আদৌ তা আমলে নেবেন কি না, সেটি সম্পূর্ণ ভিন্ন কথা।
বাজনা-তুরি আর বেয়নেটের আড়ালে, শির আসল লক্ষ্য ছিল তার নিজস্ব কল্পিত ভবিষ্যৎকে বাস্তব রূপ দেওয়ার আকাঙ্ক্ষা প্রকাশ করা। বৈশ্বিক রাজনীতিতে নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য চীন যে এখন প্রস্তুত, এ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে সেটা তুলে ধরতে চেয়েছিলেন তিনি। ২০১২ সালে কমিউনিস্ট পার্টির শীর্ষ পদে অধিষ্ঠিত হওয়ার পর থেকেই এর প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন শি। বিশেষত তাইওয়ান ও দক্ষিণ চীন সাগরে খোলাখুলি সম্প্রসারণবাদী পররাষ্ট্রনীতি চর্চা করছেন তিনি। মাও সেতুংয়ের পর আর কোনো চীনা নেতা ক্ষমতার কেন্দ্রীকরণের এমন সাহস দেখাননি। এমনকি, মাওয়ের নেতৃত্বের ব্যর্থ দিকগুলোকেও শি শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করেন। অর্থনীতি, কর্মসংস্থান, আবাসন সংকট এবং দুর্নীতির মতো নানা ক্ষেত্রে চীনা এ নেতার কিছু ব্যর্থতা থাকলেও, তার সমালোচনা ক্রমেই কঠোর হস্তে দমন করেছেন তিনি। করপোরেট জগৎ থেকে শুরু করে সংবাদমাধ্যম ও ব্যক্তিগত স্বাধীনতার ওপরও শক্ত নিয়ন্ত্রণ বজায় রেখেছেন। যেই দেশগুলো রাষ্ট্রব্যবস্থায় কড়া নজরদারি চর্চা করে থাকে, নির্দ্বিধায় বলা যায় যে আজও সেই দেশগুলোর তালিকায় উত্তর কোরিয়ার পর দ্বিতীয় অবস্থান চীনের।
সাংহাই সহযোগিতা সংস্থার এই ঐতিহাসিক বার্ষিক সম্মেলন এবং তারপর বেইজিং সমাবেশে ডজনখানেক রাষ্ট্রনেতাকে একত্রিত করে শি এমন এক দাগ টানলেন, যার অভিঘাত হোয়াইট হাউস পর্যন্ত ছাপ ফেলেছে। তুরস্ক, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, পাকিস্তান, ইরানসহ অনেক উদীয়মান শক্তির নেতারা প্রকাশ্যে চীনা প্রভাবের কাছে নতজানু হয়েছেন। ট্রাম্পের শুল্কনীতিতে ক্ষুব্ধ হয়ে চীনের আরেক প্রতিদ্বন্দ্বী ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিও চীনের সঙ্গে পুরোনো বিরোধ ম্রিয়মাণ করে সহযোগিতায় রাজি হয়েছেন।
এসসিওর যৌথ ঘোষণা কার্যত নতুন এক বৈশ্বিক নিরাপত্তা ও অর্থনৈতিক শৃঙ্খলার স্বীকৃতি দিল, যা ১৯৪৫-পরবর্তী পশ্চিমা প্রভাবশালী ব্যবস্থা চ্যালেঞ্জ করছে এবং বেইজিংকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হচ্ছে। এ অবস্থায় ট্রাম্পের বিচলিত হওয়াটা অস্বাভাবিক কোনো ঘটনা নয়। কিন্তু মনে রাখতে হবে যে, তার অবিবেচক ও প্ররোচনামূলক আচরণ এবং তার বন্ধু ও শত্রু উভয়কে একই কায়দায় নতুন সাম্রাজ্যবাদী এক আমেরিকান নীতি মানতে বাধ্য করানোর প্রবণতাই বহু দেশকে চীনের শিবিরে ঠেলে দিয়েছে।
অন্যদিকে আবার এটাও সত্য যে, শি-পুতিন-কিমের নেতৃত্বে বেইজিং জোট দীর্ঘমেয়াদি হবে বা তারা নিজেদের মধ্যে সামরিক সহায়তার বদলে গঠনমূলক সহযোগিতার সম্পর্ক গড়ে তুলতে পারবে—এর কোনো নিশ্চয়তা নেই। যেমন, ইউক্রেনের ব্যাপারে পুতিন শির সাহায্য চাইলেও, ইতিহাস সাক্ষী যে, রাশিয়া চীনা সম্প্রসারণবাদকে বরাবরই ভয় পায়। অন্যদিকে, কিমের সঙ্গে তাদের সম্পর্কটাও খুব সাবলীল নয়। উত্তর কোরিয়ার অর্থনৈতিক দুর্দশা আর কিমের অস্থিতিশীল আচরণ বেইজিংকে সবসময়ই উদ্বিগ্ন করে রেখেছে। কিম স্বেচ্ছায় প্রকাশ না করলেও, চীনের আধিপত্যকে যে তিনি কিছুটা ভয় পান, তা অনেকবারই প্রকাশ পেয়েছে।
একবিংশ শতকে বিশ্বের প্রধানতম শক্তি হিসেবে চীনকে গড়ে তোলার ক্ষেত্রে শির দৃষ্টিভঙ্গির নতুনতম বিজয়সূচক ঘোষণা ছিল এ সম্মেলনটি। কিন্তু এটা ভুলে গেলে চলবে না যে, পুতিন ও শি দুজনেরই বয়স সত্তরের ঘরে। তারা চিরকাল ক্ষমতায় থাকবেন না। যত শক্তই হোক না কেন, তাদের শাসনব্যবস্থা কিন্তু বৃহৎ অংশে ব্যক্তিনির্ভর। তাদের অনুপস্থিতিতে দুই দেশেই একটা রাজনৈতিক শূন্যতা তৈরি হবে। এ সুযোগে দুই দেশেই দমিত ক্ষোভ বিস্ফোরিত হওয়ার বিপুল সম্ভাবনা রয়েছে।
এই তিন দেশের জোট মূলত স্বার্থসিদ্ধির জোট, যার কোনো আদর্শিক, বুদ্ধিবৃত্তিক কিংবা নৈতিক ভিত্তি নেই। তারা একত্রিত হয়েছে আমেরিকান আধিপত্যের বিরুদ্ধে, ডলারের ওপর ভিত্তি করে গড়ে তোলা পশ্চিমাবিশ্ব নিয়ন্ত্রিত আর্থিক ব্যবস্থার বিরুদ্ধে; আর যে মানবাধিকার ও নাগরিক স্বাধীনতার সর্বজনীন মানদণ্ডকে তারা বিরক্তিকর বলে মনে করে, তার বিরুদ্ধেও। এই প্রতিটি দেশের রাজনীতিই মূলত অগণতান্ত্রিক। অন্যভাবে বললে, ইউরোপ ও আমেরিকার চরম-ডানপন্থি নেতাদের মতো, তারাও জানেন যে তারা কী চান না।
তবে এ নতুন জোট পশ্চিমা বিশ্বের তৈরি করা ব্যবস্থা ধ্বংস করতে চাইলেও, তার পরিবর্তে কী ব্যবস্থা কায়েম করতে চান, সে ব্যাপারে কারও কোনো স্পষ্ট ধারণা নেই। নিজেদের স্বার্থসিদ্ধি ও রাজনৈতিক প্রভাবের বাইরে একটি টেকসই বৈশ্বিক কাঠামোর পরিকল্পনা তারা আদৌ বাস্তবায়ন করতে পারবেন কি না, সে ব্যাপারে সবাই সন্দিহান। এমনকি, সুযোগ পেলে বহু মধ্যম শক্তির দেশ আবারও আমেরিকার শিবিরে ফিরে যেতে পারে বলে মনে হচ্ছে। বিশেষ করে যদি ডোনাল্ড ট্রাম্পের পর আমেরিকার নেতৃত্বের দায়িত্ব নেন আরও সংযত ও কম সংঘাতপ্রবণ কোনো প্রেসিডেন্ট।
১৯৪৫ সালে যখন জাতিসংঘ এবং বর্তমান বিশ্বব্যবস্থা গড়ে তোলা হচ্ছিল, তখন পশ্চিমা শক্তিগুলোর মধ্যে অন্তত এক ধরনের সম্মিলিত প্রতিজ্ঞা কাজ করেছিল। তাদের প্রধান লক্ষ্য ছিল দুই বিশ্বযুদ্ধের ভয়াবহতার যেন আর কখনো পুনরাবৃত্তি না ঘটে, সেটা নিশ্চিত করা। আজ বেইজিং ত্রিমূর্তির বাস্তববাদী ও প্রদর্শনমূলক রাজনীতিতে সেই মানবিক আদর্শের কোনো অস্তিত্ব নেই। বৈশ্বিক রাজনীতি এবং বিশ্বশান্তির পথে সেটা একটা অশুভ সংকেত বটে। একদিকে চলছে শি, পুতিন ও কিমের প্রতিবাদমূলক সম্প্রসারণবাদী রাজনীতি, অন্যদিকে চলছে ট্রাম্পের একাকী নৈরাজ্যবাদী সম্প্রসারণমূলক রাজনীতি। যদি এমনটাই চলতে থাকে, তবে বিশ্বরাজনীতির পণ্ডিতরা আশঙ্কা করছেন যে, অদূর ভবিষ্যতে মানবসৃষ্ট মহাপ্রলয়ের দেখা মিলতে পারে, যেখানে বিশাল আকারে একসঙ্গে সংঘটিত হবে যুদ্ধ, দুর্ভিক্ষ ও মৃত্যু।
লেখক: ‘দ্য গার্ডিয়ান’ পত্রিকার সহকারী সম্পাদক, আন্তর্জাতিক সম্পর্কবিষয়ক বিশেষজ্ঞ এবং যুক্তরাষ্ট্রের হোয়াইট হাউসে নিয়োজিত স্থায়ী প্রতিবেদন। নিবন্ধটি ব্রিটিশ পত্রিকা ‘দ্য গার্ডিয়ান’-এর মতামত বিভাগ থেকে অনুবাদ করেছেন অ্যালেক্স শেখ
মন্তব্য করুন