একুশ শতকের তৃতীয় দশক যেন আবারও আন্দোলনের রাজনীতিকে নতুন করে সংজ্ঞায়িত করছে। বিশ্ব ইতিহাসে বারবার দেখা গেছে, অর্থনৈতিক সংকট, রাজনৈতিক দমননীতি এবং তরুণদের স্বপ্নভঙ্গ একত্রিত হলে বড় পরিবর্তন অনিবার্য হয়ে ওঠে। শ্রীলঙ্কা (২০২২), বাংলাদেশ, সার্বিয়া, সিরিয়া (২০২৪) এবং সাম্প্রতিক ইন্দোনেশিয়ায় (২০২৫) এ ধারাবাহিক গণআন্দোলন নতুন যুগের সূচনার দৃষ্টান্ত হিসেবে কাজ করছে। প্রশ্ন হচ্ছে, এ ঘটনাগুলো কি শুধু বিচ্ছিন্ন রাষ্ট্রীয় সংকট, নাকি বৈশ্বিক রাজনীতির নতুন ধারা?
শ্রীলঙ্কা, বাংলাদেশ, সার্বিয়া, সিরিয়া ও ইন্দোনেশিয়ার ছাত্র-জনতার আন্দোলনে প্রতিটি ক্ষেত্রেই একটি অদৃশ্য সূত্র চোখে পড়ে। তা হলো, সাধারণ মানুষের ক্ষোভ বিশেষ করে ছাত্র-যুবসমাজের আত্মত্যাগ, যা স্বৈরতন্ত্রের পতন অনিবার্য করে তুলেছে।
শ্রীলঙ্কার উদাহরণ খুবই নির্দেশক। ২০২২ সালে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ নামমাত্র ৫০ মিলিয়ন ডলারে নেমে আসে, যেখানে দেশটির ঋণের পরিমাণ দাঁড়ায় ৫১ বিলিয়ন ডলারে। চাল-ডাল থেকে শুরু করে জ্বালানি পর্যন্ত আমদানি অসম্ভব হয়ে পড়ে। মুদ্রাস্ফীতি ৫০ শতাংশ ছাড়িয়ে যায়। জুলাই ২০২২-এ কয়েক লাখ মানুষ কলম্বোর রাস্তায় নেমে আসে এবং প্রেসিডেন্ট গোতাবায়ে রাজাপাকসেকে দেশত্যাগে বাধ্য করে। এ আন্দোলনে ছাত্র-যুবসমাজের অংশগ্রহণ সবচেয়ে দৃশ্যমান ছিল। অর্থনীতি ভেঙে পড়লে স্বৈরতন্ত্রের ভিত্তি কতটা দুর্বল হয়ে পড়ে, শ্রীলঙ্কা তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ।
বাংলাদেশের উদাহরণও শিক্ষণীয়। ২০২৪ সালে কোটা আন্দোলন ও রাজনৈতিক একচেটিয়াত্ব ছাত্রদের ক্ষোভ তীব্র করে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শুরু হওয়া আন্দোলন ধীরে ধীরে সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে। আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম যেমন দ্য গার্ডিয়ান এবং আলজাজিরা এ অভ্যুত্থানকে দক্ষিণ এশিয়ার তরুণ নেতৃত্বাধীন বিপ্লব নামে অভিহিত করে। কয়েক মাসের মধ্যেই ক্ষমতার পালাবদল ঘটে, যা প্রমাণ করে অর্থনীতি ও গণতন্ত্রের অভাব মিলিত হলে তরুণরা কোনো শাসনব্যবস্থা রক্ষা করতে দেয় না।
সার্বিয়া ও সিরিয়ায়ও একই চিত্র দেখা গেছে। ইউরোপে ২০২৪ সালে সার্বিয়ায় প্রেসিডেন্ট আলেকসান্দার ভুচিচের বিরুদ্ধে দুর্নীতি ও নির্বাচন জালিয়াতির অভিযোগে ব্যাপক বিক্ষোভ শুরু হয়। বেলগ্রেড বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা প্রধান মিছিলের নেতৃত্ব দেয়। অন্যদিকে মধ্যপ্রাচ্যে সিরিয়ায় দীর্ঘদিনের স্বৈরতন্ত্র ও গৃহযুদ্ধ-পরবর্তী অর্থনৈতিক ধস নতুন প্রজন্মকে বিদ্রোহে ঠেলে দেয়। দামেস্ক বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা রাজপথে নামলে আন্দোলন দ্রুত গতি পায়। অর্থনৈতিক সংকটের পাশাপাশি মানবাধিকার হরণের প্রতিবাদ এ আন্দোলনের মূল শক্তি হয়ে ওঠে।
সাম্প্রতিককালে ইন্দোনেশিয়ায় ছাত্র-যুবসমাজের জাগরণও এক নতুন বিস্ফোরণ সৃষ্টি করে। দেশটিতে দুর্নীতি, মূল্যস্ফীতি (৯ শতাংশ), বেকারত্ব (৭ শতাংশ) এবং রাজনৈতিক অনিয়ম আন্দোলনের পটভূমি তৈরি করে। রয়টার্স জানায়, শুধু জাকার্তাতেই আগস্ট মাসে লাখ লাখ মানুষ বিক্ষোভে অংশ নেয়, যার বড় অংশই বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী।
এ ধারাবাহিক আন্দোলনগুলো তিনটি মূল সত্যকে সামনে আনে। প্রথমত, অর্থনৈতিক সংকট স্বৈরতন্ত্রের প্রধান দুর্বলতা। অর্থাৎ মুদ্রাস্ফীতি, বৈদেশিক ঋণ, বেকারত্ব জনগণকে সরাসরি প্রভাবিত করে। যখন জীবনযাত্রা অস্থিতিশীল হয়, মানুষ শাসকের বিরুদ্ধে একত্রিত হয়। দ্বিতীয়ত, গণতান্ত্রিক শূন্যতা ক্ষোভকে তীব্র করে। অর্থাৎ বিরোধী কণ্ঠস্বরকে দমন, সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা হরণ এবং নির্বাচন জালিয়াতি জনগণের সহনশীলতা শেষ করে দেয়। ছাত্র-জনতার এ আন্দোলনগুলোর ধারাবাহিকতা দেখাচ্ছে, জনগণের বিশেষ করে তরুণ সমাজের ইচ্ছাকে অগ্রাহ্য করে কোনো শাসক ক্ষমতায় টিকে থাকতে পারে না। অর্থনৈতিক ন্যায়বিচার, রাজনৈতিক স্বাধীনতা ও সামাজিক অংশগ্রহণ নিশ্চিত করাই ভবিষ্যৎ রাষ্ট্রের টিকে থাকার মূল শর্ত। তাই টেকসই উন্নয়ন, সুশাসন ও রাজনৈতিক অন্তর্ভুক্তি ছাড়া রাষ্ট্র দীর্ঘস্থায়ী হবে না। আর যদি তা না হয়, তবে ২১ শতকের এই নতুন বিপ্লবী ঢেউ আরও অনেক স্বৈরতন্ত্রকে ভাসিয়ে নিয়ে যাবে।
লেখক: শিক্ষার্থী, ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
মন্তব্য করুন