বাংলাদেশের রাজনীতি ও গণতন্ত্র বারবার সংকটে পড়ার একটি বড় কারণ—অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন না হওয়া। নির্বাচন ঘিরে অস্থিরতা, সহিংসতা ও অবিশ্বাস আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতির চিরচেনা দৃশ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। অথচ ভোট হলো জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকার। যদি এ প্রক্রিয়া প্রশ্নবিদ্ধ হয়, তবে গণতন্ত্র তার ভিত্তি হারায়। তাই নির্বাচনী সংস্কার শুধুই রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার একটি অংশ নয়; এটি জাতীয় ঐক্য ও ভবিষ্যৎ স্থিতিশীলতার অপরিহার্য শর্ত।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গন সবসময়ই নির্বাচন ঘিরে উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। প্রতিটি নির্বাচনের আগে রাজনৈতিক দলগুলো নানা কর্মসূচি, কৌশল ও সংগঠন পুনর্গঠনের মাধ্যমে নিজেদের শক্ত অবস্থান তৈরি করতে সচেষ্ট হয়। এ প্রেক্ষাপটে বিএনপি ও জামায়াত—দুদলই দীর্ঘদিন ধরে রাজনৈতিক মাঠে সক্রিয় থাকার চেষ্টা করছে। তাদের নির্বাচনী প্রস্তুতি নিয়ে জনগণের মধ্যে যেমন আগ্রহ রয়েছে, তেমনি রয়েছে নানা প্রশ্নও।
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা ভারতে পালিয়ে যাওয়ার পর গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ও সমাজ বিনির্মাণের লক্ষ্যে নতুন করে সামনে আসে রাজনৈতিক সংস্কারের বিষয়টি। বিশেষভাবে প্রাধান্য দেওয়া হচ্ছে নির্বাচনী ব্যবস্থা এবং নির্বাচন পদ্ধতির সংস্কার নিয়ে। আগামী ফেব্রুয়ারির জাতীয় সংসদ নির্বাচন কী প্রক্রিয়ায় হবে, তা এখনো চূড়ান্ত হয়নি। জুলাই জাতীয় সনদ কী উপায়ে কার্যকর করা যায় ও সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব অথবা সরাসরি প্রতিদ্বন্দ্বিতার মধ্যে কোন পদ্ধতিতে আইনসভার সদস্যরা নির্বাচিত হবেন, সে বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মতভেদের মীমাংসা হয়নি। এর ভেতরেই বর্তমান বিদ্যমান নির্বাচন ব্যবস্থা বিবেচনায় রেখে প্রার্থী বাছাই করছে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি)। ৩০০ আসনের মধ্যে অর্ধেক আসনে প্রার্থীদের প্রাথমিক বাছাই হয়ে গেছে। তপশিল ঘোষণার আগেই অন্তত ৭০ শতাংশ আসনে একক প্রার্থী চূড়ান্ত করতে চায় দল। এবার শতাধিক আসনে প্রার্থী হিসেবে নতুন মুখ দেখা যেতে পারে। প্রার্থী বাছাইয়ের ক্ষেত্রে সমমনা দলগুলোর সঙ্গে আসন সমঝোতা করতে হতে পারে, তাও বিবেচনায় রাখছে বিএনপি। এর বাইরে, নির্বাচনী ইশতেহার তৈরির কাজও একই সঙ্গে চলছে।
জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার বলেছেন, ‘আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জামায়াত ৩০০ আসনেই প্রার্থী দেওয়ার মাধ্যমে পূর্ণ নির্বাচনী প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছে। জামায়াতের প্রত্যেক কর্মীকে এখন নির্বাচনী মাঠে নেমে পূর্ণ শক্তিতে কাজ করতে হবে। নির্বাচন সামনে রেখে সংগঠন যখন যাকে সিদ্ধান্ত দেবে, সেই সিদ্ধান্ত মেনে নেওয়ার ব্যাপারে আমাদের মানসিকতা তৈরি করতে হবে। আমরা আমাদের আন্দোলনকে বিজয়ী করার জন্য ত্যাগ স্বীকার করতে হবে।’
১৯৯৬ সালের পর এককভাবে নির্বাচন করেনি জামায়াত। এবার তারা ইসলামপন্থিদের ভোট ‘এক বাক্সে’ আনতে চরমোনাইর পীরের দল ইসলামী আন্দোলনসহ কয়েকটি দলের সঙ্গে নির্বাচনী সমঝোতা গড়তে চাইছে। তবে এককভাবে নির্বাচনের প্রস্তুতি নিয়েই এগোচ্ছে দলটি। ত্রয়োদশ জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে জামায়াত বহুমুখী প্রস্তুতি নিয়ে এগোচ্ছে। নির্বাচন নিয়ে দেশের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর এ তৎপরতা নিঃসন্দেহে ইতিবাচক।
আমরা মনে করি, গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে হলে যে কোনো মূল্যে নির্বাচনী সংস্কৃতি ফিরিয়ে আনতে হবে। নির্বাচন ব্যবস্থা এবং নির্বাচন পদ্ধতির সংস্কারের পাশাপাশি রাজনৈতিক দলগুলোকে হতে হবে গণতন্ত্রমনস্ক। দেশে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ফিরিয়ে আনতে এবং গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে হলে অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানের বিকল্প নেই।
মন্তব্য করুন