বিশ্বাসঘাতকতা শব্দটা আমাদের কাছে নতুন নয়; কিন্তু কিছু কিছু সময় আসে, যখন এই শব্দটা তার চেনা দাগ পেরিয়ে আরও তীব্র হয়, আরও কষ্টদায়ক। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প যেদিন তার তথাকথিত শান্তি পরিকল্পনা ঘোষণা করলেন, সেদিন মধ্যপ্রাচ্য যেন নিঃশব্দে হিমস্রোতে ডুবে গেল।
তবে এই পরিকল্পনা যতটা না শান্তির, তার চেয়ে ঢের বেশি দখলের আর বঞ্চনার। একটানা দুই বছর ধরে গাজায় মৃত্যু, ধ্বংস আর অমানবিক অবরোধের ভেতর দিয়ে যাওয়া মানুষগুলোর জন্য এ পরিকল্পনায় আশার কোনো আলো নেই। বরং, যে পরিকল্পনায় জাতিসংঘের মুখ বন্ধ, ফিলিস্তিনিদের কণ্ঠ স্তব্ধ, আর ইসরায়েলি সেনাদের পদচারণাই ভবিষ্যতের দিকনির্দেশ, সেখানে কেবল নতুন একরকম দখলদারির জন্ম হয়।
মধ্যপ্রাচ্যের আটটি দেশ—তুরস্ক, কাতার, সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, জর্ডান, মিশর, ইন্দোনেশিয়া আর পাকিস্তান—এই পরিকল্পনাকে স্বাগত জানিয়ে এক বিবৃতিতে স্বাক্ষর করেছে। কিন্তু তারা কেউই আগেভাগে ফিলিস্তিনিদের সঙ্গে কোনো আলোচনা করেনি। গাজার ভবিষ্যৎ নিয়ে যখন সিদ্ধান্ত হচ্ছে, তখন গাজার মানুষই সেখানে নেই।
নেতানিয়াহু এবং ট্রাম্প মিলে এই পরিকল্পনাকে এমনভাবে সাজিয়েছেন, যাতে সব চাবিকাঠি থেকে যায় ইসরায়েলের হাতেই। শান্তির কথা বলে শুরু হলেও, এই পরিকল্পনা শেষ হয়েছে একতরফা শর্ত আর অস্ত্র ছাড়ার দাবিতে। গাজা থেকে ইজরায়েলি সেনা সরবে কি না, সেটাও নির্ভর করছে নেতানিয়াহুর ইচ্ছার ওপর। ফিলিস্তিনের পক্ষে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে মামলা চালানো বন্ধ করতে হবে, শহীদদের পরিবারের জন্য আর্থিক সহায়তা দিতে পারবে না, পাঠ্যক্রম বদলাতে হবে—এসব শর্ত রেখেই বলা হয়েছে, ‘তারপর দেখা যাবে।’
এ পরিকল্পনার খসড়া যেটা নিউইয়র্কে স্বাক্ষর হয়েছিল, তার সঙ্গে হোয়াইট হাউসে ঘোষিত পরিকল্পনার অমিল এতটাই গভীর যে, এটিকে সম্পাদনা নয়, বরং প্রতারণা বলাই ঠিক হবে। কাতার তো রীতিমতো ক্ষুব্ধ, তারা ট্রাম্পকে ঘোষণার সময় পেছানোর অনুরোধও করেছিল। কিন্তু তারা জানত, ট্রাম্প ও উইটকফের মতো চরিত্রদের কাছ থেকে বিশ্বাসযোগ্যতা আশা করা বোকামি।
সবচেয়ে যন্ত্রণার ব্যাপার হলো, এ পরিকল্পনার কোথাও ফিলিস্তিনি নেতৃত্বের জন্য কোনো স্থান নেই। গাজা ও পশ্চিম তীরকে কার্যত আলাদা করে দেওয়া হয়েছে, যেন কোনোদিন একত্র হওয়ার স্বপ্নটাও না থাকে। এই যোজনায় পিএ (প্যালেস্টিনিয়ান অথরিটি) বা হামাস—কেউই সম্মানজনক কোনো ভূমিকায় নেই। উল্টো, দমন-পীড়নের ধারাকে ‘সমাধান’ নামে উপস্থাপন করা হয়েছে।
আরব দেশগুলো নিজেদের পক্ষে হয়তো বলবে, তারা জাতিসংঘের সংস্থাগুলোকে গাজায় ফিরিয়ে এনেছে বা জাতিগত নির্মূল রুখেছে। কিন্তু আসল চাবি কার হাতে, সেটা তারা জানে। যারা ইসরায়েলি ট্যাংক, ড্রোন আর রোবট দিয়ে গাজাকে দমিয়ে রাখতে পারেনি, তাদের হয়ে আজ এই দেশগুলো হামাসকে ‘সমঝোতা’ মানাতে যাচ্ছে। লজ্জার ভার এতটাই ভারী যে—মুখ তুলে তাকানো দায়।
এই ইতিহাসে একদিন লেখা হবে, গাজার ধ্বংসস্তূপের পাশে দাঁড়িয়ে একদল মানুষ শান্তির নামে নিঃশব্দে স্বাক্ষর করে গেছেন আরেকটি জাতিগত নিধনের চুক্তিতে।
নেতানিয়াহুকে যখন জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, তিনি কি একটি ফিলিস্তিনি রাষ্ট্রের পক্ষে সম্মত, তিনি স্পষ্ট করে বলেছিলেন— ‘একেবারেই না’। তার ভাষ্য ছিল, ‘চুক্তিতে এটা লেখা নেই, তবে আমরা একটা কথা পরিষ্কার করে বলেছি—আমরা দৃঢ়ভাবে একটি ফিলিস্তিনি রাষ্ট্রের বিরোধিতা করি। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পও সেটাই বলেছেন। তিনি বলেছিলেন, তিনি সেটা বোঝেন।’
এ জায়গায় নেতানিয়াহু সত্য বলেছিলেন।
চুক্তির ২০তম ধারা শুধু বলছে, ‘মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইসরায়েল ও ফিলিস্তিনিদের মধ্যে একটি রাজনৈতিক দিগন্ত নির্ধারণের লক্ষ্যে সংলাপ শুরু করবে, যাতে তারা শান্তিপূর্ণ এবং সমৃদ্ধ সহাবস্থান প্রতিষ্ঠা করতে পারে।’ এর মধ্যে কোথাও একটি স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের প্রতিশ্রুতি নেই। ১৯ নম্বর ধারা আরও বিমূর্ত—সেখানে বলা হয়েছে, ‘ফিলিস্তিনি জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণ ও রাষ্ট্রীয় কাঠামোর আকাঙ্ক্ষা’ স্বীকৃত হবে। লক্ষ করুন, এখানে ‘অধিকার’ বলা হয়নি, বলা হয়েছে ‘আকাঙ্ক্ষা’। আর সেই আকাঙ্ক্ষাও নির্ভর করছে গাজার ‘পুনর্গঠন অগ্রগতির’ ওপর এবং প্যালেস্টিনিয়ান অথরিটির ‘সততার সঙ্গে সংস্কার’ কার্যকর হওয়ার ওপর।
এ প্রক্রিয়ার বিচারক কে হবে? ইসরায়েল নিজেই।
এ পরিকল্পনাটি নতুন করে লেখার জন্য উইটকফ বা কুশনারের কলমের প্রয়োজন ছিল না। ফিলিস্তিনি জাতীয় স্বপ্নের সঙ্গে যেসব আরব ও মুসলিম নেতৃত্ব যুগের পর যুগ সংহতি প্রকাশ করেছেন, তাদের মুখ থেকে সেই প্রতিশ্রুতি অনেক আগেই অন্তর্হিত হয়েছে।
এই পুরো চুক্তির কোথাও নেই আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার, নেই ফিলিস্তিনিদের স্বতন্ত্র রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার স্বীকৃতি। ট্রাম্পের দৃষ্টিতে, নদী থেকে সাগর পর্যন্ত কেবল একটি রাষ্ট্রই স্বীকৃত—ইসরায়েল। ফিলিস্তিনিরা যেন তার চোখে শুধু পরিযায়ী শ্রমিক, নয় তো নিরাপত্তা হুমকি।
এ প্রতারণার পরিণতি আরও গভীর হয়ে ওঠে, যখন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প সাংবাদিক সম্মেলনে ফিরে তাকান তার আগের মেয়াদের দিকে। তিনি বললেন, কেমন করে তিনি একতরফাভাবে জেরুজালেমকে ইসরায়েলের রাজধানী হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছিলেন, কিংবা গোলান মালভূমি ইসরায়েলের দখলে নেওয়ার ঘোষণা দিয়েছিলেন। ‘আর জানো কী হয়েছে? দারুণ হয়েছে! সবাই বলেছিল, বিশ্ব শেষ হয়ে যাবে। কিন্তু কিছুই হয়নি।’
এ কথায় ধরা পড়ে, তিনি কেমন অবজ্ঞার দৃষ্টিতে দেখেন আরব প্রতিবেশীদের, তাদের ইতিহাস ও অবস্থানকে। তার গাজার ইতিহাসের বর্ণনা এতটাই বিকৃত যে, কোথা থেকে শুরু করা যায়, বলা মুশকিল।
ট্রাম্প বলেছিলেন, ২০০৫ সালে আরিয়েল শ্যারন গাজার সমুদ্রতীর ত্যাগ করেছিলেন শান্তির খোঁজে। তিনি ব্যঙ্গ করে বলেন, ‘তারা বলল, এখন আমরা কেবল শান্তি চাই।’ তার ভাষায়, হামাস এরপর সেই শান্তির হাতছানি উপেক্ষা করে ৪০০ মাইলের বেশি সুড়ঙ্গ বানিয়েছে, রকেট ফ্যাক্টরি গড়েছে এবং স্কুল, হাসপাতাল, মসজিদের নিচে সামরিক ঘাঁটি বসিয়েছে। ফলে, সেখানে হামলা চালালে বোঝা যায় না কোনটা হাসপাতাল, কোনটা যুদ্ধক্ষেত্র।
এই যে ব্যাখ্যা, সেটাই ট্রাম্পের মনে গেঁথে আছে। অথচ তিনি পুরোপুরি উপেক্ষা করেছেন এ সময়ের প্রকৃত ঘটনা—এ সময়ে হামাস ফিলিস্তিনি প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাসের অধীনে অনুষ্ঠিত একমাত্র নির্বাচনটি জিতে সরকার গঠন করে, যখন ফাতাহ দল ইসরায়েলের সহায়তায় একবার অভ্যুত্থান ঘটাতে চেয়েছিল, কিন্তু ব্যর্থ হয়। সেই সময় থেকেই শুরু হয় একটি নির্মম অবরোধ, যার বয়স এখন সতেরো বছর।
এই দুই বছরের গণহত্যাকে ট্রাম্প স্বাভাবিকীকরণ করেন, বলেন, হামাসের কারণে হাসপাতাল ও স্কুল ধ্বংস হয়েছে। অথচ তিনি একটিবারও স্বীকার করেন না, এ ধ্বংসযজ্ঞ যুদ্ধাপরাধের পর্যায়ে পড়ে, যা আন্তর্জাতিক আইনে গণহত্যা হিসেবেই বিবেচিত।
কিন্তু বাস্তবতা আরও কঠিন।
এই পরিকল্পনার নামে যে দুঃস্বপ্ন চালু হয়েছে, তা শুধু ফিলিস্তিনিদের জন্য নয়, সারা বিশ্বের জন্যও এক ভয়ানক দৃষ্টান্ত। টনি ব্লেয়ার আবার ফিরে এসেছেন। সেই মানুষ, যিনি আরিয়েল শ্যারনের জানাজায় তাকে ‘শান্তির মানুষ’ বলে বর্ণনা করেছিলেন—যদিও সেই শ্যারনের ট্যাংকই একদিন পথ করে দিয়েছিল সাবরা ও শাতিলায় গুলি চালানো ঘাতকদের জন্য। সেই ব্লেয়ারই আজ ‘বোর্ড অব পিস’-এর সদস্য।
ব্লেয়ারের ভূমিকাকে উপেক্ষা করা যায় না। রামাল্লার বাইরে আর কেউই হামাসকে জাতীয় ঐক্য সরকারের বাইরে রাখার ক্ষেত্রে এতটা সক্রিয় ছিলেন না। অথচ সেই ঐক্যই ছিল সংঘাত থামানোর একমাত্র পথ। ২০০৬ সালে হামাস যে নির্বাচনে জিতেছিল, তার ফল অস্বীকার করেছিলেন ব্লেয়ার। তিনি জর্জ বুশের সঙ্গে হাত মিলিয়ে হামাসকে বয়কট করেন। তারপর ‘কোয়াট্রেট’-এর শর্তে তৈরি হয় গাজার স্থায়ী অবরোধের ভিত্তি।
২০১০ সালে, যখন তার দূতের ভূমিকা শেষ, তখন ইসরায়েলি ইতিহাসবিদ আভি শ্লেইম বলেছিলেন, ‘ব্লেয়ারের ব্যর্থতা ফিলিস্তিনিদের স্বাধীনতা রক্ষায় দাঁড়াতে না পারা, আর এটাই ইসরায়েলি শাসকরা পছন্দ করে।’ সেই ব্লেয়ার, গত বছর যখন গাজায় গণহত্যা চলছে, তখন তেল আবিব বিশ্ববিদ্যালয় তাকে দিল ‘ড্যান ডেভিড প্রাইজ’। এক মিলিয়ন ডলারের সেই পুরস্কার দেওয়া হলো ‘নেতৃত্বের ব্যতিক্রমী বোধ, দূরদর্শিতা আর নৈতিক সাহসিকতার’ জন্য।
এসব দেখলে মনে হয়, কেউ যেন রক্তের দাগ মুছে দিয়ে পুরস্কার তুলে ধরছে আলোর মতো।
হামাসের সামনে এখন কোনো ভালো বিকল্প নেই। তারা যদি জিম্মিদের ছেড়ে দেয়, তবুও যুদ্ধ থামবে কি না, তার কোনো গ্যারান্টি নেই। বন্দি ফিলিস্তিনিদের মুক্তির বিষয়েও আর কোনো হাত থাকবে না তাদের। যদি চুক্তি প্রত্যাখ্যান করে, তবে যুদ্ধ চলবে, ট্রাম্পের সরাসরি সমর্থন নিয়ে।
সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, জর্ডান, মিশরের কাছ থেকে হতাশা নতুন কিছু নয়। কিন্তু তুরস্ক আর কাতার—যারা এতদিন গাজার পক্ষে ছিল—তাদের এই চুক্তিতে নাম থাকা যেন আত্মার বিক্রি। বহুবার তাদের সাবধান করা হয়েছিল ট্রাম্পের প্রতিশ্রুতি, আর মার্কিন বন্ধুত্ব নিয়ে। তবুও তারা আবার ফাঁদে পড়ল।
আজ যে প্রস্তাবিত সমাধান দাঁড়িয়েছে, তা ৬ অক্টোবর ২০২৩-এর আগের অবস্থার চেয়েও খারাপ। আজ ইসরায়েল শুধু গাজায় থাকার অনুমতি পায়নি; বরং এক ধরনের ‘গ্রিন লাইট’ পেয়েছে। তারা চাইলে আল-আকসা মসজিদেও ঢুকে পড়তে পারে, চাইলে আবার পশ্চিম তীরে বসতি গড়তে পারে।
এই সেই পুরোনো অসলো চুক্তির নকশা, শুধু আরও তীব্র রূপে। ফিলিস্তিনিরা যেন কেবল তখনই বাঁচতে পারবে, যদি তারা ইসরায়েলের ইচ্ছার কাছে নিজেকে সঁপে দেয়। যদি তারা তাদের স্বপ্ন গুটিয়ে নেয়, তাদের পতাকা গোপনে রেখে দেয়, আর যে জমি দখল হয়নি, সেই কোনায় গিয়ে বসে থাকে চুপচাপ।
এটাই ‘রেডিকালাইজেশন’-এর মানে। ফিলিস্তিনিদের আত্মপরিচয়কে মুছে ফেলা। আর যখন তারা চুপ করে থাকবে, তখন ইসরায়েলি দখলদার unfurl করবে ‘স্টার অব ডেভিড’ তাদের ধ্বংস হওয়া বাড়ি আর খামারের ওপরে।
এ মুহূর্তে, পৃথিবীর কোথাও ফিলিস্তিনিরা এতটা একা ছিল না। গাজার প্রতিরোধ, সাহস, আর অপরিসীম ত্যাগ দেখে যারা প্রতিদিন টেলিভিশনে চোখ রেখেছিল, সেই আরব ও মুসলিম নেতারাই আজ মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন। তারা বেছে নিয়েছেন নিরাপত্তা, ভয় আর স্বার্থ।
তাদের এই নিঃসঙ্গতা আরও দীর্ঘ হবে, যদি আমরা চুপ থাকি।
লেখক: মিডলইস্ট আইয়ের প্রধান সম্পাদক। মধ্যপ্রাচ্য বিশেষজ্ঞ। মিডলইস্ট আইয়ের মতামত বিভাগ থেকে বাংলা করেছেন তারেক খান
মন্তব্য করুন