(দ্বিতীয় কিস্তি)
মধ্যযুগের মুসলমানদের সবচেয়ে বড় অবদান ছিল বাংলা ভাষা ও মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যে হিন্দু-মুসলমানের সাংস্কৃতিক সমন্বয় প্রচেষ্টা বিশেষভাবে পরিলক্ষিত হয়। মধ্যযুগের মুসলমানদের সবচেয়ে বড় অবদান ছিল বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের ক্ষেত্রে। বাংলার স্বাধীন সুলতানদের সময়ে বাংলা ভাষায় ব্যাপকভাবে সাহিত্যচর্চার সূত্রপাত হয়। সুলতানদের অনেকেই হিন্দু-মুসলমান কবি এবং পণ্ডিতের সমাদর করে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের উৎকর্ষে অবদান রেখেছেন। বৈষ্ণব পদাবলী বাউল গান, মঙ্গলকাব্য—সর্বত্র হিন্দু-মুসলমানের সমন্বয়ের চিত্র দেখতে পাই। সাহিত্যক্ষেত্রে বাংলার মুসলিম লেখকগণ হিন্দুদের সংস্পর্শে এসে গভীরভাবে প্রভাবিত হয়েছেন। হিন্দু পুরাণ, তাদের আচার-বিশ্বাস বাঙালি মুসলমানের ওপর স্থায়ী প্রভাব বিস্তার করে।২৬ একটি উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে। সপ্তদশ শতাব্দীর কবি সৈয়দ আকবর রচিত ‘জেবল মূলক শামারোখ’ কাব্যের বন্দনা অংশে আছে :
বিনয় করিয়া বন্দি ফিরিস্তার পদ।
ছুন্নি কুলে ফিরিস্তা যে হিন্দুর নারদ॥
তক্ত সিংহাসনে বন্দি আল্লাহর দরবারে।
হিন্দু কুলে ঈশ্বর যে জগতে প্রচারে॥ ইত্যাদি।
এখানে মুসলমান কবির চোখে আল্লাহ-ঈশ্বর ফেরেশতা-নারদ আদম-অনাদি, রসুল-চৈতন্য, কোরান-পুরাণ অভিন্ন।২৭ সপ্তদশ শতাব্দীতে রায়মঙ্গল কাব্যের রচয়িতা কৃষ্ণরাম দাস এক দেবতার সৃষ্টি করেছেন, যার এক হাতে কোরান, অন্য হাতে পুরাণ।২৮ মধ্যযুগে ধর্মঠাকুরের পূজায় হিন্দু-বৌদ্ধ-মুসলমান সব ধর্মেরই অনুষ্ঠান অল্পবিস্তর সমন্বিত হয়েছে। ধর্মপূজাকে কেন্দ্র করেই শূন্যপুরাণ ও ধর্মমঙ্গল কাব্যগুলো রচিত হয়। রামাই পণ্ডিতের নামে প্রচলিত শূন্যপুরাণে হিন্দু দেবদেবীর মুসলমান পয়গম্বর বা রাসুলে রূপান্তরিত হওয়ার কৌতুকাবহ চিত্র :
ব্ৰহ্মা হৈল মহামদ বিষ্ণু হৈল পেগাম্বর
আদম হৈল শূলপাণি
গণেশ হইল কাজী কার্তিক হইল গাজী
ফকির হইল যত মুনি।
গাথা এবং গীতিকাগুলোতেও এ সমন্বয়ের চিত্র মেলে। ময়মনসিংহ গীতিকার ভূমিকাতে দীনেশচন্দ্র সেন বলেছেন : ‘হিন্দু ও মুসলমান যে বহু শতাব্দীকাল পরস্পরের সহিত প্রীতির সম্পর্কে আবদ্ধ হইয়া বাস করিতেছিলেন, এই গীতিগুলিতে তাহার অকাট্য প্রমাণ আছে।’
মনুয়া পালার মুসলমান গীতিকারের কাব্যে হিন্দু-মুসলমানের অভিন্ন সত্তা সহজ-সরল উপমায় উদ্ভাসিত হয়েছে:
হেঁদু আর মোছলমান একই পিণ্ডির দড়ি
কেহ বলে আল্লাহ আর কেহ বলে হরি।
এমনি অসংখ্য উদাহরণ আছে। সৈয়দ সুলতান নবীবংশ কাব্যে ব্ৰহ্মা, বিষ্ণু, শিব প্রমুখ হিন্দু দেবতাদের নবীবংশের অন্তর্গত বলে মনে করেছেন। হিন্দু-মুসলিম ভাবাদর্শের এই মিলনপ্রবাহ উনিশ শতকের মধ্যভাগ পর্যন্ত বহমান ছিল।৩২ বস্তুত সাধারণ বাংলাভাষী হিন্দু-মুসলমানের চেহারা, আচার-আচরণ, খাদ্যাভ্যাস, গৃহনির্মাণ-কৌশল, আসবাবপত্র, তৈজসপত্র, কৃষি যন্ত্রপাতি, ফসল উৎপাদন পদ্ধতি, খেলাধুলা, গান-বাজনা, অস্ত্রশস্ত্র, গহনাগাটি, পোশাক-পরিচ্ছদ সবকিছুতে এত অভিন্নতা ছিল ৩ যে, বহিরঙ্গে অন্তরঙ্গে এই মিল দেখেই তুর্কিরা এ দেশে এসে বাঙালি নামে ভূষিত করেছিল এদের, বিদেশির চোখে এরা এক জাতি হিসেবেই পরিগণিত হয়েছিল।
তবু এ সমন্বয় সার্বিক, সফল এবং স্থায়ী হয়নি এবং হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে বাঙালির সমন্বিত জাতিসত্তার প্রশ্নেও ঐতিহাসিকরা একমত নন। রমেশচন্দ্র মজুমদার হিন্দু-মুসলমানের সমন্বিত সংস্কৃতির ধারণাকে সম্পূর্ণ নস্যাৎ করে দিয়েছেন। তার মতে, দুটি সম্প্রদায় ছোটখাটো বিষয়ে একে অন্যের ওপর প্রভাব বিস্তার করলেও সংস্কৃতি—যা ধর্মবিশ্বাস, সামাজিক নীতি, আইনকানুন, সাহিত্য, দর্শন, শিল্প—এসব কিছুর মধ্য দিয়ে প্রকাশিত হয়, সেখানে কোনো উল্লেখযোগ্য মৌলিক পরিবর্তন সাধিত হয়নি। ধর্ম ক্ষেত্রে সুফিদের প্রভাব সম্পর্কেও তার মত হচ্ছে, আউল-বাউল প্রভৃতি কয়েকটি অতি ক্ষুদ্র সম্প্রদায়ের মধ্যেই তা সীমাবদ্ধ ছিল। পীর প্রসঙ্গে তিনি বলেন, হিন্দুরা মুসলমান পীরকে ভক্তি করলেও গৃহে ঢুকতে দিত না এবং তাদের স্পর্শ করা পানীয় অথবা খাদ্য গ্রহণ করত না। বাংলা সাহিত্যের ক্ষেত্রে মুসলিম শাসকদের অবদান সম্পর্কেও তিনি নেতিবাচক ধারণা পোষণ করেন। তিনি মনে করেন, সুলতানদের পৃষ্ঠপোষকতা ছাড়াও বাংলা সাহিত্য কালের বিবর্তনে স্বয়ং প্রতিষ্ঠিত হতো।
প্রকৃতপক্ষে অশিক্ষা ও অনুদারতার ফলে জনসাধারণের মনে ঐক্য আর সমন্বয় প্রয়াস সুদূরপ্রসারী ফলাফল বয়ে আনেনি। অভিন্ন জীবিকার কারণে কর্মক্ষেত্রে হয়তো তারা মিলিত হয়েছে, জীবন দর্শনে মেলেনি। পাশাপাশি থেকেও মনের কাছাকাছি হয়নি। মন বিচ্ছিন্ন এবং বিপরীতমুখী থেকে গেছে।৩৫ আসলে যে ধর্ম-সমন্বয় এবং ঐক্যের প্রচেষ্টা ভারতের সর্বত্র শুরু হয়েছিল, নানক, কবির, রজ্জব, দাদু, চৈতন্য, সম্রাট আকবর—এসব মনীষীর সাধনায় এবং মানবধর্মের সাধারণ নিয়মেই যে সম্প্রীতির বন্ধন দৃঢ়তর হতে পারত, অখণ্ড জাতিসত্তার বিকাশ ঘটতে পারত, বিভিন্ন কারণে সেটি হয়ে ওঠেনি। বরং কালপ্রবাহে, স্বার্থের সংঘাতে হিন্দু-মুসলমানের দূরত্ব বেড়েছে, কমেনি।
দুই. মুসলমান অধিকৃত বাংলায় বখতিয়ার খিলজির সময় থেকে শুরু করে ১৩৩৮ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত শাসন করেন দিল্লির অধীনস্থ সুলতানরা। ১৩৩৮ খ্রিষ্টাব্দে ফখরুদ্দীন মুবারক শাহ্ বাংলার প্রথম স্বাধীন সুলতান হন। এরপর ১৫৭৬ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত কেবল শের শাহ্ রাজত্বের স্বল্পকাল ছাড়া বাংলাদেশ স্বাধীন ছিল। এ সময়ে হিন্দু-মুসলমান দুই সম্প্রদায়ের মিলিত প্রচেষ্টায় বাংলাদেশ শাসিত হয়েছিল। বাংলার সুলতানরা হিন্দু-মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের আস্থা অর্জন করেছিলেন।
১৫৭৬ খ্রিষ্টাব্দের পর বাংলা সুবা বাংলা নামে মোগল শাসনের অধীনস্থ হয়। মোগল আমলে বাংলার প্রশাসনে বাঙালির ভূমিকা ছিল নিতান্তই গৌণ।
অষ্টাদশ শতাব্দীতে বাংলার উল্লেখযোগ্য ঘটনা হলো নবাবি শাসনের বিকাশ ও পতন। নবাবি প্রশাসনে বাঙালিদের অন্তর্ভুক্ত করা হয়—তখন বানিয়া, মুৎসুদ্দি, বড় জমিদার এবং আমলা শ্রেণি তৈরি হয় উচ্চবর্ণের হিন্দুদের নিয়ে। প্রশাসনে হিন্দুদের অংশগ্রহণ নবাবদের রাষ্ট্রনীতির প্রশংসনীয় দিক বলা যেতে পারে। কিন্তু এই প্রক্রিয়ায় স্থানীয় বাঙালি মুসলমানের কোনো স্থান ছিল না।৩৮ যদিও রাষ্ট্রের বিচার বিভাগ মুসলমানদের দখলে ছিল, অনেক উচ্চপদও মুসলমান আমলাদের নিয়ন্ত্রণাধীনে ছিল। এরা প্রায় সবাই ছিলেন অভ্যাগত মুসলমান, এতে স্থানীয় বাঙালি মুসলমানের সংখ্যা ছিল না বললেই চলে।৩৯ সপ্তদশ শতকের শেষ থেকেই সুবা বাংলায় ব্রিটিশ আধিপত্য বিস্তারের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল। ১৭৫৭ সালের পলাশীর যুদ্ধ এ প্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত এবং নিশ্চিত করলেও প্রকৃতপক্ষে এ দেশে ব্রিটিশ শাসন প্রতিষ্ঠিত হয় পর্যায়ক্রমে। ১৭৯৩ সালে নবাবি ক্ষমতা এবং শাসনব্যবস্থা সম্পূর্ণ বিলুপ্ত করে শ্বেতাঙ্গদের ঔপনিবেশিক শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়।
বাংলার পরিবর্তনবিমুখ নিস্তরঙ্গ সমাজের মানুষ প্রথম থেকেই ব্রিটিশ শাসনকে প্রতিরোধের চেষ্টা করেছে। কোম্পানির রাজত্বের প্রথম দিকে যে দায়িত্বহীন দুঃশাসন, অভাবনীয় অরাজকতা, শোষণমুখী রাজস্বনীতি, অর্থনৈতিক বিপর্যয়, সম্পদ পাচার, দুর্ভিক্ষ আর মৃত্যুর মর্মন্তুদ হাহাকার শোনা গেছে, সেগুলোর ভুক্তভোগী সাধারণ মানুষ বিনাপ্রতিরোধে ব্রিটিশ আধিপত্যকে স্বীকার করেনি। সমকালীন রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটের ভিন্নতার কারণে দেশের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনে সাধারণ মানুষ থাকত উদাসীন। কিন্তু তার ধর্ম, প্রথা, বিশ্বাস, আচারে হস্তক্ষেপ হলে কিংবা চরম অর্থনৈতিক শোষণ প্রক্রিয়া চালান হলে—এককথায় সাংস্কৃতিক এবং অর্থনৈতিক আগ্রাসনের মুখোমুখি হলে মানুষ প্রতিরোধ করত। পূর্ববর্তী মোগল শাসকরা অভ্যন্তরীণ সমাজব্যবস্থায় সহজে হস্তক্ষেপ করেনি, ঔপনিবেশিক স্বার্থে ব্রিটিশ শাসক হস্তক্ষেপ করে, ফলে তাকে প্রতিরোধের সম্মুখীন হতে হয়। জমিদার রায়ত, ধর্মীয় সম্প্রদায়, ফকির সন্ন্যাসী, ব্যবসায়ী, কারিগর, সিপাহি, উপজাতি সম্প্রদায় সবাই কোনো না কোনো সময় অতিষ্ঠ হয়ে ব্রিটিশের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছে। কিন্তু এসব প্রতিরোধ সর্বশ্রেণির সর্বাত্মক জাতীয় আন্দোলনে রূপান্তরিত হয়নি। কারণ দেশ জোড়া সর্বাত্মক অভ্যুত্থানের সংগঠন ও পরিচালনার জন্য যে আদর্শ, লক্ষ্যের ঐক্য, সংগ্রামী ও সাংগঠনিক অভিজ্ঞতার প্রয়োজন, বোধগম্য কারণেই তার অভাব ছিল সেই সময়ে। তবে লক্ষ করার বিষয়, ধর্মসংস্কার আন্দোলন হিসেবে যেসব বিদ্রোহ সংঘটিত হয়, পরবর্তীকালে হিন্দু-মুসলমান সম্পর্কের ক্ষেত্রে সেগুলো সুদূরপ্রসারী প্রভাব বিস্তার করেছিল।
অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষভাগ থেকে ভারতের শ্বেতাঙ্গ-অধিকৃত এলাকায় ব্যাপক কৃষক বিদ্রোহ দেখা দিলে, ইংরেজ শাসকরা বিচলিত হয়ে পড়ে। নব প্রতিষ্ঠিত ব্রিটিশ শাসকদের আত্মরক্ষার তাগিদেই দেশের মধ্যে একদল কায়েমি স্বার্থসম্পন্ন সমর্থক সৃষ্টির প্রয়োজন হয়। তাই ১৭৯৩ খ্রিষ্টাব্দে ব্রিটিশরা চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের মধ্য দিয়ে একদল নব্য জমিদার শ্রেণি তৈরি করল। এতে নবাবি আমলের সুবিধাভোগী অভিজাত হিন্দু ও মুসলমান উভয়েই ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তাদের বদলে নতুন একদল জমিদার ও মধ্যস্বত্বভোগী সৃষ্টি হয়, যাদের অধিকাংশই ছিল হিন্দু। এই নব্য জমিদারশ্রেণি ইংরেজদের স্বার্থ সংরক্ষণ করেছিল ঠিকই, কিন্তু এতে এ দেশের কৃষকরা সর্বস্বান্ত হয়ে গিয়েছিল। (চলবে)
লেখক : অধ্যাপক (খণ্ডকালীন) নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটি
মন্তব্য করুন