আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতাচ্যুতের পাঁচ দিন পর বাংলাদেশ ডেন্টাল সোসাইটির (বিডিএস) মহাসচিবকে পদত্যাগে বাধ্য করা হয়। এরপর একটি পক্ষ সভাপতি অধ্যাপক ডা. আবুল কাসেমের চেম্বারে গিয়ে তার কাছ থেকে সব কমিটি বাতিল ও নির্বাচন কমিশন গঠনের বিজ্ঞপ্তিতে সই নেয়। তবে এই প্রক্রিয়া গঠনতন্ত্র পরিপন্থি বলে মন্তব্য করেছেন সোসাইটির বেশিরভাগ সদস্য। যদিও এ প্রক্রিয়াকে বৈধ বলেই দাবি করেন নির্বাচন কমিশনের সদস্যরা। তারা বলছেন, গঠনতন্ত্র মেনেই নির্বাচন কমিশন গঠন করা হয়েছে। তবে এই কমিশন বাতিল করে গঠনতন্ত্রের আলোকে নতুন কমিশন গঠনে আইনি নোটিশও পাঠানো হয়েছে। চলতি মাসের শুরুতে আরেক বিজ্ঞপ্তিতে সোসাইটির সভাপতি নির্বাচন কমিশন বিলুপ্তও করেন এবং গ্রহণযোগ্য নির্বাচন কমিশন গঠনে সাত সদস্যের সার্চ কমিটি ঘোষণা করেন। ফলে সংগঠনটির সাংগঠনিক কার্যক্রম এবং নির্বাচন নিয়ে এখনো ধোঁয়াশা রয়ে গেছে বিডিএসে।
বিডিএস সূত্র জানায়, ১৯৭৭ সালে প্রতিষ্ঠিত সংগঠনটির সবশেষ নির্বাচন হয় ২০১৫ সালে। তিন বছর মেয়াদি ওই কমিটির মেয়াদ শেষ হয় ২০১৮ সালে। মেয়াদ শেষেও বছরের পর বছর ধরে আওয়ামী লীগ সমর্থিত স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদের (স্বাচিপ) নেতৃবৃন্দ নির্বাচন আয়োজন না করে সংগঠনটি কুক্ষিগত করে রাখে। আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর গত ১০ আগস্ট সোসাইটির একটি পক্ষ মহাসচিব ডা. হুমায়ুন কবীর বুলবুলকে ফেসবুকে পদত্যাগের ঘোষণা দিতে বাধ্য করেন। যদিও মহাসচিব লিখিতভাবে পদত্যাগপত্র জমা দেননি। একই দিন তারা সোসাইটির সভাপতি অধ্যাপক ডা. আবুল কাসেমের চেম্বারে গিয়ে জোরপূর্বক কার্যকরী পরিষদ, জেলা শাখা, উপকমিটি বিলুপ্তি ও অধ্যাপক ডা. সালাউদ্দিন আল আজাদকে (সোহাগ) প্রধান নির্বাচন কমিশনার, ডা. এস এম এম তানভীর ইসলাম ও ডা. সিফাত উদ্দিন খানকে নির্বাচন কমিশনার করে তিন সদস্যের নির্বাচন কমিশন গঠনের হাতে লেখা বিজ্ঞপ্তিতে সই করতে বাধ্য করেন। অভিযোগ ওঠে, সোসাইটির সভাপতির চেম্বারে গিয়ে জোরপূর্বক সই নেওয়া ওই বিজ্ঞপ্তি সদ্য বিলুপ্ত নির্বাচন কমিশনের প্রধান নিজেই লেখেন। যদিও এ কাজ সোসাইটির গঠনতন্ত্রবিরোধী। তবে, এস এম এম তানভীর ইসলাম বলেন, ‘গঠনতন্ত্র মেনেই বৈধভাবে নির্বাচন কমিশন গঠন করা হয়েছে। সবশেষ নির্বাচন হয়েছে ২০১৫ সালে। আমরা চাই এখন সুন্দর একটা নির্বাচনের মাধ্যমে সোসাইটি গতিশীল হোক।’
প্রধান নির্বাচন কমিশনারই সভাপতির সই করা বিজ্ঞপ্তি লিখেছেন কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এ অভিযোগ মিথ্যা। সোসাইটির সভাপতি কাসেম স্যার ক্ষমতাবলে একটা নির্বাচন কমিশন গঠন করেছেন। তিনি যখন নির্বাচন কমিশন গঠন করেছেন তখন কার্যকরী কমিটি ও অন্যান্য কমিটি গঠনতান্ত্রিকভাবে রহিত হয়ে যায়। গঠনতন্ত্রে স্পষ্ট বলা আছে, সোসাইটির মহাসচিব পদত্যাগ করলে সভাপতি ক্ষমতাবলে নির্বাচন কমিশন গঠন করতে পারেন। তিন বছর পর যদি নির্বাচিত সোসাইটি নির্বাচন না দেয় তাহলে গঠনতন্ত্র অনুযায়ী তার কার্যক্ষমতা কমে যাবে, তারা শুধু রুটিন কাজ করতে পারবেন।’ সদস্যপদ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘গঠনতন্ত্র অনুযায়ী নির্বাচন কমিশনে এক বছরের সাবস্ক্রিপশন চাঁদা দিয়ে সরকারি মেডিকেল কলেজ থেকে বিডিএস পাস অথবা বিএমডিসি নিবন্ধিত থাকলেই সদস্য হতে পারবেন।’
তবে বিডিএসের গঠনতন্ত্রের ১৮ ধারার ১ উপধারায় বলা হয়েছে, কার্যকরী পরিষদ উত্তরাধিকার নির্বাচিত না হওয়া পর্যন্ত স্বীয় দায়িত্বে থাকবে। কোনো কারণে সভাপতি পদত্যাগ করলে তা কার্যকর হবে, যদি কেন্দ্রীয় কাউন্সিল এই বিষয়ে সম্মত হয়। সেক্ষেত্রে সভাপতির দায়িত্বে পালন করবেন সহসভাপতি।
গঠনতন্ত্রের ১৯(৩) ধারা অনুয়ায়ী, নির্দিষ্ট সময়ের পর তিন বছরের মধ্যে নির্বাচন না হলে অব্যবহিত পূর্ববর্তী নির্বাচন কমিশন নির্বাচনের দায়িত্ব পালন করবেন। এক্ষেত্রে কার্যকরী পরিষদ, কেন্দ্রীয় কাউন্সিল বা সাধারণ পরিষদের অনুমোদনের প্রয়োজন নেই। গঠনতন্ত্র অনুযায়ী সভাপতি নির্বাচন কমিশন অনুমোদনের এখতিয়ার রাখেন না। তবু নিয়মনীতি উপেক্ষা করে গঠিত এই নির্বাচন কমিশন গত ২৮ সেপ্টেম্বর নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করেছে। মাত্র তিন দিনের মাথায় গত ১ অক্টোবর থেকে মনোনয়নপত্র সংগ্রহ এবং ৫০০ টাকা চাঁদার বিনিময়ে সদস্য সংগ্রহের বিজ্ঞপ্তি দেয়।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, গঠনতন্ত্রের ৫(১) ধারা অনুযায়ী কাউকে সোসাইটির সদস্য হিসেবে অনুমোদন দিতে পারে কার্যকরী পরিষদ, নির্বাচন কমিশন নয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে গত ৩ অক্টোবর সোসাইটির সভাপতি অধ্যাপক ডা. মো. আবুল কাসেম নির্বাচন কমিশন গঠন পরিপত্র বাতিল করেন। একটি অবাধ, নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশন গঠনে সার্চ কমিটি গঠনের ঘোষণা করেন। এর পরও ওই নির্বাচন কমিশন তড়িঘড়ি করে একটি নির্বাচন আয়োজনের চেষ্টা অব্যাহত রেখেছে।
নির্বাচন নিয়ে পাল্টাপাল্টি অবস্থানের ঘটনায় সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী আবদুল্লাহ সাদিক বিডিএসের নির্বাচন স্থগিতকরণ ও গত ১০ আগস্ট গঠিত নির্বাচন কমিশন বাতিলে আইনি নোটিশ পাঠিয়েছেন। এতে বিবাদী করা হয়েছে, সোসাইটির সভাপতি অধ্যাপক ডা. মো. আবুল কাসেম, মহাসচিব অধ্যাপক ডা. হুমায়ুন কবির বুলবুল এবং প্রধান নির্বাচন কমিশনার অধ্যাপক ডা. এস এম সালাহউদ্দীন আল আজাদকে। নোটিশে বলা হয়, ‘গত ১০ আগস্ট সোসাইটির নির্বাচিত সভাপতিকে একটি অনভিপ্রেত এবং অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার মুখোমুখি করে জোরপূর্বক সই নিয়ে তিন সদস্যের নির্বাচন কমিশন গঠন করা হয়। এই নির্বাচন কমিশন বাংলাদেশ ডেন্টাল সোসাইটির গঠনতন্ত্র অনুসারে না হওয়ায় এবং তার কার্যক্রম সব ডেন্টাল সার্জনের স্বার্থের বিরোধী হওয়ায় গত ৩ অক্টোবর সোসাইটির নির্বাচিত সভাপতি নির্বাচন কমিশন গঠনের পরিপত্রটি বাতিল করে। ফলে এই নির্বাচন কমিশনের কোনো নির্বাচন পরিচালনা করার বৈধতা নেই।’
এদিকে সোমবার ডেন্টাল সোসাইটির নির্বাচন পরিচালনায় সর্বজনগ্রাহ্য নির্বাচন কমিশন গঠনে সাত সদস্যের সার্চ কমিটি গঠন করা হয়। সংগঠনটির সভাপতি অধ্যাপক ডা. মো. আবুল কাসেমের সই করা বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, ডেন্টাল সোসাইটি নির্বাচন নিয়ে উদ্ভূত পরিস্থিতির আলোকে সার্চ কমিটি গঠনে ৬ অক্টোবর সকাল ৯টায় জ্যেষ্ঠ ডেন্টাল সার্জনদের নিয়ে সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। সভায় সর্বসম্মতিক্রমে সার্চ কমিটি গঠনে নাম আহ্বান করা হয়। কমিটির সদস্য নির্বাচনের বিষয়ে বলা হয়, অনেক যাচাই-বাছাই করে প্রস্তাবিত নাম থেকে আমরা দেশের সব ডেন্টাল সার্জনদের পক্ষ থেকে সোসাইটির নির্বাচন পরিচালনায় সার্চ কমিটি গঠন করেছি। আশা করি, এই সার্চ কমিটি শিগগিরই নিরপেক্ষ নির্দলীয় এবং অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন কমিশন গঠন করবে। সার্চ কমিটির সদস্যরা হলেন অধ্যাপক
ডা. মোহাম্মদ আশরাফ হোসেন, অধ্যাপক ডা. নাসির উদ্দিন, ডা. মো. জোবাইদুল আলম তালুকদার, ডা. উম্মে কুলসুম রোজি, ডা. মাহফুজুর রায়হান, ডা. তৈয়বুর রহমান শিকদার ও ডা. আব্দুল্লাহ খান।
বিডিএসের সভাপতি অধ্যাপক ডা. আবুল কাসেম বলেন, ‘প্রথমদিকে আমাকে পদত্যাগ করতে হয়েছে। পদত্যাগের আগে তিন সদস্যের একটা নির্বাচন কমিশন গঠন করা হয়েছিল।’ গঠনতন্ত্র অনুযায়ী সেটি করা যায় কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘ওই সময় নির্বাচন কমিশন গঠন ছাড়া কোনো পথ ছিল না। ওই সময় গঠনতন্ত্র অনুসরণের পরিস্থিতি ছিল না। সোসাইটি সঠিকভাবে এগিয়ে যাক। সবাই মিলে নতুন করে নির্বাচন হোক। এটাই আমি চাই।’