বিশেষ প্রতিনিধি
প্রকাশ : ২৩ মে ২০২৫, ১২:০০ এএম
আপডেট : ২৩ মে ২০২৫, ০৭:৪১ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

কুয়ালালামপুর বিমানবন্দরে আটকে হাজারো শ্রমিক

মানবেতর জীবনযাপন
কুয়ালালামপুর বিমানবন্দরে আটকে হাজারো শ্রমিক

বৈধভাবে যাওয়ার সুযোগ না পেয়ে প্রতিনিয়ত অবৈধভাবে মালয়েশিয়া যাচ্ছেন হাজার হাজার শ্রমিক। দালাল চক্রের প্রলোভনে পড়ে তারা মালয়েশিয়া গিয়ে মানবেতর জীবন যাপন করছেন। কুয়ালালামপুর থেকে সোমবার ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্সের বিএস ৩১৬ ফ্লাইটে ৪০ জন যাত্রীকে ফেরত পাঠানো হয়। যারা ট্যুরিস্ট ভিসা নিয়ে শ্রমিক হিসেবে মালয়েশিয়া প্রবেশের চেষ্টা করছিল। এই ৪০ জন ব্যক্তি ৩ থেকে ৫ লাখ টাকা পর্যন্ত ব্যয় করে ট্যুরিস্ট ভিসায় মালয়েশিয়ায় গিয়েছিলেন। মালয়েশিয়ার ইমিগ্রেশন পুলিশ তাদের ফেরত পাঠিয়েছে। তাদের মতো আরও ১ হাজার শ্রমিক মালয়েশিয়ার বিমানবন্দরে আটকা থেকে মানবেতর জীবন যাপন করছেন। এ ছাড়া অভিবাসী ক্যাম্পে আটকে পড়ে আছে অবৈধভাবে যাওয়া কয়েক হাজার শ্রমিক। কুয়ালালামপুরের বাংলাদেশ দূতাবাসের কর্মকর্তারা শ্রমিক আটক থাকার বিষয়টি স্বীকার করলেও তাদের প্রকৃত সংখ্যা জানাতে পারেননি।

ফেরত আসা শ্রমিকদের একজন মুন্সীগঞ্জের হেলেনা বেগম। উড়োজাহাজে বসে আলাপকালে কালবেলাকে জানান, সুদে সাড়ে তিন লাখ টাকা নিয়ে স্থানীয় একজন দালালের মাধ্যমে গত ১৬ মে সকালে মালয়েশিয়া যান। তাকে ২২ দিনের ট্যুরিস্ট ভিসা দেওয়া হয়। কথা ছিল এয়ারপোর্ট কন্ট্রাক্ট করে তাদের নিয়ে যাবে। কিন্তু মালয়েশিয়ান ইমিগ্রেশন পুলিশের সন্দেহ হলে তাদের আটক করা হয়। তিন দিন পর ফিরতি বিমানে বাংলাদেশে ফেরত পাঠানো হয়েছে। হেলেনা বেগম বলেন, স্বামী মারা যাওয়ার পর দুই সন্তান নিয়ে কষ্টে দিন কাটছে। তাই দালালের প্রলোভনে পড়ে সুদে সমিতি থেকে টাকা এনে মালয়েশিয়া যান। তিনি জানান, বিমানবন্দরে তার মতো আর প্রায় ১ হাজার লোক আটক আছে। তাদের অনেকে বাংলায় কথা বলেন। সেখান থেকে তার ধারণা, এরা সবাই বাংলাদেশি।

ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্সের একই ফ্লাইটে কুয়ালালামপুর থেকে ঢাকায় আসেন শরীয়তপুরের বাসিন্দা ইলিয়াস হোসেন। তিনি বলেন, ‘গত ১৬ মে সকাল ৮টা ২৫ মিনিটে ঢাকা থেকে কুয়ালালামপুরে পৌঁছান। বিমানবন্দরে নেমে দালালকে ১ লাখ টাকা দিয়েছেন। দালাল কিছুক্ষণ পরপর বলে, এক ঘণ্টা পর বের করব, আর দুই ঘণ্টা থাকেন। এভাবে দালাল দুদিন শুধু ঘুরিয়েছে। খাবার নেই, পানি নেই। ১৮ মে আমাদের বলে ইমিগ্রেশনে গিয়ে ধরা খা। তোদের বাংলাদেশে নিয়ে আসতেছি। ইমিগ্রেশন আমাদের আটক করে একদিন জেলে রাখে। পরে ১২০ রিঙ্গিত জরিমানা করে। জরিমানার টাকা পরিশোধ করার পর ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্সের ফ্লাইটে তুলে দেয়।’ ইলিয়াস বলেন, আমার মতো এরকম প্রায় আরও ১ হাজারের বেশি মানুষ বিমানবন্দরে আটকা আছে। একই তথ্য জানালেন যশোরের পাইকগাছার রবিউল হোসেন।

দালাল শাহ আলমের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি জানান, বারিধারার হিউম্যান রিসোর্স লিমিটেড নামে একটি প্রতিষ্ঠানের হয়ে তিনি কাজ করেন। ওই দেশে আফিয়া ওভারসিজের আলতাব খানের লোকজন শ্রমিকদের রিসিভ করে নিয়ে যাওয়ার কথা। ফেরত আসা শ্রমিক ইলিয়াস হোসেন বলেন, মালয়েশিয়ান ইমিগ্রেশন অফিসের কারাগারে আমাদের দেশের ১ হাজারের বেশি শ্রমিক আছেন। এ দেশের মধ্যে যাদের ফিরতি টিকিট আছে, তাদের ফেরত পাঠানো হচ্ছে আর যাদের ফিরতি টিকিট নেই এবং জরিমানার টাকা দিতে পারছে না, তাদের কারাগারে পাঠানো হচ্ছে।

এদিকে গত সোমবার মালয়েশিয়ার সীমান্ত নিয়ন্ত্রণ ও সুরক্ষা সংস্থার (একেপিএস) এক বিবৃতিতে জানানো হয়েছে, বিমানবন্দরে অবতরণের ছয় ঘণ্টার বেশি সময় পরও ইমিগ্রেশন কাউন্টারে উপস্থিত না হওয়ায় ১১২ জনকে ফেরত পাঠানো হয়েছে। একেপিএসের মনিটরিং ইউনিটের নিয়মিত নজরদারি অভিযানের সময় বিভিন্ন দেশের প্রায় ৩০০ ব্যক্তিকে পরীক্ষা করে ওই ১১২ জনকে শনাক্ত করা হয়। এর মধ্যে কতজন বাংলাদেশি ছিলেন, সেটা জানায়নি একেপিএস।

বিবৃতিতে একেপিএসে উল্লেখ করা হয়েছে, ‘যারা দীর্ঘক্ষণ ধরে বিমানবন্দরে অবস্থান করছিলেন, তাদের অনেকেই ইচ্ছাকৃতভাবে ইমিগ্রেশন কাউন্টারে যাননি। বিদেশি নাগরিকদের এই ধরনের আচরণ মালয়েশিয়ায় প্রবেশের উদ্দেশ্য সম্পর্কে সন্দেহ তৈরি হয়। ফলে তাদের আটক করা হয়। আটক ব্যক্তিদের মধ্যে বাংলাদেশি ছাড়াও ভারত ও পাকিস্তানের নাগরিক ছিল। একেপিএস জানায়, আটককৃতরা মূলত পর্যটক হিসেবে প্রবেশের দাবি করলেও তারা ইমিগ্রেশন কাউন্টারের দিকে আগাননি। বরং বিমানবন্দরের বিভিন্ন জায়গায় ঘোরাফেরা করছিলেন এবং বিশেষ কারও জন্য অপেক্ষা করছিলেন বলে সন্দেহ করা হয়। আটকদের আরও তদন্ত ও পরিদর্শনের জন্য বিমানবন্দরের একেপিএস মনিটরিং ইউনিট অফিসে নিয়ে যাওয়া হয়। তাদের বিরুদ্ধে প্রবেশ প্রত্যাখ্যানের আনুষ্ঠানিক সিদ্ধান্ত জারি করা হয়।

মালয়েশিয়ান দূতাবাসের কাউন্সিলর (রাজনৈতিক) প্রণব কুমার ভট্টাচার্য্য কালবেলাকে আলাপকালে বলেন, প্রায় প্রতিনিয়ত ট্যুরিস্ট ভিসা নিয়ে শ্রমিকরা অবৈধভাবে মালয়েশিয়া প্রবেশের চেষ্টা করেন। এক শ্রেণির ট্রাভেল এজেন্সির মালিক এই চক্রে জড়িত। তারা শ্রমিকদের নানা প্রলোভন দেখিয়ে মালয়েশিয়া নিয়ে যায়। শ্রমিকরা ইমিগ্রেশন পুলিশের হাতে আটক হয়ে অভিবাসী ক্যাম্পে মানবেতর জীবন যাপন করেন।

বাংলাদেশ থেকে বৈধভাবে জনশক্তি রপ্তানি সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানান, ‘জনশক্তি রপ্তানিকারকদের সংগঠন বায়রার বহিষ্কৃত নেতা ফকরুল ইসলাম অনেক দিন থেকেই অবৈধভাবে বা ট্যুরিস্ট ভিসায় শ্রমিক পাঠানোর কারবার করছেন। তিনি এখান থেকে শ্রমিক পাঠালে ওই শ্রমিকদের রিসিভ করেন আফিয়া ওভারসিজের আলতাব খান নামে এক ব্যবসায়ী। তিনি কুয়ালালামপুর বিমানবন্দরে ইমিগ্রেশন পুলিশের সঙ্গে কন্ট্রাক্ট করে শ্রমিকদের বের করে নেন। এই অবৈধ শ্রমিকরা কাজ না পেয়ে মানবেতর জীবন যাপন করেন। তাদের দিনের পর দিন এমনকি বছরের পর বছর পালিয়ে বেড়াতে হয়। পুলিশের হাতে ধরা পড়লে তাদের ফেরত পাঠানো হয়।

জনশক্তি রপ্তানি সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরা জানান, বারিধারার হিউম্যান রিসোর্স লিমিটেড নামে একটি প্রতিষ্ঠানের মালিক বায়রার বহিষ্কৃত নেতা ফকরুল ইসলাম। তিনি দীর্ঘদিন থেকে অবৈধপথে শ্রমিক পাঠানোর কারবারে জড়িত। তিনি চান না মালয়েশিয়ায় বৈধভাবে শ্রমিক যাক। তাই যখনই সরকার মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার খোলার উদ্যোগ নেয়, তখনই বৈধ অভিবাসনের বিরুদ্ধে কথা বলতে শুরু করেন। গত সোমবার ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে তিনি সংবাদ সম্মেলন করতে গিয়ে সাধারণ সদস্যদের রোষানলে পড়েন।

অন্য এজেন্সি আফিয়া ওভারসিজের মালিক আলতাব খান অবৈধ মানব পাচারের অভিযোগে মালয়েশিয়ায় আটক হয়েছেন। তার বিরুদ্ধে মালয়েশিয়ান সরকার এরই মধ্যে মামলা করেছে। তার পাসপোর্ট জব্দ করে রাখা হয়েছে। তিনি জামিনে বেরিয়ে ফের অবৈধভাবে শ্রমিক নেওয়ার কাজ করেন। এ ছাড়া টেকনাফ, কক্সবাজার ও পটুয়াখালী থেকে ট্রলারে নৌপথে যে মানব পাচার হয়, এই চক্রের সঙ্গে ফকরুল-আলতাফ খানদের জড়িত থাকার অভিযোগ রয়েছে।

বায়রার এক নেতা জানান, যখনই সরকার মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার খোলার উদ্যোগে নেয়, তখনই বায়রার বিপথগামী একটি গ্রুপ প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়ায়। বাজার খুলতে বাধা দেয়। এই গ্রুপটি মূলত অবৈধভাবে শ্রমিক পাঠানোর চক্রে জড়িত। তারা চায় না বৈধভাবে শ্রমিক যাক। কারণ, বৈধভাবে শ্রমিক গেলে তাদের অবৈধ শ্রমিক পাঠানোর ব্যবসা হুমকির মুখে পড়ে। তারা আরও জানান, অবৈভাবে শ্রমিক মালয়েশিয়ায় গেলে দেশটিতে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয়। আমাদের দেশ থেকে শ্রমিক নিতে অনীহা প্রকাশ করে। আবার অন্যদিকে মালয়েশিয়াও আন্তর্জাতিকভাবে ভাবমূর্তি সংকটে পড়ে। তাদের পণ্য রপ্তানি বাধাগ্রস্ত হয়। তাই অবৈধপথে শ্রমিক পাঠানো বন্ধ করা জরুরি।

জনশক্তি রপ্তানিকারকদের সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ইন্টারন্যাশনাল রিক্রুটিং এজেন্সিসের (বায়রা) মহাসচিব আলী হায়দার চৌধুরী বলেন, ‘শ্রমিকরা যে কোনো উপায়ে কর্মসংস্থানের সুযোগ চায়। বৈধভাবে শ্রমিকরা যেতে না পারলে অবৈধভাবে যেতে চায়। তাই বৈধভাবে শ্রমবাজার উন্মুক্ত করা জরুরি। অবৈধভাবে যারা ট্যুরিস্ট ভিসায় শ্রমিক পাঠায়, তাদের বিরুদ্ধে সরকারের উচিত শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া।’

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

নদীর পাড় কেটে মাটি বিক্রি, ঝুঁকিতে বাঁধ

ঈদ বোনাস বৃদ্ধির দাবিতে শ্রমিকদের আন্দোলন, সমাধান দিলো সেনাবাহিনী

হজ ও ঈদের যে সিদ্ধান্তের কথা জানাল সৌদি আরব

‘মৃত্যুশয্যায়’ মেহেরপুর জেনারেল হাসপাতালের চিকিৎসাসেবা

টেকনাফের অপহরণ চক্রের অন্যতম হোতা গ্রেপ্তার

ধেয়ে আসছে ঘূর্ণিঝড় ‘শক্তি’, যেসব জেলায় হতে পারে ভারি বৃষ্টি

রাজবাড়ীর পদ্মাপাড়ে রাসেলস ভাইপার আতঙ্ক

ডব্লিউএফপির গবেষণা / বিশ্বে মাত্র একটি দেশই খাদ্যে শতভাগ স্বয়ংসম্পূর্ণ

জুনে ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দেবে ইউরোপের এক দেশ

ঢাকার বাতাস সংবেদনশীল গোষ্ঠীর জন্য ‘অস্বাস্থ্যকর’

১০

আজ কেমন থাকবে ঢাকার আবহাওয়া 

১১

গাজায় স্কুলে বোমাবর্ষণ  / যুদ্ধ বন্ধে ইউরোপ ও আরব দেশগুলোর আহ্বান

১২

পদ্মার চরে কৃষকদের পিটিয়ে গরু জবাই করে পিকনিক

১৩

দুপুরের মধ্যে ১৬ জেলায় ঝড়ের শঙ্কা

১৪

২৬ মে : কী ঘটেছিল ইতিহাসের এই দিনে

১৫

ঈদযাত্রায় ট্রেনের ৫ জুনের টিকিট মিলছে আজ

১৬

২৬ মে : আজকের নামাজের সময়সূচি

১৭

পরমাণু অস্ত্রভান্ডারকে আধুনিকীকরণ করছে পাকিস্তান, দাবি মার্কিন গোয়েন্দাদের

১৮

তৃতীয়বারের মতো লাহোরের পিএসএল শিরোপা জয়

১৯

মির্জা ফখরুলের নামে ভুয়া আইডি খুলে প্রতারণা, আটক ১

২০
X