বিপজ্জনক বাঁক, ভাঙাচোরা, খানাখন্দ, ছোট-বড় গর্ত, ঢালাই উঠে যাওয়া, গুরুত্বপূর্ণ জায়গা দখল হওয়া—এসব কারণে জাতীয় মহাসড়কের যান চলাচল মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে। একই সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে দুর্ঘটনা, দীর্ঘ হচ্ছে লাশের সারি। চলতি বছরের প্রথম ৯ মাসে মহাসড়কে অন্তত দুই হাজারের বেশি দুর্ঘটনা ঘটেছে। আর ২০২০ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত গত পাঁচ বছরে প্রায় ১১ হাজার দুর্ঘটনা ঘটেছে মহাসড়কে।
সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, সারা দেশে ২২ হাজার ৭১৯ কিলোমিটার সড়কের মধ্যে জাতীয় মহাসড়ক রয়েছে ৪ হাজার ২৯৩ কিলোমিটার এবং আঞ্চলিক মহাসড়ক ৫ হাজার ৩৯ কিলোমিটার। জেলা মহাসড়ক আছে ১৩ হাজার ৩৮৫ কিলোমিটার। এসব সড়কের মধ্যে ১ হাজার ৪৭৮ কিলোমিটার সড়কের অবস্থা বেহাল।
এসব সড়ক মেরামতে প্রতি বছর গড়ে প্রায় ছয় হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ থাকে। তবুও পর্যাপ্ত রক্ষণাবেক্ষণ করা যাচ্ছে না। বিপরীতে সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর সংখ্যা বেড়েই চলেছে। সারা দেশে গত এক যুগে প্রায় ৯৪ হাজার মানুষের মৃত্যু হয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে আজ বুধবার সরকারিভাবে পালিত হচ্ছে জাতীয় নিরাপদ সড়ক দিবস। এবারের প্রতিপাদ্য—‘মানসম্মত হেলমেট ও নিরাপদ গতি, কমবে জীবন ও সম্পদের ক্ষতি’।
জানতে চাইলে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক শামছুল হক কালবেলাকে বলেন, ‘আমরা আসলে সড়ক পুনর্বাসনকে রক্ষণাবেক্ষণ বলছি। রক্ষণাবেক্ষণ সারা বছরের কাজ, নিয়মিত করতে হয়। কিন্তু টেন্ডারে বিল বাড়াতে আমরা সড়কে গর্ত হওয়ার অপেক্ষা করি। এতে করে একদিকে যেমন অপচয় বাড়ে, অন্যদিকে সড়ক দুর্ঘটনাও বাড়ে। আমরা বিনিয়োগ করেছি ঠিকই, পাশাপাশি দুর্ঘটনার উপাদানগুলোও সড়কে রেখে দিয়েছি।’
রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০২০ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত পাঁচ বছরে মহাসড়কে ১০ হাজার ৮৫১টি দুর্ঘটনা ঘটেছে, যা মোট দুর্ঘটনার ৩৫ দশমিক ২৫ শতাংশ। আবার ২০২৫ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৯ মাসে মহাসড়কে দুই হাজার ২১টি দুর্ঘটনা ঘটেছে, যা মোট দুর্ঘটনার ৪০ দশমিক ২৮ শতাংশ।
এক প্রশ্নের জবাবে ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক সাইদুর রহমান বলেন, ‘গ্রামীণ সড়কগুলো সরাসরি মহাসড়কে সংযুক্ত করার কারণে ছোট ও স্বল্পগতির যানবাহন স্বল্প দূরত্বে চলাচলের জন্য মহাসড়ক ব্যবহার করতে বাধ্য হচ্ছে। এই প্রেক্ষাপটে মহাসড়কের দুর্ঘটনা রোধ করতে হলে উল্লেখিত বিষয়গুলোতে সরকারকে মনোযোগী দিতে হবে। মহাসড়কে স্বল্পগতির ছোট যানবাহনের অবাধ ও বেপরোয়া চলাচল, মহাসড়কের অধিকাংশ স্থানজুড়ে রোড ডিভাইডার এবং সার্ভিস রোড না থাকা, আইন প্রয়োগে দুর্বলতার কারণে মহাসড়কে দুর্ঘটনা বাড়ছে।’
সওজর তথ্য বলছে, সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত সড়ক-মহাসড়ক রাজশাহী অঞ্চলে, প্রায় ২২৯ কিলোমিটার। রংপুর সড়ক বিভাগে ১৯৪ কিলোমিটার, চট্টগ্রাম সড়ক বিভাগে ১৮৬, কুমিল্লা সড়ক বিভাগে ১৬৭, ময়মনসিংহ সড়ক বিভাগে ১৫০, সিলেট সড়ক বিভাগে ১৪৮, ঢাকা সড়ক বিভাগে ১৪৩, বরিশাল সড়ক বিভাগে ১১৯, গোপালগঞ্জ সড়ক বিভাগে ৭০ এবং খুলনা সড়ক বিভাগে ৬৮ কিলোমিটার সড়কের অবস্থা বেহাল।
সওজর প্রধান প্রকৌশলী সৈয়দ মঈনুল হাসান বলেন, ‘সড়ক মেরামতের জন্য একটা বাজেট তৈরি হয়েছে। তবে চূড়ান্ত হয়নি। বাজেট প্রস্তাব অনুমোদনের পর আনুষ্ঠানিকভাবে জানাব। আর সড়কে দুর্ঘটনা বেশিরভাগ ক্ষেত্রে যেসব কারণে হয় সেগুলোর নিয়ন্ত্রণ আমাদের হাতে খুব একটা নেই। জাতীয় মহাসড়কে দুর্ঘটনা কমাতে হলে জনসচেতনতার পাশাপাশি স্থানীয় প্রশাসনের উদ্যোগ বাড়াতে হবে।’
এদিকে ২০১৪ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২৫ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সারা দেশে ৬৭ হাজার ৮৯০টি সড়ক দুর্ঘটনায় ১ লাখ ১৬ হাজার ৭২৬ জনের মৃত্যু হয়েছে; আহত হয়েছেন ১ লাখ ৬৫ হাজার ২১ জন। বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতি শুধু সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত খবরের তথ্যের ওপর ভিত্তি করে এমন চিত্র জানিয়েছে।
কথা হলে সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী কালবেলাকে বলেন, ‘পৃথিবীর কোনো জাতীয় মহাসড়কে উচ্চগতি আর কমগতির যান একসঙ্গে চলে না। আমাদের এখানে এটা হয়। ম্যানুয়াল ট্রাফিক সিস্টেমের কারণেও দুর্ঘটনা বাড়ছে। মহাসড়কে দুর্ঘটনার আরেকটি বড় কারণ চালক। চালকের সংকট রয়েছে। এই সুযোগে পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ না নিয়েই অনেকেই বড় রুটের চালক হয়ে যাচ্ছেন। আবার এই চালকরা পর্যাপ্ত বিশ্রাম পাচ্ছেন না।’
মন্তব্য করুন