রাজধানীর অভিজাত বা তারকামানের হোটেলগুলোতে বিদেশি অতিথির সংখ্যা অর্ধেকের বেশি কমেছে। কোনো কোনো হোটেলে কমেছে তার চেয়েও বেশি। বিদেশি অতিথি না থাকলেও হোটেল চালু রাখায় পরিশোধ করতে হচ্ছে বিভিন্ন ইউটিলিটি বিল ও সার্ভিস চার্জ। সম্প্রতি কোটা সংস্কার আন্দোলনের কারণে দেশের স্বাভাবিক কর্মকাণ্ড বন্ধ হয়ে যাওয়া এবং বাংলাদেশ ভ্রমণে বিভিন্ন দেশ সতর্কতা জারি করার কারণে এই পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, গত ১৫ দিনে দেশের তারকামানের হোটেলগুলোর ক্ষতি হয়েছে হাজার কোটি টাকার বেশি।
বাংলাদেশ ইন্টারন্যাশনাল হোটেল অ্যাসোসিয়েশনের সেক্রেটারি মহসিন হক হিমেল কালবেলাকে বলেন, গত ১৫ দিনে তারকামানের হোটেলগুলোর হাজার কোটি টাকার বেশি লোকসান হয়েছে। ভবিষ্যতে কী হবে, জানি না। দেশের ৫৫টি অভিজাত ও তারকামানের হোটেল আমাদের সদস্য। খোঁজ নিয়ে জেনেছি, প্রতিটি হোটেলই প্রায় খালি। এসব হোটেলে সাধারণত বিদেশিরাই বেশি থাকে। এর মধ্যে পর্যটক ও ব্যবসায়ীই বেশি। দেশে যখন কোনো অস্থিতিশীল পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়, তখন প্রথম আঘাত আসে পর্যটন খাতে। হোটেল এ খাতের অন্যতম অনুষঙ্গ।
রাজধানীর একাধিক তারকামানের হোটেলের কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সাধারণত জুলাই থেকে হোটেলগুলোতে বিদেশি অতিথির চাপ বাড়তে থাকে। পর্যায়ক্রমে তা ডিসেম্বর-জানুয়ারি পর্যন্ত অব্যাহত থাকে। গত জুনে পরিস্থিতি ভালো হলেও চলতি মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকে আশঙ্কাজনকভাবে কমতে থাকে বিদেশি পর্যটক বা অতিথির সংখ্যা। পরে কোটা সংস্কার আন্দোলন ক্রমে বড় আকার ধারণ করলে দেশের পরিস্থিতি অবনতি হয়। কয়েকটি বড় অভিজাত হোটেল ছাড়া সব হোটেলেই বিদেশি অতিথি আসা একেবারেই কমে যায়। বলা যায়, প্রায় শূন্য হয়ে পড়ে। কোটা সংস্কার আন্দোলনের কারণে অনেক দেশ বাংলাদেশ ভ্রমণে নিজ নিজ দেশের নাগরিকদের জন্য সতর্কতা জারি করেছে। বিদেশি অতিথি কমে যাওয়ার পেছনে এটিও অন্যতম বড় কারণ।
তারা জানান, অস্থিতিশীল পরিস্থিতির কারণে অনেক বিদেশি অতিথি বা পর্যটক হোটেল রুম বুকিং বাতিল করেছেন। এর মধ্যে আগস্ট মাসেরও রুম বুকিং রয়েছে। পাশাপাশি ইন্টারনেট বন্ধ থাকায় এক সপ্তাহ কোনো বিদেশি যোগাযোগ করতে পারেনি। এমনকি তারা হোটেল বুকিং, বাতিল কিছুই করতে পারেনি।
রাজধানীর বনানীর একটি পাঁচতারকা হোটেলের এক কর্মকর্তা বলেন, কোটা সংস্কারের আগে গড়ে প্রতিদিন ১৫ থেকে ২০ জন অতিথি আমাদের এখানে উঠত। কিন্তু গত ১৩ জুলাইয়ের পর আশঙ্কাজনকহারে অতিথির সংখ্যা কমতে থাকে। ১৬ জুলাইয়ের পর থেকে এ পর্যন্ত একজনও বিদেশি অতিথি আসেনি। এখন যারা আছেন, তারা আগেই এখানে উঠেছেন।
সরকারি মালিকানাধীন সোনারগাঁও হোটেলের পরিচালক কাজী মোয়াজ্জেম হোসেন কালবেলাকে বলেন, আমাদের বিদেশি অতিথি আগমনের পরিমাণ কমেছে, এটা ঠিক। কিন্তু খুব বেশি নয়। এর পরিমাণ হবে ১৫ থেকে ২০ শতাংশ। তার পরও অনেকে আসছে। বর্তমান অস্থিতিশীলতায় কিছুটা স্লো যাচ্ছে। আশা করি, শিগগিরই ঠিক হয়ে যাবে।
দ্য ওয়েস্টিন ঢাকার জনসংযোগ বিভাগ জানায়, তাদের বিদেশি অতিথির সংখ্যা কমেছে। তবে খুব বেশি নয়। এই বিভাগের এক কর্মকর্তা জানান, হলি আর্টিজানের ঘটনার পর দেশে বিদেশিদের আসা কমে গিয়েছিল। এখন দেশের যে পরিস্থিতি, সে অবস্থায় বিদেশিরা বাংলাদেশ ভ্রমণ করবে না—এটাই স্বাভাবিক। তবে বিদেশি অতিথি কমলেও, এখন পর্যন্ত আমরা ভালো আছি।
র্যাডিসন ব্লু ওয়াটার গার্ডেন হোটেলেও ২০ থেকে ২৫ শতাংশের মতো বিদেশি অতিথি কমেছে। তবে বিমানবন্দরের কাছে হওয়ায় এবং সেবা ও নিরাপত্তা ব্যবস্থা ভালো থাকার কারণে এখানে এখনো বিদেশি অতিথি আসা-যাওয়া করছে। তবে সংখ্যা অনেক কম।
ঢাকা রিজেন্সির ডিউটি ম্যানেজার আমিনুর রহমান জানান, বিদেশি এয়ারলাইন্সগুলো আমাদের বড় গ্রাহক। কোটা সংস্কার আন্দোলনের কারণে বিদেশি অতিথি আসার পরিমাণ আমাদের এখানে ৭০ শতাংশ পর্যন্ত কমেছে। আমাদের এখানে ইউএসএ, জার্মানি, সিঙ্গাপুর, চীন ও ভারত থেকে বেশি অতিথি আসে। কিন্তু বাংলাদেশে উদ্ভূত পরিস্থিতিতে এসব দেশ বাংলাদেশ ভ্রমণে সতর্কতা জারি করেছে।
লা মেরিডিয়েন, হোটেল সারিনা, আমারি ঢাকাসহ আরও কয়েকটি তারকামানের অভিজাত হোটেলেও বিদেশি অতিথির আগমন একেবারেই কমে গেছে। এক সপ্তাহ ধরে উল্লেখ করার মতো বিদেশি অতিথি আসেনি। বর্তমানে যারা আছেন, তাদের অনেকেই আগে থেকেই আছেন। তারা বাংলাদেশের বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বিদেশি কর্মকর্তা ও বিশেষজ্ঞ।
রাজধানীর চারতারকা মানের এক হোটেলের কর্মকর্তা জানান, কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে কারফিউর কারণে দেশে ব্যবসা-বাণিজ্য প্রায় অচল। এ কারণে অতিথিরাও আসছেন না। হোটেলের সব রুম ফাঁকা পড়ে আছে। এ ছাড়া নেই কোনো অনুষ্ঠান। ফলে খাবারও বিক্রি হচ্ছে না।
জানা গেছে, দেশে পাঁচতারকা হোটেল রয়েছে ২০টি। চারতারকা মানের হোটেল রয়েছে চারটি ও তিনতারকা হোটেল রয়েছে ২৯টি। এ ছাড়া প্রায় ২ হাজার বিলাসবহুল হোটেল রয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠানে কর্মরত প্রায় ১ লাখ মানুষ।