জাফর ইকবাল
প্রকাশ : ০৬ নভেম্বর ২০২৪, ০৩:০১ এএম
আপডেট : ০৬ নভেম্বর ২০২৪, ০৯:৫৪ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

মেট্রোপলিটন হাউজিংয়ে ‘যেমন খুশি তেমন খাও’

মানা হয়নি সমবায়ের নিয়মনীতি
মেট্রোপলিটন হাউজিংয়ে ‘যেমন খুশি তেমন খাও’

রাজধানীর মোহাম্মদপুর থানাধীন বাবর রোডের মেট্রোপলিটন কো-অপারেটিভ হাউজিং সোসাইটি লিমিটেড। এখানে ৪৬ প্লট, ফ্ল্যাট ও প্লট মালিক মিলিয়ে ৫০০ পরিবারের বসবাস। তদারকির দায়িত্বে রয়েছে সমবায় অধিদপ্তরের অধীন একটি কার্যনির্বাহী পরিষদ। নিয়মানুযায়ী, বসবাসকারী মালিকদের নিয়ে বার্ষিক সাধারণ সভার (এজিএম) মাধ্যমে একটি কমিটি গঠন করে পরিচালনা করার কথা। তবে কমিটি শুধু খাতা-কলমেই, লোক দেখানো। বাস্তবে হাতেগোনা কয়েকজন লোক ঘুরেফিরে কমিটিতে এসে নানা নিয়মকানুন আরোপ করে দুর্নীতি, অনিয়ম, চাঁদাবাজি, স্বেচ্ছাচারিতা, জোরজবরদস্তি, ভয়ভীতি দেখানো, প্লট-ফ্ল্যাট দখলসহ নানা অপকর্মে লিপ্ত হয়েছেন। এসব নিয়ে কেউ প্রতিবাদ করলে তাকে কমিটির সদস্যপদ থেকে বহিষ্কারসহ দেওয়া হয় মামলা। মানসিক ও শারীরিক হয়রানির শিকারও হয়েছেন অনেকে। সেই মামলাও আবার পরিচালনা করা হয় সদস্যদের টাকায়। আর এই অপকর্মে ব্যবহার করা হয় সরকারি আনসার সদস্য ও বহিরাগতদের। কারণে অকারণে বিভিন্ন অজুহাতে কমিটির হিসাব থেকে ১৫ বছরে এই সিন্ডিকেট হাতিয়ে নিয়েছে কোটি কোটি টাকা।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ১৬ বছর ধরে কমিটির গুটিকয় মানুষের হাতে জিম্মি হয়ে আছে হাউজিংয়ের পাঁচ শতাধিক পরিবার। নানা অনিয়ম নিয়ে একাধিকবার সমবায় অধিদপ্তরে লিখিত অভিযোগও দিয়েছেন হাউজিংয়ে বসবাসকারীরা। তারা বলেছেন, সমিতির অভ্যন্তরে অবসরপ্রাপ্ত সরকারি উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা, স্বনামধন্য ব্যবসায়ী এবং দেশসেরা করপোরেট প্রতিষ্ঠানের পদস্থ কর্মকর্তাদের বাস এই হাউজিংয়ে। সমিতি পরিচালনা কমিটির সদস্যদের অনৈতিক ব্যবহারে এসব ব্যক্তি ও তাদের পরিবার অর্থনৈতিক ক্ষতির পাশাপাশি প্রতিনিয়ত সম্মানহানির শিকার হচ্ছেন। দীর্ঘদিন ধরে পেশিশক্তির জোরে মেট্রোপলিটন হাউজিংয়ের নিয়ন্ত্রণে থাকা ব্যক্তিদের মধ্যে আছেন মো. মনিরুজ্জামান, জাফরিন হোসেন ও সৈয়দ মো. কায়সার হোসেন।

জানা যায়, কেউ প্রতিবাদ করলে বা কমিটির অনিয়মের বিরুদ্ধে কথা বললে মামলা দিয়ে হয়রানি করা হয়। মামলার খরচ চালানো হয় সমিতির সদস্যদের টাকায়। বর্তমানে কমিটি ১৫টির মতো মামলা পরিচালনা করছে, যার সবই অভ্যন্তরে বসবাসরত প্লট ও ফ্ল্যাট মালিকদের বিরদ্ধে। উন্নয়নমূলক কাজে নজর না থাকলেও সমিতির সদস্যরা মামলা পরিচালনায় প্রায় ৪৩ লাখ টাকা ব্যয় করেছেন। এজিএম হাউজিংয়ের অভ্যন্তরে করার কথা থাকলেও করা হয় বাইরে। দীর্ঘদিন ধরে নির্বাচন না করে সাধারণ সদস্যদের পাশ কাটিয়ে সিলেকশনের মাধ্যমে কমিটির সদস্য নির্বাচিত করা হয়। একই পরিবারের ভাই, ভাবি, ভাইপো, ছেলেমেয়েসহ ১৩-১৪ জনকেও সদস্য করা হয়েছে। কমিটির নেতাদের অধিকাংশই আবার সমিতির এলাকার ভেতরে বসবাস করেন না।

অধিকাংশ মামলায় বারবার হেরে যাওয়ার পরও ফের উচ্চ আদালতে আপিল করে সমিতির টাকা অপচয় ও আত্মসাৎ করার অভিযোগ রয়েছে। সমিতির ভেতরে বসবাসরতদের কাছ থেকে বিভিন্ন অপ্রয়োজনীয় এবং অযাচিত ভাউচারে বছরে অন্তত ৩ লাখ টাকা চাঁদা দাবির অভিযোগ রয়েছে। দাবিকৃত চাঁদার টাকা না দিলে হুমকি-ধমকি দিয়ে অশালীন ভাষায় আবার চিঠি দেওয়া হয়।

আরও জানা গেছে, সমিতির ভেতরের বাসিন্দারা সদস্য হওয়ার জন্য নিবন্ধকের বরাবর আবেদন করলে সমবায় অধিদপ্তরের মহাপরিচালক তাদের সদস্য করার জন্য সমিতিকে নির্দেশ দেন। তবে পরিচালনা পর্ষদ সে নির্দেশ না মেনে উল্টো হাইকোর্টে মামলা করে দেয়, যা সমবায় আইনের ২০০১ (১২) ধারার স্পষ্ট লঙ্ঘন। কারণ সমবায় আইনুযায়ী নিবন্ধকের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত। হাউজিংয়ের নিরাপত্তায় সমিতির টাকায় আনসার সদস্যদের মোতায়েন করা হয়েছে। তবে সে আনসার হাউজিং এলাকার ভেতরের আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণের চেয়ে সমিতির নেতাদের পেটোয়া বাহিনী হিসেবে ব্যবহার হচ্ছে। অন্যদিকে হাউজিং এরিয়ায় নিয়মিত মাদক কারবার, ছিনতাইয়ের মতো ঘটনা ঘটছে। অথচ গত ১০ বছরে আনসার বাবদ খরচ হয়েছে প্রায় আড়াই কোটি টাকা। এ ছাড়া সিটি করপোরেশনের পরিচ্ছন্নতা কর্মীদের রাস্তা ঝাড়ুতে কমিটির অনুমতি বাধ্যবাধকতার কারণে ঝাড়ু দেওয়া বন্ধ রয়েছে। সড়কবাতি দীর্ঘদিন ধরে নষ্ট থাকার পরও তা ঠিক করা হয় না। সমিতির নেতারা উত্তরাধিকার আইনও মানেন না। কেউ মারা গেলে ওই সম্পত্তি সমিতির নিজস্ব সম্পত্তি হিসেবে গণ্য হবে বলে ধারা যুক্ত করে বসবাসকারীদের ভয়ভীতি দেখানোরও অভিযোগ রয়েছে।

সরেজমিন বাবর রোডের মেট্রোপলিটন হাউজিংয়ে গিয়ে দেখা যায়, গেট দিয়ে ঢুকতেই বাঁ পাশে টিনের চালার একটি মসজিদ। সেখানে গিয়ে বসবাসরত অন্তত ২০ জনের সঙ্গে কথা হয় এই প্রতিবেদকের। তাদের মধ্যে রয়েছেন কাজী মোহাম্মদ মোস্তফা আহমাইন, রশিদ আহমেদ খান, ফখরুল ইসলাম চৌধুরী, অ্যাডভোকেট খালেদ আহমেদ ও আনোয়ার আজাদ। তারা জানান, দীর্ঘদিন ধরে মসজিদটি মেরামত করা হয় না। বৃষ্টিতে টিনের চালা দিয়ে পানি পড়ে। কেউ মেরামত করে দিতে চাইলেও সেটি দেওয়া হয় না। জুমার নামাজ পড়তে দেওয়া হয় না।

একাধিক ব্যক্তি অভিযোগ করে বলেন, মসজিদের প্লটটি দখল করে এখানে বহুতল ভবন বানিয়ে ফ্ল্যাট বিক্রির ষড়যন্ত্রে লিপ্ত কমিটির লোকজন। যে কারণে তারা নামাজ পড়তে আসা মুসল্লিদের হুমকি-ধমকি দেন। মসজিদের পাশেই ৩৮ নম্বর প্লটটি নকশায় খেলার মাঠ। সেটিও সীমানাপ্রাচীর দিয়ে ঢেকে ইট-পাথর ফেলে খেলার অনুপযোগী করে রাখা হয়েছে। তারা অভিযোগ করে বলেন, দুই কোটি টাকার চুক্তিতে স্থানীয় সাবেক এক কাউন্সিলরকে প্লটটির দখল দেওয়ার চেষ্টা করছেন সমিতির লোকজন। প্লটটি দখল নিতে কয়েকবার হামলাও চালিয়েছে কাউন্সিলরের লোকজন। এখনো বিভিন্ন সময়ে প্লটটি দখলের চেষ্টা করছে তারা।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, হাউজিংয়ের ভেতরে ৩২ নম্বর প্লটের মালিক ছিলেন ২৫ নম্বর সদস্য হাসিব জাকারিয়া, ৮৬ নম্বর সদস্য তসলিমুর রহমান, ৯২ নম্বর সদস্য জাফরুল্লাহ চৌধুরী ও ১৫৬ নম্বর সদস্য একেএম ফারুক। প্লটটি রেজিস্ট্রি করে নিয়ে ডেভেলপার কোম্পানির মাধ্যমে ‘শাহা প্যালেস’ নামে ৬ তলা ভবন নির্মাণ করেন শাহ ইমরান নামের একজন। পরে বিষয়টি নিয়ে মামলা দায়ের হলে নির্মাণ কাজ বন্ধ হয়ে যায়। এরপর প্লটটি ২৮ লাখ করে চারটি কিস্তিতে ১ কোটি ১২ লাখ টাকা নিয়ে আনিসুর রহমানের নামে শেয়ার হস্তান্তর করে দেন সমিতির তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক মনিরুজ্জামান ও উপদেষ্টা সৈয়দ মো. কায়সার হোসেন। ১ কোটি ১২ লাখ টাকা নিলেও মেট্রোপলিটন হাউজিংয়ের টাকার রসিদে মাত্র ২৫ হাজার টাকার চারটি রসিদে ১ লাখ টাকার রসিদ দেওয়া হয়েছে। ১ কোটি ১২ লাখ টাকা নেওয়ার স্ট্যাম্পের চুক্তিপত্র কালবেলার হাতে রয়েছে।

অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে মো. মনিরুজ্জামান ‘সমবায়ের সঙ্গে কথা বলেন’ বলে ফোন কেটে দেন। এরপর একাধিকবার ফোন দিলেও তিনি ধরেননি। আর সব অভিযোগ অস্বীকার করে সৈয়দ মো. কায়সার হোসেন কালবেলাকে বলেন, ‘৩২ নম্বর প্লট শাহ ইমরান গং দখল করে সেখানে ৬ তলা ভবন বানিয়ে ফেলে। এরপর আদালত স্থিতাবস্থা দিলে প্লটটি আমরা মধ্যস্ততা করে আনিসুর রহমান মাসুদকে বুঝিয়ে দিই। সে বাবদ আমরা ১ কোটি ১২ লাখ টাকা নিয়ে আসল মালিককে দিয়েছি।’

প্লট বিক্রি বা শেয়ার হস্তান্তর করলে সেটা করবেন মালিক; কিন্তু চুক্তিপত্রে আপনাদের নাম কেন, আপনারা কীসের বাবদ ১ কোটি ১২ লাখ টাকা নিয়েছেন—এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘মালিকরা তাদের কাছে শেয়ার জমা দিয়েছিলেন। পরে তারা সে শেয়ার ট্রান্সফার করেছেন।’

এসব বিষয়ে মেট্রোপলিটন থানা সমবায় অফিসার (মোহাম্মদপুর) মাহফুজুল আমিন কালবেলাকে বলেন, ‘হাউজিংয়ের বাসিন্দারা ডিজি বরাবর একটি লিখিত অভিযোগ দিয়েছিলেন। সেটি ডিজির নির্দেশে প্রাথমিক তদন্ত করে সুপারিশসহ পাঠিয়েছি। ডিজি ৪৯ ধারায় দুই সদস্যবিশিষ্ট একটি কমিটি গঠন করে তদন্তের নির্দেশে দিয়েছেন। সেই কমিটিও এরই মধ্যে কাজ শুরু করেছে। তদন্ত শেষ হলে প্রতিবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

কবি নজরুল ছিলেন মুসলিম জাগরণের অগ্রদূত : ডা. ইরান

শিল্পকলা একাডেমিতে শুরু মঞ্চ ও পোশাক কর্মশালা

এবার চতুর্থ সারির ক্লাবের কাছে হেরে ম্যানইউর বিদায়

ড. মাসুদের প্রচেষ্টায় দুর্ভোগ থেকে মুক্তি পেলো ৩ ইউনিয়নের মানুষ

বিশ্বকাপ দলে সুযোগ না পেয়ে অস্ট্রেলিয়ায় পাড়ি জমাচ্ছেন বাংলাদেশ স্পিনার

রুমিন ফারহানার দুঃখ প্রকাশ

বৃহস্পতিবার প্রকৌশল শিক্ষার্থীদের ‘কমপ্লিট শাটডাউন’ কর্মসূচি ঘোষণা

ভারতে নিষিদ্ধ অনলাইন জুয়া, বড় ধাক্কায় আইপিএল ও ভারতীয় ক্রিকেট

পদক্ষেপ নিলে মনে হয় দেশেই থাকা হবে না : ডিসি মাসুদ

রাজনৈতিক দলের মতামত নিয়ে ঐকমত্য কমিশনের সভা

১০

ডিআরইউতে মঞ্চ ৭১–এর কর্মসূচি প্রত্যাহারের দাবি

১১

জলবায়ু চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় আন্তর্জাতিক অংশীদারিত্ব অপরিহার্য: উপদেষ্টা

১২

কনভেনশন হলে গেরিলা বৈঠকে গ্রেপ্তার শিমুল ৪ দিনের রিমান্ডে

১৩

শাহবাগে এসে ডিএমপি কমিশনারের ‘দুঃখ প্রকাশ’

১৪

ইনকিলাব সম্পাদককে লিগ্যাল নোটিশ পাঠাল ছাত্রশিবির

১৫

বিএনপি নেতাকে কোপাল যুবলীগ নেতা

১৬

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সাক্ষী হাটহাজারী বিমানবন্দর

১৭

ঢাকা-রাজশাহী মহাসড়ক অবরোধ করে রুয়েট শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ

১৮

ডাকসু নির্বাচন / ১৩২ শিক্ষার্থীকে খাওয়ালেন প্রার্থী, রিটার্নিং কর্মকর্তা বললেন আচরণবিধি লঙ্ঘন

১৯

সাদাপাথর লুটপাট নিয়ে সিলেটে গণশুনানি

২০
X