এ জেড ভূঁইয়া আনাস
প্রকাশ : ০৪ জুলাই ২০২৫, ১২:০০ এএম
আপডেট : ০৪ জুলাই ২০২৫, ০৭:৩৯ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর খেলাপি ছাড়িয়েছে ৩৫ শতাংশ

ব্যাংকের প্রতিবেদন
আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর খেলাপি ছাড়িয়েছে ৩৫ শতাংশ

দেশের ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠান (এনবিএফআই) খাতে চলতি বছরের প্রথম প্রান্তিকে (জানুয়ারি-মার্চ) খেলাপি ঋণ বেড়েছে ২ হাজার ১০০ কোটি টাকা। এতে বর্তমানে খাতটিতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২৭ হাজার ১৮৯ কোটি টাকা, যা মোট বিতরণকৃত ঋণের ৩৫ দশমিক ৩১ শতাংশ। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ হালনাগাদ প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে। ব্যাংকাররা বলছেন, আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো তারল্য সংকটে ভুগছে। ব্যাংকগুলোর সঙ্গে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে তীব্র প্রতিযোগিতা করতে হচ্ছে। এ ছাড়া নানা অনিয়মের কারণে ভাবমূর্তি নষ্ট হওয়ায় আমানত পেতে সমস্যা হচ্ছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, চলতি বছরের মার্চ শেষে দেশের ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর (এনবিএফআই) মোট ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৭৬ হাজার ৯৮৭ কোটি টাকা। ২০২৪ সালের ডিসেম্বর শেষে এই ঋণের পরিমাণ ছিল ৭৫ হাজার ৪৫০ কোটি টাকা। সে হিসাবে মাত্র তিন মাসের ব্যবধানে খাতটিতে নতুন ঋণ বেড়েছে ১ হাজার ৫৩৭ কোটি টাকা। আর ২০২৪ সালের মার্চ শেষে ঋণের পরিমাণ ছিল ৭৪ হাজার ৩৮৯ কোটি টাকা। অর্থাৎ বছরের ব্যবধানে আর্থিক প্রতিষ্ঠানের খেলাপি বেড়েছে ২ হাজার ৫৯৮ কোটি টাকা।

একই সময়ে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর মোট খেলাপি ঋণের পরিমাণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৭ হাজার ১৮৯ কোটি টাকা, যা মোট ঋণের ৩৫ দশমিক ৩১ শতাংশ। গত ডিসেম্বর শেষে এই খেলাপির পরিমাণ ছিল ২৫ হাজার ৮৯ কোটি টাকা। সে হিসাবে তিন মাসের ব্যবধানে খেলাপি বেড়েছে ২ হাজার ১০০ কোটি টাকা। আর ২০২৪ সালের মার্চে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর খেলাপি ঋণ ছিল ২৩ হাজার ৮৮৯ কোটি টাকা। সে হিসাবে এক বছরের ব্যবধানে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ৩ হাজার ৩০০ কোটি টাকা।

বাংলাদেশের আর্থিক খাতের ইতিহাসে অন্যতম ভয়াবহ দৃষ্টান্ত হয়ে রয়েছেন প্রশান্ত কুমার হালদার, যিনি পি কে হালদার নামে পরিচিত। রাষ্ট্রীয় আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠান (এনবিএফআই) ব্যবহার করে হাজার হাজার কোটি টাকা লুট করে তিনি দেশ ছেড়ে পালিয়ে যান। এখনো এ কেলেঙ্কারির সম্পূর্ণ টাকা উদ্ধার হয়নি এবং এর প্রভাব পড়েছে দেশের পুরো আর্থিক ব্যবস্থার ওপর। এই খাতের সমস্যা দূর করতে হলে ঋণ বিতরণ প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা, আদায়ে আইনি কার্যক্রম ও নীতি জোরদার, পরিচালনায় জবাবদিহি নিশ্চিত এবং দুর্নীতিবাজদের শাস্তির আওতায় আনা নিশ্চিত করতে হবে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র আরিফ হোসেন খান কালবেলাকে বলেন, ‘সব আর্থিক প্রতিষ্ঠান দুর্বল নয়। কিছু প্রতিষ্ঠান ভালো ব্যবসা করছে, তাদের ঋণ আদায়ও ভালো হচ্ছে। তবে এখনো ৩৫ শতাংশের বেশি ঋণ খেলাপি—এটি কোনোভাবে ইতিবাচক নয়। তাই এই খাতও পুনর্গঠন করতে হবে। ব্যাংক রেজুলেশন অ্যাক্ট ও প্রম্পট কারেক্টিভ অ্যাকশন (পিসিএ) ফ্রেমওয়ার্ক শুধু ব্যাংকের জন্য নয়, এনবিএফআই খাতেও কার্যকর করতে হবে।’

এদিকে খেলাপিতে জর্জরিত আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বিলুপ্ত করার চিন্তা করছে বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর। কালবেলাকে তিনি বলেন, আমরা এ আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো যাচাই-বাছাই করেছি। দেখেছি ১৫ থেকে ১৬টি প্রতিষ্ঠান একেবারে ক্ষতিগ্রস্ত অবস্থায় আছে। এদের ৯৯ শতাংশ ঋণ খেলাপি। আমরা তাদের কাছে জানতে চেয়েছি, তোমাদের লাইসেন্স কেন বাতিল করা হবে না। আশা করি, এ সপ্তাহের মধ্যে তাদের কাছ থেকে জবাব পাব।

গভর্নর বলেন, আমরা তাদের সঙ্গে বসে একটা পরিকল্পনা করব, কীভাবে এই ১৫টি প্রতিষ্ঠানকে সামলানো যায়—হয় তাদের লিকুইডেশন করতে হবে, নয় তো অন্য কোনো ব্যবস্থা নিতে হবে। পাশাপাশি আমরা ভাবছি কীভাবে ডিপোজিটরদের ক্ষতি কমানো যায়। আমরা ডিপোজিটরদের স্বার্থ রক্ষায় সর্বোচ্চ চেষ্টা করব। যদিও এখানে সরকার আইনি দায়বদ্ধ নয়। কারণ, তারা নিজের ইচ্ছায় এখানে এসেছে এবং সরকারের কোনো গ্যারান্টি নেই। তবুও আমরা মনে করি সরকারের একটা নৈতিক দায়িত্ব রয়েছে। লিকুইডেশন অবশ্যই একটি বিকল্প।

তিনি বলেন, অনেক ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে এটা প্রযোজ্য হতে পারে। তবে এসব প্রতিষ্ঠান মার্জ করে বড় সুবিধা পাওয়া যাবে না। আসলে আমাদের দেশে এত আর্থিক প্রতিষ্ঠানের প্রয়োজনও ছিল না। ৩৫টি থাকার দরকার ছিল না, ১৫টি না থাকলেও কোনো ব্যাপার হতো না। বাকি ২৪ কিংবা ২০টি প্রতিষ্ঠান ভালোভাবে চললেই কাজ হবে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, দেশের সবচেয়ে খারাপ অবস্থায় থাকা আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে রয়েছে পিপলস লিজিং, বিআইএফসি, ইন্টারন্যাশনাল লিজিং, ফারইস্ট ফাইন্যান্স, জিএসপি ফাইন্যান্স, প্রিমিয়ার লিজিং, সিভিসি ফাইন্যান্স, মেরিডিয়ান ফাইন্যান্স, আইআইডিএফসি, হজ ফাইন্যান্স, ফনিক্স ফাইন্যান্স, ন্যাশনাল ফাইন্যান্স, বে লিজিং, উত্তরা ফাইন্যান্স এবং ইউনিয়ন ক্যাপিটাল।

বাংলাদেশ লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্স কোম্পানিজ অ্যাসোসিয়েশনের (বিএলএফসিএ) চেয়ারম্যান মো. গোলাম সারওয়ার ভূঁইয়া আর্থিক প্রতিষ্ঠানের খেলাপি ঋণ বাড়ার পেছনে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেন, ‘অনেক আর্থিক প্রতিষ্ঠান ঋণ পুনঃতপশিল ও আদায় কার্যক্রম জোরদার করেছে। বাংলাদেশ ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর তদারকি বৃদ্ধি করেছে এবং করপোরেট গভর্ন্যান্স উন্নয়নের মাধ্যমে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি বৃদ্ধি পেয়েছে, যা খেলাপি ঋণ কমাতে সহায়তা করেছে।’

এদিকে চলতি বছরের মার্চ পর্যন্ত ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪ লাখ ২০ হাজার ৩৩৫ কোটি টাকা, যা বিতরণ করা মোট ঋণের ২৪ দশমিক ১৩ শতাংশ। এর আগে তিন মাস আগে অর্থাৎ ডিসেম্বরে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ৩ লাখ ৪৫ হাজার ৭৬৫ কোটি টাকা। সে হিসেবে তিন মাসে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ৭৪ হাজার ৫৭০ কোটি টাকা।

এ বিষয়ে গবেষণা সংস্থা চেঞ্জ ইনিশিয়েটিভের রিসার্চ ফেলো ও অর্থনীতিবিদ এম হেলাল আহমেদ জনি কালবেলাকে বলেন, রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর লুকানো খেলাপি ঋণের তথ্য প্রকাশ পাচ্ছে। অবলোপন, পুনঃতপশিল ও মামলার অন্তর্ভুক্ত ঋণ ধরলে খেলাপি আরও বাড়বে। আগের সরকারের আমলে অনেকে একটি কোম্পানি দেখিয়ে ঋণ নিয়েছেন। কোনো কোনো ক্ষেত্রে প্রভাব খাটিয়ে ঋণকে খেলাপি করতে দেননি। এজন্য এখন খেলাপি ঋণ বাড়ছে। এ ছাড়া অসংখ্য প্রতিষ্ঠান তৈরি করে অর্থ বিদেশে পাচার করেছেন এসব প্রভাবশালী। দুর্বল ব্যাংকে ব্যাপক দুর্নীতিও হয়েছে। এখন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অ্যাকশনে যাওয়ার সময় চলছে। খেলাপিদের বিরুদ্ধে বাংলাদেশ ব্যাংককে আরও কঠোর হতে হবে।

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন

মন্তব্য করুন

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

খেলার জন্য পুঁজিবাজারের মাঠ পুরোপুরি প্রস্তুত : বিএসইসি কমিশনার 

ইতালিতে ভয়াবহ বিস্ফোরণ, আহত ২৭

ইরানের ওপর আবারও যুক্তরাষ্ট্রের আঘাত

ছাত্রদল নেতার ‘অনৈতিক সম্পর্ক’ দেখে ফেলায় দুই নারীর ওপর হামলা

‘শেফালির হার্ডওয়্যার ভালো ছিল’

জঙ্গি কার্যক্রমে নিয়োজিতরা শ্রম খাতে যুক্ত : মালয়েশিয়ার আইজিপি

মা ও ২ সন্তানকে পিটিয়ে হত্যা / গ্রেপ্তার আতঙ্কে পুরুষশূন্য মুরাদনগর

পিআর পদ্ধতির মাধ্যমে মনোনয়ন বাণিজ্য বন্ধ করা সম্ভব : মাসুদ সাঈদী

‘জুলাইয়ের শেষে দ্বিতীয় তিস্তা গার্ডার সেতুর উদ্বোধন’

গাজায় নির্বিচারে ত্রাণপ্রত্যাশীদের গুলি, ঠিকাদারের চাঞ্চল্যকর তথ্য

১০

পুতিনের সঙ্গে ফোনালাপের পর ট্রাম্প বললেন, ‘আমি হতাশ’

১১

আমাদের সঙ্গে রাষ্ট্রীয় প্রতারণা করা হয়েছে, বললেন বিসিএস প্রার্থীরা

১২

‘এমন কাউকে নির্বাচিত করবেন না যিনি পালিয়ে যান’

১৩

দলের নাম ভাঙিয়ে অসদাচরণ করলেই ব্যবস্থা : রিজভী

১৪

পুলিশের অভিযানে লাফিয়ে আত্মহত্যার হুমকি আসামির, ভিডিও ভাইরাল

১৫

ইসরায়েলের সঙ্গে সব ধরনের বাণিজ্য বন্ধ করুন : জাতিসংঘ বিশেষজ্ঞ

১৬

২০টি পাসপোর্টসহ ভারতীয় ট্রাকচালক আটক

১৭

তারেক রহমানের নেতৃত্বে জুলাই আন্দোলন সফল হয়েছিল : মীর সপু

১৮

জাতীয় নির্বাচন পিছিয়ে দেওয়ার চক্রান্ত হচ্ছে : শাহাদাত সেলিম 

১৯

হিন্দুদের ওপর নির্যাতনের প্রতিবাদে বগুড়ার শেরপুরে মানববন্ধন

২০
X