আরিয়ান আহমদ রাফির বয়স এখন দেড় বছর। মুখে কেবল কথা ফুটতে শুরু করেছে। আধো আধো বোলে এরই মধ্যে ‘বাবা বাবা’ ডাক শুরু করেছে। কিন্তু অবুঝ এই শিশু জানে না, বাবা বলার আগেই সে তার বাবাকে হারিয়ে ফেলেছে।
ফুটফুটে এই শিশুটির বাবা তারেক আহমদ (২৯) গত বছরের ৫ আগস্ট স্বৈরাচার পতনের বিজয়োৎসব করতে গিয়ে শহীদ হয়েছেন। সিলেটের বিয়ানীবাজার পৌর শহরে বিকেলে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান তারেক। রেখে যান চার মাসের ছেলে শিশু আরিয়ান ও স্ত্রী ছামিয়া আক্তারকে।
তারেক আহমদের বাড়ি বিয়ানীবাজার উপজেলার মোল্লাপুর ইউনিয়নের দক্ষিণ নিদনপুর গ্রামে। তার স্ত্রী ছামিয়া আক্তারের পৈতৃক নিবাস ব্রাক্ষণবাড়িয়া হলেও জন্মসূত্রে সপরিবারে বিয়ানীবাজারের মোল্লাপুর গ্রামে বসবাস করতেন তারা। পাশাপাশি এলাকা হওয়ায় তারেক ও ছামিয়ার মধ্যে গড়ে ওঠে প্রেমের সম্পর্ক। একপর্যায়ে উভয়ের পরিবারের সম্মতিতেই তারা বিয়ে করেন। বিয়ের দুই বছরের মাথায় বিধবা হন ছামিয়া। এতিম হয় তার সন্তান আরিয়ান।
তারেক মারা যাওয়ার মাস দেড়েক পর স্ত্রী ছামিয়া আক্তার ছেলে আরিয়ানকে নিয়ে তার মায়ের কাছে চলে যান। মোবাইল ফোনে কালবেলার সঙ্গে কথা হয় ছামিয়ার। মাত্র ২২ বছর বয়সেই স্বামী হারিয়ে দেড় বছরের ছেলেকে নিয়ে অসহায় হয়ে পড়েছেন ছামিয়া । তিনি বলেন, ‘আমার স্বামী অনেক ভালো মানুষ ছিল। দুই বছরের সংসারে সে কখনো আমার সঙ্গে একটা খারাপ কথাও বলেনি। মৃত্যুর দিন সকালবেলা আমার ও আমার ছেলের সঙ্গে হাসিখুশি হয়ে কথা বলেছে। বিকেলে শুনি আমার স্বামীকে পাওয়া যাচ্ছে না। রাতে শুনি তিনি আর দুনিয়াতে নেই।’
ছামিয়া আক্তার বলেন, ‘আমার স্বামীকে নিয়ে আমি অনেক গর্ব করি। আমার স্বামী দেশের জন্য শহীদ হয়েছেন। আমার ছেলে বড় হলে তার বাবার সম্পর্কে গর্ব করে বলতে পারব।’ সরকারি কোনো সহযোগিতা পাননি জানিয়ে ছামিয়া বলেন, ‘আমার খুব একটা চাওয়া নেই। একটা থাকার ব্যবস্থা, ছেলের ভরণপোষণ, ব্যস এতটুকুই। যদি আমাকে কেউ একটা থাকার ব্যবস্থা ও একটা ছোটখাটো চাকরির ব্যবস্থা করে দিতে পারেন, তাহলে আমি আমার ছেলেকে নিয়ে জীবনের বাকিটা পথ কাটিয়ে দেব।’
ছামিয়া আক্তার আরও বলেন, ‘আমার স্বামীর বাড়িতে তার দুই ভাই ও দুই বোন আছেন। তাদের মা থাকলেও বাবা মারা গেছেন। বর্তমানে শ্বশুরবাড়ির কারও সঙ্গেই আমার যোগাযোগ নেই।’ কোনো সরকারি সহযোগিতা পেয়েছেন কি না, জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘না, এখনো কোনো সরকারি সহযোগিতা পাইনি। আর বিভিন্ন দল কিংবা ব্যক্তি কর্তৃক সহযোগিতা পেলেও সেটা আমার শাশুড়ি ভালো বলতে পারবেন, তবে আমি পাইনি।’
তারেক আহমদ নিহত হওয়ার ঘটনায় গত বছরের ২০ আগস্ট বিয়ানীবাজার থানায় মামলা করেন মা ইনারুন বেগম। মামলা দায়েরের দুদিন পর তিনি আদালতে মামলা প্রত্যাহারেরও আবেদন করেন। ইনারুন বেগম বলেন, ‘৫ আগস্ট বিয়ানীবাজার পৌর শহরে আন্দোলনকারীদের সঙ্গে পুলিশের ব্যাপক সংঘর্ষ চলে। তারেকও আন্দোলনে অংশ নেয়। পরিচিতজন জানান, ওইদিন দুপুরের কোনো এক সময় পুলিশ তারেককে ধরে নিয়ে যায়। সারাদিন পুলিশ-জনতার সংঘর্ষ চলায় পুলিশের সঙ্গে আমরা কোনো যোগাযোগ করতে পারিনি। ঘটনার দিন সন্ধ্যার দিকে পুলিশ আর আন্দোলনকারীদের মধ্যে সংঘর্ষে রায়হান ও ময়নুল নামের দুজন মারা যাওয়ার খবর ছড়িয়ে পড়ে। এই সংবাদে আতঙ্কিত হয়ে পড়ি আমরা। রাতের দিকে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে তারেকের খোঁজ নিই। অনেক জায়গায় খোঁজাখুঁজির পর ৬ আগস্ট ভোরে বিয়ানীবাজার থানার সীমানা দেয়ালের কাছে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় তারেককে পাওয়া যায়। তারেকের কপালে একটি এবং দুই পায়ে গুলির চিহ্ন ছাড়াও শরীরের বিভিন্ন স্থানে আঘাতের চিহ্ন ছিল।’
মন্তব্য করুন