সরকারি জরিপভিত্তিক তথ্যের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান হলো বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস)। দেশের অর্থনীতি, সমাজ, কৃষি, শ্রমবাজার ও দারিদ্র্য সম্পর্কিত প্রায় সব সরকারি সিদ্ধান্তই নির্ভর করে এই সংস্থার তথ্যের ওপর। অথচ সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বিবিএসের তথ্যের নির্ভরযোগ্যতা নিয়ে ক্রমবর্ধমান প্রশ্ন উঠছে দেশের ভেতরে ও বাইরে। এমনকি এই প্রতিষ্ঠানের পরিসংখ্যানের তথ্যের গুণগতমান নিয়ে ব্যবহারকারীদের অর্ধেকেরও বেশি পুরোপুরি সন্তুষ্ট নন। এ ছাড়া বিবিএসের তথ্যের সময়োপযোগিতা এবং সঠিকতা নিয়েও অসন্তুষ্ট উল্লেখযোগ্য সংখ্যক ব্যবহারকারী। খোদ বিবিএসের জরিপেও বিভিন্ন সময় সংস্থাটির পরিসংখ্যান সম্পর্কে ব্যবহারকারীদের অসন্তুষ্টির তথ্য উঠে এসেছে।
জিডিপি প্রবৃদ্ধি, মূল্যস্ফীতি, দারিদ্র্যের হার কিংবা জনসংখ্যা প্রায় প্রতিটি সূচকেই দেখা যাচ্ছে অস্বাভাবিক পার্থক্য। এর ফলে বিবিএসের প্রতি সাধারণ ব্যবহারকারী, গবেষক এবং আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর আস্থা এবং নির্ভরযোগ্যতা সংকটে পড়েছে। অন্তর্বর্তী সরকার একাধিক সংস্কার উদ্যোগ নিলেও বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, এই আস্থা পুনরুদ্ধার করতে হলে বিবিএসকে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত করে একটি স্বতন্ত্র পরিসংখ্যান কমিশনে রূপান্তর করা ছাড়া বিকল্প নেই।
১৯৭১ সালের স্বাধীনতার পর থেকেই বিবিএসকে কেন্দ্র করে তৈরি হয় জাতীয় তথ্য অবকাঠামো। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এই সংস্থার মান ও নির্ভরযোগ্যতা দুই-ই কমেছে। একসময় জাতিসংঘ, বিশ্বব্যাংক বা আইএমএফ যেভাবে বিবিএসের তথ্যের ওপর ভরসা করত, বর্তমানে সেই আস্থা আর নেই। বিশেষ করে গত এক দশকে রাজনৈতিক প্রভাব, পদ্ধতিগত ত্রুটি ও মানবসম্পদ ঘাটতি বিবিএসকে ক্রমেই দুর্বল প্রতিষ্ঠানে পরিণত করেছে, প্রশ্ন উঠেছে সংস্থাটির মান এবং জরিপ কার্যক্রম নিয়েও।
যখন করোনা মহামারিতে দেশের অর্থনীতি প্রায় থমকে গিয়েছিল, তখনো বিবিএস জানায় প্রবৃদ্ধির হার ৫ শতাংশের ওপরে। অথচ বিশ্বব্যাংকের হিসাবে প্রবৃদ্ধি ছিল ৩ শতাংশেরও নিচে। একইভাবে মাথাপিছু আয়ের হিসাবেও দেখা গেছে বড় ফারাক। বিবিএস যেখানে ২ হাজার ৮২৪ ডলার আয় দেখিয়েছে, বিশ্বব্যাংক সেটি নির্ধারণ করেছে ২ হাজার ৬০০ ডলারের নিচে। অর্থনীতিবিদদের মতে, এসব পার্থক্য শুধু পরিসংখ্যানগত নয়, বরং রাজনৈতিক বিবেচনায় তৈরি করা হয় অর্থনৈতিক সাফল্যের চিত্র তুলে ধরতে।
প্রশ্ন উঠেছে জনশুমারির তথ্য নিয়েও। ২০২২ সালের জনশুমারির প্রাথমিক ফলে দেশের জনসংখ্যা ধরা হয়েছিল ১৬ কোটি ৫১ লাখ, কিন্তু চূড়ান্ত ফলে দেখা যায় জনসংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৬ কোটি ৮১ লাখে। অর্থাৎ ৩০ লাখ মানুষের পার্থক্য। বিশেষজ্ঞরা একে ‘অগ্রহণযোগ্য পরিসংখ্যানিক ফাঁক’ বলে অভিহিত করেছেন। তারা মনে করেন, এমন ফল প্রমাণ করে, তথ্য সংগ্রহ ও বিশ্লেষণে বিবিএসের সক্ষমতা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
বিশ্বব্যাংক ২০২২ সালের কান্ট্রি ইকোনমিক মেমোরেন্ডামে স্পষ্টভাবে উল্লেখ করেছে, বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি ও দারিদ্র্যসংক্রান্ত তথ্য আন্তর্জাতিক মানদণ্ডের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। আইএমএফ ২০২৩ সালের মুদ্রাস্ফীতি মূল্যায়ন প্রতিবেদনে জানিয়েছিল, বিবিএসের প্রকাশিত মূল্যস্ফীতি বাস্তব পরিস্থিতি প্রতিফলিত করে না। বিবিএস যেখানে দেখাচ্ছিল মূল্যস্ফীতি ৯ শতাংশের নিচে, বাস্তবে বাজারে খাদ্যদ্রব্যের দাম বাড়ছিল ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ পর্যন্ত। ফলস্বরূপ বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফ তাদের নীতি বিশ্লেষণে বিবিএসের তথ্যের পরিবর্তে বিকল্প উৎস ব্যবহার করছে।
২০২৪ সালে বিবিএসের তথ্য ব্যবহারকারীদের সন্তুষ্টির ওপর ‘ইউজার স্যাটিসফেকশন সার্ভে-২০২৪’ শীর্ষক জরিপ করে বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান (বিআইডিএস)। ওই জরিপে ৩৩.৫৫ শতাংশ উত্তরদাতা জানান, বিবিএসের তথ্য ‘নির্ভরযোগ্য নয়’। আর ৫৫ শতাংশ ব্যবহারকারী জানান, তারা পুরোপুরি সন্তুষ্ট নয়। সরকারি পরিসংখ্যানের তথ্যে সন্তুষ্টির কথা জানান মাত্র ২৯ দশমিক ৩৯ শতাংশ ব্যবহারকারী।
বিশেষ করে মূল্যস্ফীতি ও কৃষি পরিসংখ্যান নিয়ে সন্দেহ সবচেয়ে বেশি। আর গুণগত মানের দিকে থেকে পণ্যমূল্য এবং শ্রম পরিসংখ্যান নিয়ে সবচেয়ে বেশি অসন্তুষ্টির কথা জানান ব্যবহারকারী। সেই সময় সাবেক পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী শামসুল আলমও এ জরিপের ফলের বিষয়ে প্রশ্ন তুলে বলেন, ‘যদি নিজেদের তৈরি তথ্য নিয়েই ব্যবহারকারীদের আস্থা না থাকে, তবে সেটি আমাদের জন্য এক গভীর সতর্কবার্তা।’
বিবিএসের জরিপেও তাদের তথ্য নিয়ে অসন্তুষ্টির কথা জানান ব্যবহারকারীরা। ২০২২ সালে বিবিএসের জরিপে দেখা যায়, ৬৫ শতাংশ ব্যবহারকারী বিবিএসের তথ্য নিয়ে অসন্তুষ্ট। অসন্তুষ্টির কারণ হিসেবে ব্যবহারকারীরা জানান, বিবিএসের জরিপে পর্যাপ্ত তথ্য-উপাত্ত দেওয়া হয় না; তথ্য-উপাত্ত পুরোনো; প্রয়োজনীয় তথ্য থাকে না; আরও তথ্যের প্রয়োজন, তথ্যের উপস্থাপনা ব্যবহারযোগ্য নয়। উত্তরদাতাদের সবচেয়ে বেশি অসন্তুষ্ট জাতীয় আয় শাখার তথ্য-উপাত্ত নিয়ে। পাঁচটি অসন্তুষ্টির সব কটিতেই অর্ধেক উত্তরদাতা সন্তুষ্ট হতে পারেননি।
অভ্যন্তরীণ কাঠামোগত দুর্বলতাও আস্থা সংকটের অন্যতম কারণ। সংস্থাটির প্রায় ৪৫ শতাংশ পদ দীর্ঘদিন ধরে শূন্য। দক্ষ পরিসংখ্যানবিদের অভাব, মাঠপর্যায়ে সীমিত প্রশিক্ষণ এবং ডিজিটাল জরিপ প্রযুক্তির অভাবে অনেক সময় ভুল বা অসম্পূর্ণ তথ্য সংগ্রহ হয়। ম্যানুয়াল ডেটা এন্ট্রি ও পুরোনো কাগজভিত্তিক পদ্ধতি এখনো বহাল, ফলে জরিপের মান ও গতি দুটিই ব্যাহত হয়।
বিবিএসের এমন দুর্বলতার কথা স্বীকার করে সংস্থাটির এক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা বলেন, আমাদের অনেক কর্মকর্তা বিদেশে উচ্চতর ডিগ্রি অর্জন করলেও তারা এখানে স্থায়ীভাবে থাকতে চান না। ধারাবাহিকতা ভেঙে যাওয়ায় কোনো প্রকল্পই স্থায়ীভাবে সফল হয় না।
বিশেষজ্ঞদের মতে, বিবিএসের সবচেয়ে বড় সীমাবদ্ধতা হলো রাজনৈতিক প্রভাব থেকে মুক্ত হতে না পারা। পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের অধীনে থাকায় অনেক সময় রাজনৈতিক নির্দেশে তথ্য প্রকাশে দেরি হয় বা ফল পরিবর্তিত হয়। এ কারণে সংস্থাটির পেশাদারিত্ব প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে।
দায়িত্ব পাওয়ার পর পরিকল্পনা উপদেষ্টা ড. ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ এক সংবাদ সম্মেলনে বলেছিলেন, এখন থেকে কোনো তথ্য প্রকাশের জন্য উপদেষ্টার কাছে এসে অনুমোদন নেওয়ার প্রয়োজন হবে না। সংশ্লিষ্টরা সরাসরি মাঠ থেকে যা পাবেন; তাই প্রকাশ করবেন। কিন্তু উপদেষ্টার দায়িত্ব নেওয়ার বছর পেরোলেও পরিকল্পনা উপদেষ্টাকে না দেখিয়ে এখনো কোনো তথ্য প্রকাশ করে না বিবিএস। অর্থাৎ তথ্য প্রকাশে উপদেষ্টা বা মন্ত্রীর অনুমোদনের নিয়ম বন্ধ হয়নি।
একাধিক গবেষণায় দেখা গেছে, বিবিএসের প্রকাশিত তথ্যের সংজ্ঞা বা পদ্ধতিতে হঠাৎ পরিবর্তন আনা হয়, যাতে আগের বছরের সঙ্গে তুলনা করা যায় না। এতে পরিসংখ্যানের ধারাবাহিকতা ভেঙে যায় এবং গবেষকরা সঠিক বিশ্লেষণ করতে পারেন না। বিশ্বব্যাংকের স্ট্যাটিসটিক্যাল ক্যাপাসিটি ইন্ডিকেটরে বাংলাদেশের স্কোর ২০১৪ সালে ছিল ৮০ (১০০-এর মধ্যে), কিন্তু ২০২০ সালে তা নেমে আসে ৬০-এ। দক্ষিণ এশিয়ার অন্য দেশের তুলনায় এটি অন্যতম নিম্নতম অবস্থান। এ সূচক নির্দেশ করে যে, বাংলাদেশের সরকারি পরিসংখ্যান ব্যবস্থার সামগ্রিক সক্ষমতা হ্রাস পাচ্ছে।
তবে ভালো সংবাদ হলো অন্তর্বর্তীকালীন সরকার বিবিএস সংস্কারের উদ্যোগ নিয়েছে। পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের অধীনে একটি টাস্কফোর্স গঠন করা হয়েছে, যারা বিবিএসকে স্বায়ত্তশাসিত পরিসংখ্যান কমিশনে রূপান্তরের প্রস্তাব দিয়েছে। এ ছাড়া তথ্য প্রকাশের আগে রাজনৈতিক অনুমোদনের বাধ্যবাধকতা তুলে দেওয়ার বিষয়টিও আলোচনায় এসেছে। প্রস্তাবনাগুলোর মধ্যে রয়েছে—আধুনিক জরিপ প্রযুক্তি চালু করা, দীর্ঘমেয়াদি প্রশিক্ষণ কাঠামো তৈরি করা এবং তথ্য যাচাইয়ের জন্য স্বতন্ত্র অডিট প্রক্রিয়া চালু করা। তবে এখনো এসবপ্রস্তাব বাস্তবায়নের কোনো দৃশ্যমান অগ্রগতি নেই।
অর্থনীতিবিদরা বলেছেন, বিবিএসের সামনে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো, রাজনৈতিক প্রভাব থেকে বেরিয়ে পেশাদারিত্বে ফিরে আসা, আধুনিক প্রযুক্তি গ্রহণ করা এবং আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে আস্থা ফিরিয়ে আনা। তারা মনে করেন, ভবিষ্যতে তথ্য বিকৃতি রোধে বিবিএসকে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত করে স্বাধীন ‘বাংলাদেশ পরিসংখ্যান কমিশন’-এ রূপান্তর করা জরুরি। সরকার যদি এ সংস্কারগুলো আন্তরিকভাবে বাস্তবায়ন করতে পারে, তাহলে হারানো বিশ্বাস পুনরুদ্ধার সম্ভব।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক ড. মঈনুল ইসলাম কালবেলাকে বলেন, সাবেক অর্থমন্ত্রী মোস্তফা কামাল দায়িত্বে থাকাকালীন পরিসংখ্যান ব্যুরোকে ডাটা ডক্টরিংয়ের সেন্টারে পরিণত করেছিলেন। এখানে জিডিপির মোট জনসংখ্যাসহ সব তথ্যে গরমিল করেছে। মাথাপিছু জিডিপিকে বাড়ানোর উদ্দেশে জিডিপি প্রবৃদ্ধিকে বাড়িয়ে দেখানো হয়েছে এবং মোট জনসংখ্যাকে কমিয়ে দেখানো হয়েছে। এতে পরিসংখ্যান ব্যুরোর প্রকাশিত তথ্যের বিশ্বাসযোগ্যতা পুরোপুরি নষ্ট হয়ে যায়। অন্তর্বর্তী সরকারকে এ গ্রহণযোগ্যতা ফিরিয়ে আনার দাবি জানান তিনি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক অর্থনীতিবিদ ও বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানে সাবেক মহাপরিচালক ড. মুস্তফা কে মুজেরী বলেন, বিবিএসের ওপর রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ মানে অর্থনীতির বাস্তব চিত্র আড়াল করা। যদি পরিসংখ্যানই বিকৃত হয়, তাহলে নীতিনির্ধারণ ভুল পথে পরিচালিত হবে। তার মতে, আস্থা ফিরিয়ে আনতে হলে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি বাড়াতে হবে, কাঁচা তথ্য জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত করতে হবে এবং আন্তর্জাতিক মানদণ্ড মেনে তথ্য প্রকাশ নিশ্চিত করতে হবে।
এদিকে আজ সারা দেশে পালিত হচ্ছে জাতীয় ও বিশ্ব পরিসংখ্যান দিবস। জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ২০১০ সাল থেকে প্রতি ৫ বছর অন্তর বিশ্বব্যাপী এ দিবসটি উদযাপন হয়ে আসছে। বাংলাদেশেও দিবসটি যথাযোগ্যভাবে পালনের জন্য বিস্তারিত কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে। এ বছর দিবসটির প্রতিপাদ্য হলো ‘সবার জন্যে মানসম্মত পরিসংখ্যান’। এ বিষয়ের মাধ্যমে মূলত মানসম্মত ও যথাযথ পরিসংখ্যান প্রস্তুত ও প্রকাশের ওপর গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। দিবসটি উপলক্ষে জাতীয় পর্যায়ে সেমিনার আয়োজন, ক্রোড়পত্র ও স্মরণিকা প্রকাশ এবং র্যালিসহ নানা কার্যক্রম গ্রহণ করেছে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস)।
মন্তব্য করুন