

রাজধানী ঢাকাকে বলা হয় দেশের রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দু। দেশের ৩০০টি সংসদীয় আসনের মধ্যে ২০টি ঢাকা জেলায়। এমন কথা প্রচলিত আছে যে, ঢাকা যার, দেশ তার। স্বভাবতই ঢাকার কান্ডারি কারা হচ্ছেন, সেই দিকে চোখ থাকে সবার। সে অনুযায়ী রাজনৈতিক দলগুলোও নিজেদের হেভিওয়েট প্রার্থীদের ঢাকার আসনে মনোনয়ন দিয়ে থাকে। যারই ধারাবাহিকতায় পিছিয়ে নেই তরুণদের নতুন রাজনৈতিক দল জাতীয় নাগরিক পার্টিও (এনসিপি)। দলটির শীর্ষ নেতারা ঢাকায় বেশ কয়েকটি আসনে নির্বাচনের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছেন।
এনসিপির সর্বোচ্চ ফোরাম ১০ সদস্যের ‘পলিটিক্যাল কাউন্সিল’। এ ফোরামের ছয়জনই ঢাকা থেকে নির্বাচন করবেন বলে কালবেলাকে জানিয়েছেন দলটির দায়িত্বশীল এক নেতা। গণসংযোগসহ বিভিন্নভাবে নিজেদের প্রার্থিতার জানান দিচ্ছেন তারা। অনেকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সরব রয়েছেন। এনসিপি নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ঢাকার আসনগুলোকে বিশেষভাবে দেখা হচ্ছে। তাই দলের হেভিওয়েট প্রার্থীদের বেশিরভাগই নির্বাচন করছেন ঢাকা থেকে। ঢাকার অন্তত পাঁচ আসনে জয় নিশ্চিত করতে চান তারা। এ ছাড়া ঢাকার বাইরেও বেশ কয়েকজন শক্ত প্রার্থী আছে এনসিপির।
দলটির নেতারা জানান, ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ৩০০ আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতার জন্য জাতীয় নাগরিক পার্টির মনোনয়ন ফরম সংগ্রহ করেছেন ১ হাজার ৮৪ জন। মনোনয়ন ফরম বিক্রির পর যাচাই-বাছাইও প্রায় শেষ। শিগগির প্রথম ধাপের প্রার্থী তালিকা প্রকাশ করবে দলটি। এরই মধ্যে ঢাকাসহ অন্তত ১৫০টি আসনে দলীয় প্রার্থীর একটি খসড়া তালিকা তৈরি করেছে এনসিপি। এসব আসন ধরে কাজ করছেন তারা। সংশ্লিষ্টরা জানান, এনসিপিকে নিজেদের নির্বাচনী জোটে পেতে চায় বিএনপি। তবে এক্ষেত্রে জামায়াতে ইসলামীও পিছিয়ে নেই। তারাও এনসিপিকে তাদের নির্বাচনী জোটে টানার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। এজন্য উভয় দল থেকে বিশেষ দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিনিধিরা পর্দার আড়ালে এনসিপির সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে আলোচনা অব্যাহত রেখেছেন। তবে আপাতত এককভাবে ৩০০ আসনে প্রাথমিক প্রার্থী ঘোষণা করতে চায় এনসিপি। পরবর্তী সময়ে জোট বা আসন সমঝোতা হলে সে অনুযায়ী চূড়ান্ত তালিকা প্রকাশ করা হবে।
এনসিপির মুখ্য সমন্বয়ক ও কেন্দ্রীয় নির্বাচন পরিচালনা কমিটির প্রধান নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী কালবেলাকে বলেন, ‘এনসিপির হয়ে নির্বাচন করতে প্রায় ১৫শ জন মনোনয়ন কিনেছেন। যাচাই-বাছাইয়ের কাজ শেষ পর্যায়ে আছে।
আমাদের প্রার্থী তালিকা প্রস্তুত হচ্ছে। খুব শিগগির আমরা প্রথম ধাপের প্রার্থী তালিকা প্রকাশ করব। আমরা সৎ প্রার্থীদের মনোনয়ন দিচ্ছি, এটি আমাদের বড় চমক। কারণ ৫৩ বছরের রাজনীতির ইতিহাসে কোনো দল এমন দৃষ্টান্ত দেখাতে পারেনি। বড় দলগুলো এবারও গতানুগতিক ধারায় প্রার্থী বাছাই করছে। বিপরীতে আমরা সৎ ও অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রার্থী দিচ্ছি। যারা দুর্নীতি-চাঁদাবাজি করেছে—এমন একজন লোকও এনসিপি থেকে মনোনয়ন পাবে না।’
প্রার্থী চূড়ান্তের বিষয়ে দলটির যুগ্ম আহ্বায়ক সারোয়ার তুষার কালবেলাকে বলেন, ‘আগামী ১০ ডিসেম্বরের মধ্যে আমরা প্রাথমিক প্রার্থী তালিকা প্রকাশ করব। প্রথম ধাপে শখানেক প্রার্থী ঘোষণা করার পরিকল্পনা আছে। বিগত আন্দোলন-সংগ্রামে তাদের অবদান ছিল কি না, স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে তাদের কতটা অবদান ছিল, দলের পেছনে কতটা সময় দিয়েছেন, জনপ্রিয়তা এবং জিতে আসার সম্ভাবনা আছে কি না—এ বিষয়গুলো বিবেচনায় নিয়ে প্রার্থী চূড়ান্ত করা হচ্ছে।’
জানা গেছে, এনসিপির সর্বোচ্চ ফোরাম পলিটিক্যাল কাউন্সিলের ১০ জনের মধ্যে ছয়জনই ঢাকা থেকে নির্বাচন করবেন। তাদের মধ্যে রামপুরা, হাতিরঝিল ও ভাটারা এবং উত্তর সিটি করপোরেশনের ৯টি ওয়ার্ড নিয়ে গঠিত ঢাকা-১১ আসন থেকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে দলের মনোনয়ন ফরম নিয়েছেন আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম। এ আসনেই তার বসবাস। প্রকাশ্যে প্রচার-প্রচারণা শুরু না করলেও নীরবে কাজ করছেন বলে জানা গেছে। পলিটিক্যাল কাউন্সিলের অন্যদের মধ্যে সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক সামান্তা শারমিন মোহাম্মদপুর, আদাবর, শেরেবাংলা নগর (আংশিক) নিয়ে গঠিত ঢাকা-১৩; আরেক সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক আরিফুল ইসলাম আদীব ঢাকা-১৪ (মিরপুর) অথবা ঢাকা-১৫ (কাফরুল) আসনে নির্বাচন করবেন। সিনিয়র যুগ্ম সদস্য সচিব তাসনিম জারা সবুজবাগ, খিলগাঁও ও মুগদা এলাকা নিয়ে গঠিত ঢাকা-৯; আরেক সিনিয়র যুগ্ম সদস্য সচিব নাহিদা সারোয়ার নিভা ঢাকা-১২ (তেজগাঁও) এবং মুখ্য সমন্বয়ক নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী বৃহত্তর উত্তরা ও বিমানবন্দর এলাকা নিয়ে গঠিত ঢাকা-১৮ আসন থেকে নির্বাচন করবেন।
ঢাকার অন্য আসনগুলোতেও এনসিপির প্রার্থী কারা হচ্ছেন, তার খসড়া তালিকা তৈরি হয়েছে। সে অনুযায়ী সম্ভাব্য এসব প্রার্থী প্রস্তুতিও নিতে শুরু করেছেন। তাদের মধ্যে লালবাগ, চকবাজার, বংশাল, কামরাঙ্গীরচর (আংশিক) ও কোতোয়ালি (আংশিক) এলাকা নিয়ে গঠিত ঢাকা-৭ আসন থেকে নির্বাচন করতে পারেন দলটির যুগ্ম সদস্য সচিব আরিফ সোহেল, যদিও এই আসনে দক্ষিণাঞ্চলের সংগঠক আসাদ বিন রনিও মনোনয়ন চান। ঢাকা-১৯ (সাভার) আসন থেকে নির্বাচন করবেন যুগ্ম সদস্য সচিব ফয়সাল মাহমুদ শান্ত, জাতীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য ও ঢাকা মহানগর দক্ষিণের যুগ্ম সমন্বয়কারী এস এম শাহরিয়ার ঢাকা-৫ (ডেমরা) আসন থেকে মনোনয়ন পেতে পারেন। এ আসনে কেন্দ্রীয় সদস্য সালাউদ্দিন জামিল সৌরভও মনোনয়ন চেয়েছেন। এ ছাড়া কেন্দ্রীয় সদস্য খান মো. মোরসালিন ঢাকা-৬, ঢাকা জেলার প্রধান সমন্বয়কারী মো. রাসেল আহমেদ ঢাকা-১ (দোহার-নবাবগঞ্জ), জাতীয় যুব শক্তির সদস্য সচিব ডা. জাহেদুল ইসলাম ঢাকা-৪ (শ্যামপুর-কদমতলী) আসন থেকে নির্বাচন করবেন।
এনসিপির সর্বোচ্চ ফোরাম পলিটিক্যাল কাউন্সিলের চার সদস্য ঢাকার বাইরে থেকে নির্বাচন করার ঘোষণা দিয়েছেন। যেখানে দলের কেন্দ্রীয় সদস্য সচিব আখতার হোসেন (রংপুর-৪), উত্তরাঞ্চলীয় মুখ্য সংগঠক সারজিস আলম (পঞ্চগড়-১), দক্ষিণাঞ্চলীয় মুখ্য সংগঠক হাসনাত আব্দুল্লাহ (কুমিল্লা-৪) ও যুগ্ম মুখ্য সমন্বয়ক আব্দুল হান্নান মাসউদ নোয়াখালী-৬ আসনে নিয়মিত যাতায়াত ও সভা-সমাবেশ করছেন।
এদিকে নির্বাচন সামনে রেখে কূটনীতিকদের সঙ্গে যোগাযোগ বাড়াচ্ছে এনসিপি। এ বিষয়ে আন্তর্জাতিক মিশনবিষয়ক উপকমিটির সেক্রেটারি আলাউদ্দিন মোহাম্মদ বলেন, কূটনীতিকদের সঙ্গে কার্যকর যোগাযোগ রাখা হচ্ছে। প্রাক-নির্বাচনী টিমগুলোর সঙ্গে নিয়মিত বসা হচ্ছে ও নির্বাচনকে গ্রহণযোগ্য করার ক্ষেত্রে কীভাবে কমিশনকে আরও কার্যকর করা যায়, সে বিষয়ে তাদের অবহিত করা হচ্ছে। একই সঙ্গে শুধু বিএনপি, জামায়াত নয়, অন্য দলের সঙ্গেও যোগাযোগ বাড়িয়েছে এনসিপি। জোট হিসেবেই বিএনপি বা জামায়াতের সঙ্গে আসন ভাগাভাগির দরকষাকষি হবে। যার সঙ্গে লাভ হবে, তার সঙ্গে জোট বা সমঝোতা করা হবে। লাভ না হলে এককভাবেই নির্বাচনের পক্ষে নেতাকর্মীরা।
জোটগতভাবে নির্বাচনে যাওয়া প্রসঙ্গে এক অনুষ্ঠানে এনসিপির উত্তরাঞ্চলের মুখ্য সংগঠক সারজিস আলম বলেন, ‘এটি নির্ভর করবে বেশকিছু বিষয়ের ওপর। যে রাজনৈতিক দল জুলাই সনদে থাকা মৌলিক সংস্কারগুলো বাস্তবায়নে নিশ্চয়তা দেবে, শহীদ পরিবার ও আহত যোদ্ধাদের নিরাপত্তা ও পুনর্বাসনের প্রতিশ্রুতি দেবে এবং কাজে ও কথায় মিল থাকবে, তাদের সঙ্গে আমাদের জোট হতে পারে। এখন পর্যন্ত বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলোচনা চলছে। এনসিপি যদি এ প্রতিশ্রুতিগুলো পায়, তাহলে কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে জোট হতে পারে। যদি না পায়, তাহলে শুধু কয়েকটি আসনের জন্য এনসিপি জোট করবে না। এনসিপি একেকভাবে নির্বাচন করবে।’
মন্তব্য করুন