পাবনার বেড়ায় কাগেশ্বরী নদীর ধারে কৈটলা গ্রাম। সেখানকার বিঘা ছয়েক আয়তনের জমিতে একটি ছোট অভয়ারণ্য। যেখানে প্রবীণ দুই ভাইবোনের বসবাস। কিছুটা রহস্যময়, কিছুটা কাব্যিক মনে হয় শুনলে। কিন্তু ৮৭ বছর বয়সী আকাশ কলি দাস ও তার বোন ৬১ বছর বয়সী ঝর্ণা দাসের এক জীবন কেটে গেছে এই জঙ্গলেই। বিয়ে করেননি কেউই। কালে কালে তাদের সম্পত্তিই রূপান্তরিত হয়েছে অভয়ারণ্যে। যেখানে হাজারো পাখির কিচিরমিচির ডাকে আকাশ-বাতাস মুখর হয়ে থাকে রাতদিন। মনুষ্যসৃষ্ট সে জঙ্গলে আছে আম, কাঁঠাল, কোয়াসা, পাপনা, দেবদারু কিংবা ভারতীয় পার্সিমন গাউবিসহ দেশি-বিদেশি নানা গাছ। কলি দাসের ভাষায়, ছোট এই জঙ্গলে যখন পাখিরা দল বেঁধে বাসা বাঁধে, ডিম পাড়ে, বাচ্চা ফোটায়, তখন তৈরি হয় নৈসর্গিক এক দৃশ্য।
স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, বাবা-মায়ের ছয় সন্তানের মধ্যে সবার বড় কলি দাস। বর্তমানে আত্মীয়স্বজন বলতে কেউই নেই। যারাও বা আছেন, তারাও সীমান্তের ওপারে। স্বাধীনতার আগেই চলে গেছেন ভারতে। বাবা চন্দ্র কুমার দাস ছিলেন পাবনার নগরবাড়ির শ্রীনিবাস দিয়ার জমিদারবাড়ির নায়েব। বাবার মৃত্যুর পর মাত্র ১৭ বছর বয়সে সংসারের হাল ধরতে হয় কলি দাসকে। সে সময়ই দায়িত্বের ভারে হারিয়ে যায় কৈশোর। একসময় দুই বোন ও এক ভাইয়ের বিয়ে দেন ভারতে। সঙ্গে থেকে যায় এক বোন।
সরেজমিন দেখা যায়, চার চালা ঘরে বসবাস ভাইবোনের। আরেকটি ছোট দোচালা ঘরে চলে রান্নাবান্না। পাশেই গোয়ালঘর। সেখানে বেশ কয়েকটি গরু বাঁধা। বাড়িজুড়ে সুনসান নীরবতা। শুধু পাখির কলতানে মুখর চারপাশ।
ঝোপ-জঙ্গলে দেখা মেলে বহু অচেনা পাখির। এই রূপকথার মতো করে সাজানো বাস্তবের এই জঙ্গলবাড়িতে দুজন ছাড়া আর কেউ নেই।
বসতভিটায় সাড়ে ৬ বিঘার পাশাপাশি পাশের মাঠেও আছে কমপক্ষে অর্ধশত বিঘা জমি। এমন অঢেল সম্পদের মালিক হয়েও প্রবীণ ভাইবোনের জীবন যাপন অতি সাদামাটা। ধনসম্পত্তি নিয়ে তাদের নেই চিন্তা, নেই কোনো মোহ। নিরিবিলি পরিবেশে শান্তি আর নির্ঝঞ্ঝাট জীবন কাটাতেই যেন স্বাচ্ছন্দ্য তাদের।
প্রতিবেশীরা জানান, ছোটবেলা থেকেই এ জঙ্গলে পাখির আসা-যাওয়া দেখি। কেউ পাখি শিকার করতে এলে কলি দাস তাদের বাধা দেন। তবে তিনি ও তার বোন ঠিক কী কারণে বিয়ে করেননি, তা বলতে পারেননি। মাঝে মাঝে আকাশ কলির দেখা মিললেও বোন ঝর্ণাকে দেখা যায় না কখনো।
আকাশ কলি দাস জানান, সৃষ্টিকর্তাকে বিশ্বাস করি। দুনিয়ায় অতিথি হিসেবে এসেছি, চলে যাব। লোকে বলে এ সম্পত্তি আমার, আসলে তা নয়। তিনি আরও বলেন, এত বয়স হলেও স্বার্থহীন মানুষ দেখলাম না, সবাই স্বার্থ নিয়ে আসে, তার বাইরে কেউ নেই। সংবাদদাতা তার সম্পত্তির বিষয়ে জিজ্ঞেস করলে কলি দাস বলেন, আমি মারা যাওয়ার পর লাশ উঠানেই থাকবে। একজন আরেকজনকে রক্তাক্ত করবে আর বলবে—তার নামে জায়গা লিখে দিয়ে গেছি। ভয় হয়, মরে গেলে বোনের কী হবে। আমার এত বছরের সাধনা এই পশুপাখির প্রতি ভালোবাসার কী হবে?