স্বাধীনতার রক্তিম সূর্যের ঊষালগ্নে একাত্তরের ১৪ ডিসেম্বর শিক্ষক, সাহিত্যিক, সাংবাদিক, চিকিৎসকসহ নানা শ্রেণি-পেশার শ্রেষ্ঠ সন্তানদের হত্যা করা হয়। ওই ঘটনা কার্যত একটি জাতিকে নির্মূলের পরিকল্পিত গণহত্যা ছিল। জাতিকে মেধাশূন্য করার নীলনকশা। ওই পাশবিক হত্যাযজ্ঞ শুধু অপরাধীর অপরাধের মাত্রাই বাড়ায়নি, গোটা জাতির হৃদয়ে অবর্ণনীয় এক যন্ত্রণার ছাপ এঁকে দেয়। দশকের পর দশক ধরে জাতি ও শহীদ বুদ্ধিজীবীদের পরিবারের সদস্যরা সেই অব্যক্ত যন্ত্রণা বুকে চেপে আছেন।
দীর্ঘদিন একটি জাতির বয়ে বেড়ানো যন্ত্রণা লাঘবের পথ খোলে ২০১৩ সালে বুদ্ধিজীবী হত্যার বিচারের মধ্য দিয়ে। বিচারে জামায়াতে ইসলামীর তৎকালীন সহযোগী সংগঠন ইসলামী ছাত্রসংঘের ওই সময়কার দুই কেন্দ্রীয় নেতা চৌধুরী মঈনুদ্দীন ও আশরাফুজ্জামান খানকে দেওয়া হয় ফাঁসির দণ্ড। কিন্তু সেই রায় ঘোষণার পর দীর্ঘ ১০ বছর পার হয়ে গেছে। ওই দুই খুনি কোথায় আছে, তা সবার জানা। কিন্তু তাদের দেশে ফিরিয়ে আনা সম্ভব হয়নি। ফলে বুদ্ধিজীবী হত্যার বিচারের রায় বাস্তবায়ন হয়নি। মূল অপরাধীদের শাস্তি না হওয়ায় যন্ত্রণা কমেনি শহীদ পরিবারগুলোর।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সর্বশেষ ব্রিফিংয়ে এই দুই ঘাতকের ব্যাপারে প্রশ্নের জবাবে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জনকূটনীতি অনুবিভাগের মহাপরিচালক ও মুখপাত্র সেহেলী সাবরীন জানান, ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় দেশের বুদ্ধিজীবীদের হত্যার দায়ে মৃত্যুদণ্ড এড়িয়ে যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসরত চৌধুরী মঈনুদ্দীন ও আশরাফুজ্জামান খানকে দেশে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা অব্যাহত রেখেছে সরকার। দুই দেশের সঙ্গে সরকার যোগাযোগ রক্ষা করে চলেছে। আইনি প্রক্রিয়াও চলছে।
বুদ্ধিজীবীদের প্রধান দুই খুনির ফাঁসি কার্যকর না হওয়ার বিষয়ে শহীদ বুদ্ধিজীবী ডা. আবদুল আলিম চৌধুরীর সহধর্মিণী শ্যামলী নাসরিন চৌধুরী বলেন, আমাদের যে যন্ত্রণা সেটা একবিন্দুও প্রশমিত হয়নি। কারণ আজও দুই প্রধান খুনির ফাঁসি কার্যকর করা যায়নি। তিনি বলেন, বর্তমান সরকার বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার করেছে, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করেছে। এখন দুই খুনি যেসব দেশে পলাতক আছে, তারা ফেরত দিতে চাচ্ছে না। যে কারণে সরকারের চেষ্টা সফল হচ্ছে না। তারপরও আশায় বসে আছি। তাদের একদিন ফাঁসি কার্যকর হবে। তখন হয়তো মনটা কিছুটা শান্ত হবে।
শহীদ বুদ্ধিজীবীদের স্মরণে প্রতিবছর ১৪ ডিসেম্বর বিনম্র শ্রদ্ধায় জাতি পালন করে শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস। জাতির জন্য এটি বেদনাদায়ক একটি কালো দিন। সুসংগঠিত পরিকল্পনায় ১৯৭১ সালের এই দিনে জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানদের নির্মমভাবে হত্যা করে পাকিস্তানের দখলদার সেনাবাহিনীর দেশীয় দোসর আলবদররা। ২০১৩ সালের ৩ নভেম্বর আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২ এই ‘বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের’ মূল ঘাতক আশরাফুজ্জামান খান ওরফে নায়েব আলী খান এবং চৌধুরী মঈনুদ্দীনকে দোষী সাব্যস্ত করে রায় ঘোষণা করেন। শহীদ বুদ্ধিজীবী অধ্যাপক গিয়াস উদ্দিন হত্যা মামলাটিকে সূত্র ধরে অত্যন্ত গোপনীয়তার সঙ্গে ২০১০ সালে তদন্ত শুরু করে ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থা। এক বছরের বেশি সময় তদন্ত করে প্রতিবেদন দাখিল করে প্রসিকিউশনের কাছে। পরে এ মামলায় ১১টি অভিযোগে চার্জ গঠন করা হয়। ২৫ জন সাক্ষীর মৌখিক সাক্ষ্য ও দালিলিক সাক্ষ্য তথা তথ্যনির্ভর সমসাময়িক দেশি-বিদেশি পত্রপত্রিকার প্রতিবেদন বিবেচনায় নিয়ে ট্রাইব্যুনাল প্রতিটি চার্জেই এ দুই অভিযুক্ত ব্যক্তিকে দোষী সাব্যস্ত করে সর্বোচ্চ সাজা মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করেন। তাদের বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধের সময় শিক্ষক, সাংবাদিক, চিকিৎসকসহ ১৭ বুদ্ধিজীবীকে অপহরণের পর হত্যার অভিযোগ প্রমাণিত হয়। দণ্ডিত ব্যক্তিরা শুরু থেকেই পলাতক থাকায় কখনো আপিল করেনি।
সরকারের কাছে খবর রয়েছে, আশরাফুজ্জামান বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের জ্যামাইকায় রয়েছে। আর মঈনুদ্দীন যুক্তরাজ্যের লন্ডনে বসবাস করছে। তাদের মধ্যে মঈনুদ্দীন একাত্তরে দৈনিক পূর্বদেশের সাংবাদিক ছিল। স্বাধীনতার পর সে পাকিস্তান হয়ে যুক্তরাজ্যে পালিয়ে যায়। লন্ডনের টটেনহ্যাম মসজিদ পরিচালনা কমিটির চেয়ারম্যান সে।
ট্রাইব্যুনালের রায়গুলো পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, পাকিস্তানি সেনাদের সঙ্গে বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের নীলনকশা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করেছিল এদেশীয় চারজন। তারা হলো জামায়াতের সাবেক আমির মতিউর রহমান নিজামী ও সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদ, ’৭১-এর গুপ্তঘাতক আলবদর বাহিনীর কমান্ডার চৌধুরী মঈনুদ্দীন ও আশরাফুজ্জামান খান। তাদের মধ্যে নিজামী ও মুজাহিদের ফাঁসির দণ্ড কার্যকর হয়েছে।
তদন্ত সংস্থা সূত্র জানায়, ’৭১ সালে রাজধানীর মোহাম্মদপুরের শারীরিক শিক্ষা কলেজে (তৎকালীন ফিজিক্যাল ট্রেনিং ইনস্টিটিউট) পাকিস্তানি সেনা, রাজাকার ও আলবদর বাহিনীর ক্যাম্প বসানো হয়েছিল। আলবদর ও রাজাকাররা সেখানে পাকিস্তানি সেনাদের কাছে অস্ত্র চালনার প্রশিক্ষণ নিত। আর বাঙালিদের ধরে এনে নির্যাতনের পর হত্যা করত। পাকিস্তানি সেনাদের সঙ্গে বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের পরিকল্পনা করেছিল নিজামী ও মুজাহিদ। আর আলবদর সদস্যদের সঙ্গে নিয়ে ওই পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করত মঈনুদ্দীন ও আশরাফুজ্জামান। একাত্তরে ‘বাঙালি বুদ্ধিজীবীদের কসাই’ নামে পরিচিত আশরাফুজ্জামান ছিল ঘাতক বাহিনীর ‘চিফ এক্সিকিউটর’ আর মাঈনুদ্দীন ছিল ‘অপারেশন ইনচার্জ’। বুদ্ধিজীবীদের ধরে নিয়ে নির্মম নির্যাতন শেষে হত্যা করে রায়েরবাজার ইটখোলা ও মিরপুরের বধ্যভূমিতে মরদেহ ফেলে দেওয়া হতো।
সূত্র জানায়, মঈনুদ্দীনকে ফেরত দেওয়ার বিষয়ে যুক্তরাজ্যের সঙ্গে সরকারের বিভিন্ন পর্যায় থেকে কথা হচ্ছে। আলোচনা সাপেক্ষে যে কোনো আসামিকে ফেরত দিতে পারে যে কোনো দেশ। এ ক্ষেত্রে অনেক সময় বন্দি বিনিময় চুক্তিও লাগে না। ফলে এখন ঢাকা-লন্ডনের আলোচনার ওপরই নির্ভর করবে মঈনুদ্দীনের ফেরতের বিষয়টি।
মামলা ধামাচাপা: শহীদ গিয়াস উদ্দিনের বোন অধ্যাপক ফরিদা বানু ১৯৯৭ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর রমনা থানায় প্রচলিত ফৌজদারি কার্যবিধির ১২০(খ)/৪৪৮/৩৬৪/৩০২/২০১/৩৪/১১৪ ধারায় মামলা করেন। অধ্যাপক গিয়াস উদ্দিন অপহরণ ও হত্যা মামলায় আসামি করা হয়েছিল মঈনুদ্দীন ও আশরাফুজ্জামানকে। কিন্তু ২০০২ সালে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার আমলে হত্যা, অপহরণ ও ষড়যন্ত্রের সুনির্দিষ্ট অভিযোগ সত্ত্বেও আইনের ভুল ধারায় মামলার অজুহাত তুলে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিলের মাধ্যমে মামলাটির অপমৃত্যু ঘটানো হয়।