নোয়াখালী জেলার হাতিয়ার পাশে পানিকাটা (Indian Skimmer) পাখির জন্য বিখ্যাত দমার চর ভ্রমণ শেষে নিঝুম দ্বীপে ফিরছি। মাঝি বলল, যে পথে এসেছি, সে পথে ফিরলে সময় কম লাগবে; কিন্তু আমার পীড়াপীড়িতে শেষ পর্যন্ত নৌকা নদীপথে না গিয়ে ঘোরা পথে সমুদ্রের পাশ দিয়ে যেতে বাধ্য হলো। ভেবেছিলাম সমুদ্রপথে নতুন কিছু পাখি পাওয়া যেতে পারে; কিন্তু কপাল ভালো না, সমুদ্রপথে আদতে নতুন দূরের কথা কোনো পাখিরই দেখা পেলাম না। সমুদ্রপথের শেষ প্রান্তে নিঝুম দ্বীপ সৈকতের কাছাকাছি আসার পর বেশকিছু পাখির ওড়াউড়ি চোখে পড়ল। প্রথমেই দেখা হলো লালশির (Eurasian Wegeon) হাঁসের সঙ্গে, এরপর কালোলেজ জৌরালি (Black-tailed Godwit) এবং সবশেষে এলো মাথায় কালো টুপি পরা কমলা চঞ্চু ও দীর্ঘ চেরা লেজের একটি সাদা পাখি। ওর ছবি তুললাম ঠিকই; কিন্তু তা শুধুই সাক্ষী হিসেবে। কারণ, ২৪-১৩৫ মিলি লেন্স দিয়ে তো আর ৩০০ মিলি প্রাইমের কাজ হবে না। যাহোক পাখিটির ছবি তুলে চুপচাপ বসে আছি। এমন সময় হঠাৎ করে আমাকে থমকে দিয়ে পাখিটি নৌকার ঠিক ওপর দিয়ে উড়ে গেল। কাজেই ক্যামেরা রেডি করে নড়েচড়ে বসলাম। আবার যদি কাছে চলে আসে, তাহলে ২৪-১৩৫ মিলি লেন্স দিয়েই ভালো ছবি তুলব। ধৈর্য ধরে বসলাম। কাজ হলো। পাখিটি বেশ কয়েকবার নৌকার কাছাকাছি উড়ল। আর আমিও পেয়ে গেলাম ওর বেশকিছু ঝকঝকে উড়ন্ত ছবি।
নিঝুম দ্বীপের মাথায় কালো টুপি পরা কমলা চঞ্চু ও দীর্ঘ চেরা লেজের পাখিটি এ দেশের দুর্লভ ও প্রায় শঙ্কাগ্রস্ত আবাসিক পাখি জলকাজল। মাছ খাইক্কা, মাছ খাইক্কা গাংচিল বা নদীচিল নামেও পরিচিত। ইংরেজি নাম River Tern বা Indian River Tern। ল্যারিডি গোত্রের পাখিটির বৈজ্ঞানিক নাম Sterna aurantia। বাংলাদেশ ছাড়াও ওরা ভারতীয় উপমহাদেশসহ বিভিন্ন দেশ, মিয়ানমার, ভিয়েতনাম, থাইল্যাল্ড, চীন প্রভৃতি দেশে বাস করে। জলকাজলের দেহের দৈর্ঘ্য ৩৮-৪৬ সেন্টিমিটার (সেমি), প্রসারিত ডানা ৮০-৮৫ সেমি ও ওজন ৪৭-৬৩ গ্রাম। প্রজননকালে প্রাপ্তবয়স্ক পাখির দেহের ওপরটা ধূসরাভ ও নিচটা ধূসরাভ-সাদা হয়। মাথার চাঁদি, কপাল ও ঘাড়ের পেছনটা হয় কালো; গাল সাদা। প্রান্ত-পালকসহ ডানা রং গাঢ় ধূসর। কোমর ও দীর্ঘ চেরা লেজ হালকা ধূসর। চোখের রং বাদামি ও চঞ্চু উজ্জ্বল কমলা-হলুদ। পা ও পায়ের পাতা লাল। প্রজননহীন পাখির মাথার চাঁদি ও ঘাড়ের পেছনে সাদা-কালো ডোরা, ধূসর কান-ঢাকনির কিনারা ও ঘাড়ের পাশ কালচে এবং কালচে আগাসহ চঞ্চু অনুজ্জ্বল হলুদ। অপ্রাপ্তবয়স্ক পাখির দেহের ওপরটা বাদামি ও নিচটা সাদা এবং সাদা ডোরাসহ মাথা কালচে-বাদামি।
ওরা সারা দেশের উপকূল বরাবর, হ্রদ ও বড়ো নদীতে একাকী, জোড়ায় বা ছোটো দলে বিচরণ করে। পানির অল্প ওপর দিয়ে উড়ে উড়ে হঠাৎ করে ঝাঁপ দিয়ে পানি থেকে মাছ, জলজ পোকামাকড় এবং কাঁকড়া ও চিংড়িজাতীয় প্রাণী শিকার করে। প্রায়ই পানির পাশে কাদায় বসে থাকতে দেখা যায়। ওড়ার সময় উচ্চ স্বরে ও মনোরম কণ্ঠে ‘কিউক-কিউক-কিউক…’ শব্দে ডাকে। এপ্রিল থেকে জুন প্রজননকাল। এ সময় জলকাজল নদীচর বা উপকূলীয় দ্বীপে বালুতে সামান্য খোদল করে বাসা বানায়। ডিম পাড়ে তিন-চারটি। ডিমের রং গাঢ় ছিট-ছোপসহ পীতাভ-বাদামি বা সবুজাভ-ধূসর। ডিম ফোটে ১৮-১৯ দিনে। ডিমে তা দেওয়া ও ছানাদের লালন-পালন স্ত্রী-পুরুষ মিলেমিশে করে। আয়ুষ্কাল ১১-১২ বছর।
লেখক : পাখি ও বন্যপ্রাণী প্রজনন ও চিকিৎসা বিশেষজ্ঞ এবং অধ্যাপক, বশেমুরকৃবি, গাজীপুর
মন্তব্য করুন