ভারী বৃষ্টি ও উজানের ঢলে পানি বাড়ছে কুড়িগ্রামের নদনদীতে। এর মধ্যে রোববার ভোর থেকে ভারতের দিক থেকে কালজানি নদী হয়ে ভেসে আসতে থাকে হাজার হাজার গাছের গুঁড়ি। এসব গুঁড়ি বাকল ও শিকড়বিহীন হওয়ায় এবং দেখতে লাল বর্ণের হওয়ায় উৎসুক জনতা ‘রক্ত চন্দন’ ভেবে ভিড় করছেন।
কেউ কেউ জীবনের ঝুঁকি নিয়ে নদীর স্রোতকে উপেক্ষা করে নদীতে ঝাঁপ দিয়ে এসব গাছের গুঁড়ি নিয়ে এসে তীরে জমিয়ে সেগুলো ‘চন্দন কাঠ’ হিসেবে বিক্রি করছেন।
অনেকেই আবার না বুঝেই সেগুলো কিনছেন। উৎসুক জনতার এমন কাণ্ড দেখে স্থানীয়রা এসব কাঠের গুঁড়ি একেকটি ২০ থেকে ৩৫ হাজার দাম হাঁকাচ্ছেন। কেউ কেউ ১ লাখ ২০ হাজার পর্যন্ত দাম চাচ্ছেন।
তবে জেলা বন বিভাগ বলছে মানুষজন না বুঝেই এসব কাঠের গুঁড়ি শ্বেত বা রক্ত চন্দন ভেবে বেচা-কেনা করছেন ।
ইতোমধ্যে এসব গাছের গুঁড়ি উঠাতে গিয়ে রোববার (৫ অক্টোবর) সকালে মনছুর আলী (৪০) পানিতে ডুবে নিখোঁজ হয়েছেন।
ভেসে আসা গুঁড়িগুলো মূল্যবান ভেবে কালজানি ও দুধকুমার নদের পাড়ে স্তূপ করে রেখেছেন স্থানীয় উৎসুক জনতা। এগুলো আকার ও পরিমাপ ভেদে ২০ থেকে ২৫ হাজার টাকায় বেচা-কেনা হচ্ছে। আর যেসব কাঠ নষ্ট হয়ে গেছে সেগুলো জ্বালানি হিসেবে কেউ কেউ বাড়িতে নিয়ে যাচ্ছেন, আবার অনেকেই সেগুলো মণ হিসেবে বিক্রি করছেন।
বামনডাঙ্গা তেলিয়ানীর স্কুলশিক্ষক ওছমান গণি জানান, শনিবার গভীর রাতে হঠাৎ মানুষের শোরগোল ও চিৎকার শুনে ঘুম ভাঙে। ভেবেছেন চোর পড়েছে গ্রামে। দ্রুত বিছানা ত্যাগ করে শব্দের উৎস খুঁজতে দুধকুমারের কিনারে গিয়ে দেখেন দুদিকে চোখ যত দূরে যায় ততদূরে শুধু মানুষ আর মানুষ। আলোয় আলোকিত নদের তীর। এগিয়ে গিয়ে দেখতে পান লোকজন যেমনভাবে পারছে তেমনভাবেই লাফিয়ে পড়ছে নদীতে। সাঁতরিয়ে ধরে আনছে আস্ত এক একটি গাছ। যে গাছগুলো আমরা চিনি না। এ এলাকায় দেখিনি কখনো। সকাল হতে হতেই নদের দুপাশে গাছের স্তূপ জমে যায়।
স্থানীয়রা জানান, ভেসে আসা এসব গাছের গুঁড়ির জ্বালানি হিসেবে বাজারমূল্য কয়েক কোটি টাকা।
রায়গঞ্জ ইউনিয়নের দামাল গ্রামের বাসিন্দা আব্দুল মোতালেব বলেন, চারজন মিলে ৫০ ফিটের এই লাল গাছটা উঠাইছি। আরও ৬ জন সাহায্য করেছে। এটা রক্ত চন্দনের গাছ, ১ লাখ ২০ হাজার হলে বিক্রি করব।
কালজানি নদীর পাড়ের বাসিন্দা আমজাদ হোসেন বলেন, আমার খড়ি গোলা রয়েছে। একেকটা গাছের গুঁড়ি ১২ হাজার টাকায় কিনলাম। এগুলো কেটে জ্বালানি হিসেবে বিক্রি করব।
কুড়িগ্রাম সরকারি কলেজের অধ্যক্ষ ও উদ্ভিদবিদ মীর্জা নাসির উদ্দিন বলেন, সার কাঠে প্রচুর ট্যানিন এবং ফেনলিক যৌগ থাকে। যখন কাঠ পানিতে ভেজে, তখন এই যৌগগুলো পানিতে দ্রবীভূত হয়ে বের হয়। ট্যানিন অক্সিজেনের সংস্পর্শে এসে অক্সিডেশন ঘটায় এবং লালচে-বাদামি রঙ তৈরি করে। প্রকৃত পক্ষে এগুলো চন্দন কাঠ নয়।
জেলা বন বিভাগের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. সাদিকুর রহমান বলেন, আমরা সরেজমিন এসব গাছের গুঁড়ি দেখেছি। দীর্ঘদিন এসব পানিতে থাকায় লাল বর্ণ ধারণ করেছে। প্রকৃতপক্ষে শ্বেত বা রক্ত চন্দনের কোনো বিষয় নেই। লোকজন না বুঝেই এসব কিনছেন এবং বিক্রি করছেন।
নাগেশ্বরী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) সিব্বির আহমেদ জানিয়েছেন, উজান থেকে পাহাড়ি ঢলের সঙ্গে অনেক কাঠের গুঁড়ি ভেসে আসছে। এই কাঠ ধরতে গিয়ে স্থানীয়রা বিপদের সম্মুখীন হচ্ছে। বিশেষ করে কাঠের সঙ্গে সাপের উপস্থিতি লক্ষ্য করা গেছে। তাই তিনি সকলকে সতর্ক থাকার আহ্বান জানিয়েছেন।
মন্তব্য করুন