আট বছর আগের কথা। ভোর সাড়ে ৬টায় শ্রীমঙ্গলের গ্রিনভিউ রেস্ট হাউস থেকে বের হলাম। শ্রীমঙ্গলে আমার পাখি-বন্যপ্রাণী-প্রজাপতি খুঁজতে যাওয়ার একসময়ের সাথি সিএনজিচালিত অটোরিকশাচালক আব্দুর রউফ হোটেলের কাছেই অপেক্ষা করছিল। তার অটোরিকশায় চড়ে মৌলভীবাজারের বিখ্যাত লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানের উদ্দেশে বেরিয়ে পড়লাম। শহর পেরিয়ে একসময় বাংলাদেশ চা গবেষণা প্রতিষ্ঠানের পাশে ফিনলে চা বাগানের মাঝখান দিয়ে চলে যাওয়া রাস্তায় এসে পড়লাম। খানিক পরে গ্র্যান্ড সুলতান হোটেল পেরিয়ে আঁকাবাঁকা ও খানিকটা বন্ধুর রাস্তায় চলতে লাগলাম। রাস্তার দুপাশে ঘন বন। মাথার উপরে বড় বড় গাছের ডালপালার আচ্ছাদন। সেই ডালপালার ফাঁক গলে কয়েক ছটা সূর্যের আলো মাঝেমধ্যেই উঁকি দিচ্ছে। হঠাৎই একটি বনমোরগ দৌড়ে রাস্তা পার হলো। কিন্তু ক্যামেরা ব্যাগে বন্দি থাকায় ওর ছবি তোলা গেল না। আশপাশে ছোট ছোট পাখির ডাক শোনা যাচ্ছে। যদিও লাউয়াছড়া বনটি শ্রীমঙ্গলের বেশ কাছে। কিন্তু এর বেশিরভাগ অংশই পড়েছে কমলগঞ্জ উপজেলায়, আর অল্পকিছু অংশ শ্রীমঙ্গলে।
রউফের অটোরিকশা যখন লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানের ফটকের সামনে এসে থামল, তখন না টিকিট কাউন্টার, না উদ্যানের সদর দরজা—কোনোটাই খোলেনি। কাজেই সোজা রাস্তায় না গিয়ে দরজার ডান পাশ দিয়ে ছড়ায় নেমে গেলাম। সকালের আলো মাত্র ফুটতে শুরু করেছে। তবে ছড়ার এই অংশে আলো আছে বেশ। বেশকটি প্রজাতির প্রজাপতিকে নরম বালুর ওপর বসে থাকতে দেখলাম। ভেজা বালুর রস চুষে তা থেকে বেঁচে থাকার জন্য প্রয়োজনীয় পুষ্টি উপাদান সংগ্রহ করে নিচ্ছে। ওদের কিছু ছবি তুলে আলো-আঁধারি ছড়া ধরে ভেতরের দিকে হাঁটতে শুরু করলাম। মাঝেমধ্যেই নানা প্রজাতির প্রজাপতির দেখা পাচ্ছি। আর থেমে থেমে ওদের ছবি তুলছি। প্রায় আধা কিলোমিটারের মতো পথ পাড়ি দেওয়ার পর বিশাল এক বাঁশবনের ভেতরে এসে পড়লাম। ছড়ার এই অংশে পানি আছে বেশ। কাজেই প্যান্ট ভালোভাবেই ভিজে গেল।
আরেকটু সামনে এগোনোর পর পানি একেবারেই কমে গেল, শুধু পায়ের পাতা ভিজছে। হঠাৎই ছড়ার টলটলে কাকচক্ষু পানির পাশে ভেজা বালুতে একজোড়া মাঝারি আকারের পুরোপুরি হলুদ রঙের প্রজাপতি বসে থাকতে দেখলাম। প্রজাপতি দুটি অত্যন্ত পরিচ্ছন্ন, ডানায় একফোঁটা দাগও নেই। শুদ্ধ হলুদের মধ্যে একই রঙের শিরাগুলো চমৎকারভাবে ফুটে উঠেছে। ঝটপট কটা ছবি তুললাম। সর্বশেষ প্রজাপতিটি দেখলাম ৫ নভেম্বর ২০২২-এ একই স্থানে। ওকে প্রথম দেখেছিলাম ২০১৩ সালে হবিগঞ্জের সাতছড়ি জাতীয় উদ্যানে। তবে লাউয়াছড়ার এই টলটলে পানির পাশে ওদের যতটা সুন্দর লাগছিল, অন্য কোথাও ততটা লাগেনি।
এতক্ষণ যে হলুদ প্রজাপতিটির গল্প করলাম, সে আর কেউ নয়—এ দেশের দুর্লভ ও বিপন্ন প্রজাতির এক প্রজাপতি শুদ্ধ হরিদ্রা। পশ্চিমবঙ্গে ওর নাম তালপাখা। ইংরেজি নাম ট্রি ইয়েলো। সাদা ও হলুদ প্রজাপতির গোত্র পিয়েরিডি (Pieridae) এই সদস্যের বৈজ্ঞানিক নাম Gandacha harina (গান্ডাচা হারিনা)। মূলত চিরসবুজ ও পাতাঝরা বনে বাসকারী পতঙ্গটিকে দেশের বাইরে আফ্রিকা, অস্ট্রেলিয়া ও দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন দেশেও দেখা যায়।
আগেই বলেছি, এটি মাঝারি আকারের প্রজাপতি। প্রসারিত অবস্থায় ডানার বিস্তার ৩৫ থেকে ৪৫ মিলিমিটার। ডানার উপরাংশ ফ্যাকাশে লেবু-হলুদ ও সামনের ডানার শীর্ষদেশে সরু কালো পাড় দেখা যায়। স্ত্রীর ক্ষেত্রে এই কালো পাড়টি চতুর্থ শিরার কাছে একটি খাঁজকাটা প্রক্ষেপণের সৃষ্টি করেছে। সামনের ও পেছনের উভয় ডানার নিচটা কোনো দাগছোপ ছাড়া ফ্যাকাশে লেবু-হলুদ। স্ত্রী দেখতে পুরুষের থেকে কিছুটা ফ্যাকাশে হয়।
চিরসবুজ ও পাতাঝরা বন ছাড়াও গাছপালাসম্পন্ন এলাকায় দেখা যায়। স্বভাবে গোধূম (Grass Yello) প্রজাপতিদের মতো হলেও ছায়াময় স্থানে ওড়াউড়ি করতে পছন্দ করে। পুরুষগুলোকে ফুলে ফুলে উড়ে বেড়াতে ও ভেজা মাটিতে বসে থাকতে দেখা যায়।
বাংলাদেশে এদের পোষক গাছ অর্থাৎ যে গাছে এরা ডিম পাড়ে এবং যে গাছের পাতা খেয়ে শূককীট বড় হয়, সেই গাছ সম্পর্কে এ দেশে তথ্যের অপ্রতুলতা রয়েছে। তবে বিশ্বের অন্যত্র মালাক্কা ভ্যান্টিলাগো (ভ্যান্টিলাগো মালাক্কেনসিস) এবং এজাতীয় অন্য এক প্রজাতির ভ্যান্টিলাগো গাছের কুঁড়ির ওপর স্ত্রী প্রজাপতি একটি করে টাকু আকারের সাদাটে ডিম পাড়ে, যাতে অস্পষ্ট লম্বালম্বি খাঁজ থাকে। জীবনচক্র সম্পন্ন করতে ১৮ থেকে ২২ দিন সময় লাগে। প্রাপ্তবয়ষ্ক প্রজাপতি সচরাচর ৭ থেকে ১০ দিনের বেশি বাঁচে না।
লেখক: পাখি, বন্যপ্রাণী প্রজনন ও চিকিৎসা বিশেষজ্ঞ এবং অধ্যাপক, বশেমুরকৃবি, গাজীপুর