রাজন ভট্টাচার্য
প্রকাশ : ০১ মে ২০২৪, ০৩:৫০ এএম
আপডেট : ০১ মে ২০২৪, ০৯:৩০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

রেললাইন নিরাপদ রাখার ‘টোটকা’ পদ্ধতি

৭০ ভাগ লাইনের মেয়াদ নেই
রেললাইন নিরাপদ রাখার ‘টোটকা’ পদ্ধতি

তীব্র তাপপ্রবাহে লাইনের সুরক্ষায় ‘টোটকা’ পদ্ধতি চালু করেছে রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ। লাইন বেঁকে যাওয়া ঠেকাতে দেওয়া হচ্ছে কচুরিপানা, ঢালা হচ্ছে পানি। ঝুঁকি মোকাবিলায় কমানো হয়েছে ট্রেনের গতি। অথচ দেশের ৭০ ভাগ রেললাইন মেয়াদোত্তীর্ণ। লাইনের স্লিপার, ক্লিপ, পাথর রক্ষণাবেক্ষণ নিয়েও আছে বিস্তর প্রশ্ন। এ নিয়ে কারও যেন ভাবনা নেই।

রেলওয়ের পাতের স্বাভাবিক তাপমাত্রা গ্রহণের সক্ষমতা ৫০ ডিগ্রি সেলসিয়াস। সাধারণত অনুভূত তাপমাত্রার ১০ ডিগ্রির বেশি থাকে রেললাইনে। বর্তমানে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা প্রায় ৪৩ ডিগ্রি। যে এলাকায় তাপমাত্রা বেশি, সেখানে লাইন বাঁকা হওয়ার সম্ভাবনাও বেশি থাকে। বিশেষ করে স্বাভাবিক তাপমাত্রার চেয়ে সূর্যের টানা তাপ পেলে রেলের পাতের ওপর ট্রেনের ঘর্ষণে পাত বেঁকে যাওয়ার সর্বোচ্চ ঝুঁকি তৈরি হয়। বেশি তাপমাত্রায় প্রায়ই রেললাইন বেঁকে যাওয়ার ঘটনা ঘটছে। গতকাল মঙ্গলবার গাজীপুরের আড়িখোলা রেলওয়ে স্টেশন এলাকায় তীব্র তাপপ্রবাহে রেললাইন বেঁকে গেছে। এতে সিলেট থেকে ছেড়ে আসা ঢাকাগামী কালনী এক্সপ্রেস অল্পের জন্য রক্ষা পায়। রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ বিষয়টি টের পেয়ে দ্রুত লাইন মেরামত কাজ শুরু করে। লাইনের ওপর কচুরিপানা দিয়ে পানি ঢালা হয়।

এর আগে গত শুক্রবার পাবনার ঈশ্বরদীতে বাইপাস রেলওয়ে স্টেশনে রেললাইনের পাত বেঁকে গিয়ে একটুর জন্য বড় দুর্ঘটনা থেকে রক্ষা পায় খুলনা থেকে রাজশাহীগামী আন্তঃনগর ট্রেন কপোতাক্ষ এক্সপ্রেস। পরে দুই ঘণ্টা ধরে রেললাইনের ওপর পানি ঢেলে বেঁকে যাওয়া পাত স্বাভাবিক করা হয়। সেদিন ওই অঞ্চলের তাপমাত্রা ছিল ৪২ দশমিক ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস।

চলতি বছরের ৪ মার্চ ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়া উপজেলার আজমপুর স্টেশনের কাছে অন্তত ১৫ ফুট রেললাইন বেঁকে যায়। যদিও তখন তাপপ্রবাহ ছিল না। এ ছাড়া গত বছরও এই সময়ে ঢাকা-চট্টগ্রাম রেললাইনে পরপর দুদিন পাত বেঁকে যাওয়ার ঘটনা ঘটেছিল।

রেলওয়ে কর্মকর্তারা বলছেন, পুরোনো ও মেয়াদোত্তীর্ণ লাইন হওয়ায় বেঁকে যাচ্ছে রেলের পাত।

অনেক রেললাইনের স্লিপারে নাট-বল্টু নেই, কোথাও ক্লিপ নেই। ক্লিপের পরিবর্তে সুতা পেঁচিয়ে রাখা হয়েছে, যাতে নাট খুলে না পড়ে। কিছু জায়গায় চুরি হয়ে গেছে ফিশপ্লেট। অন্যদিকে কাঠের তৈরি পুরোনো লাইনগুলোতে পচে গেছে স্লিপার। ফলে পুরো রেললাইন হয়ে গেছে নড়বড়ে।

রেললাইনে এ ধরনের নানা সমস্যা সারা দেশেই আছে। বছরের অন্য সময় জোড়াতালি দিয়ে রেললাইনগুলো চালানো গেলেও এপ্রিল থেকে জুন মাসে দেখা দেয় বিপত্তি। এ সময় তীব্র তাপপ্রবাহে রেললাইন বেঁকে গিয়ে ঘটে দুর্ঘটনা। তখন পরিস্থিতি মোকাবিলায় নানা রকম ‘টোটকা দাওয়াই’ চালু করে কর্তৃপক্ষ। যদিও জনবল সংকটের কারণে এই ‘টোটকা’ পদ্ধতিতেও সারা দেশের রেলপথ নিরাপদ করা সম্ভব হচ্ছে না।

জানতে চাইলে বাংলাদেশ রেলওয়ের মহাপরিচালক সরদার সাহাদাত আলী কালবেলাকে বলেন, ‘রেললাইন বেঁকে যাওয়ার ক্ষেত্রে নতুন ও পুরোনো লাইনের মধ্য একটা পার্থক্য থাকে। নতুন-পুরোনো লাইনের কথা মাথায় রেখেই নিরাপত্তা বিবেচনায় গতি কমানোর নির্দেশনা দেওয়া হয়।’ রেললাইন নতুন হলে ঝুঁকি কম থাকে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘লাইন পুরোনো হলে গতি যা থাকে তার থেকে অর্ধেক করে দেওয়া হয়।’

রেল সূত্র জানিয়েছে, সারা দেশে এখন রেলপথ আছে ৩ হাজার ৯৩ কিলোমিটার। আর রেললাইন আছে ৪ হাজার ৪৩৮ কিলোমিটার। রেল মন্ত্রণালয়ের ২০২২-২৩ বার্ষিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত ১৫ বছরে নতুন করে ৮৪৩ কিলোমিটার রেলপথ নির্মাণ করা হয়েছে। সে হিসাবে সাড়ে ৩ হাজার কিলোমিটারের বেশি রেলপথ পুরোনো। পুরোনো রেলপথের বড় অংশের রেললাইন ব্রিটিশ আমলে তৈরি।

বর্তমানে দেশের রেলপথ দুই অঞ্চলে বিভক্ত। একটি পূর্বাঞ্চল। অন্যটি পশ্চিমাঞ্চল। দুই অঞ্চল মিলে ১ হাজার কিলোমিটার রেললাইন অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ বলে জানা গেছে। কিছু কিছু রেললাইন আছে, যেগুলো ৩০ বছরেও সংস্কার হয়নি। বেশির ভাগ লাইনের অর্থনৈতিক আয়ুষ্কাল শেষ হয়ে গেছে, কোনোটির শেষ হওয়ার পথে।

পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়ের প্রধান প্রকৌশলী আসাদুল হক বলেন, একটি রেললাইনের আয়ুষ্কাল ধরা হয় ২০ থেকে ২৫ বছর। ১৯৭৩ সালে রাজশাহী থেকে আব্দুলপুর পর্যন্ত রেললাইন স্থাপন করা হয়; কিন্তু এই স্লিপার ও রেললাইনের বয়স ৫০ পেরিয়ে গেছে।

রেলওয়ের পূর্বাঞ্চল ও পশ্চিমাঞ্চলের বিভিন্ন জেলায় খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বেশির ভাগ লাইনে বড় ধরনের সমস্যা রয়েছে। লাইনে পর্যাপ্ত পাথর না থাকা, স্লিপারের নিচ থেকে মাটি সরে যাওয়া, ফিশপ্লেট ও নাট-বল্টু না থাকাসহ নানা সমস্যায় জর্জরিত দেশের রেললাইনগুলো।

যেসব এলাকায় সমস্যা বেশি

পূর্বাঞ্চল রেলওয়ের অধীনে আছে ঢাকা-চট্টগ্রাম, ঢাকা-কক্সবাজার, ঢাকা-নোয়াখালী, ঢাকা-সিলেট ও ময়মনসিংহ-চট্টগ্রাম রেলপথ, যার পরিমাণ ১ হাজার ৩৩৩ কিলোমিটার। এ অঞ্চলে রেললাইন আছে ২ হাজার ১৫১ কিলোমিটার।

রেলের ২০২৩ সালের সমীক্ষা মতে, পূর্বাঞ্চলের ১৬ জেলায় লাইনের সমস্যা বেশি। চট্টগ্রাম, ফেনী, কুমিল্লা, চাঁদপুর, নোয়াখালী, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, কিশোরগঞ্জ, নরসিংদী, গাজীপুর, সিলেট, মৌলভীবাজার, সুনামগঞ্জ, হবিগঞ্জ, ময়মনসিংহ, জামালপুর ও ঢাকায় রেলপথে এসব সমস্যা রয়েছে।

অন্যদিকে রেলের পশ্চিমাঞ্চলে জেলা বিবেচনায় রাজশাহী, ঢাকা, রংপুর ও খুলনা বিভাগের ২৩ জেলায় সমস্যা বেশি রয়েছে। এর মধ্যে শুধু ঢাকা-চিলাহাটি-পঞ্চগড় ও রাজবাড়ী-ঢাকা রুটের রেললাইনে কংক্রিট স্লিপার আছে।

দেশের ৭০ শতাংশ রেললাইন মেয়াদোত্তীর্ণ মন্তব্য করে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অধ্যাপক ও যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ ড. মো. হাদিউজ্জামান কালবেলাকে বলেন, বর্তমানে আড়াই হাজার কিলোমিটার রেলপথ মেয়াদ পেরিয়ে যাওয়ায় ঝুঁকিপূর্ণ। তদারকি না থাকা ও অবহেলায় রেললাইনে ট্রেন লাইনচ্যুত হওয়ার ঘটনা বাড়ছে বলেও মত এ পরিবহন বিশেষজ্ঞের। তিনি বলেন, তাপ বাড়লে লাইন সম্প্রসারিত হয়। পাতের গ্যাপ প্রয়োজনীয় রক্ষণাবেক্ষণ না হলে বা পাথর না থাকলে লাইন বেঁকে যেতে পারে।

রেললাইন রক্ষণাবেক্ষণে রেলওয়ের আধুনিক কোনো প্রযুক্তি না থাকার কথা জানিয়ে মো. হাদিউজ্জামান বলেন, গরম মৌসুমে রেললাইন ঠিক রাখতে লাইনের স্বাস্থ্য মিনিটরিংয়ে সর্বাধিক গুরুত্ব দিতে হবে। তারপর সেন্সর দিয়ে লাইন মনিটর করতে হবে। লাইনের ওপর সাদা পেইন্ট করলে ১০ ডিগ্রি তাপ কমবে। তাপপ্রবাহ মাত্রা ছাড়ালে প্রয়োজনে ট্রেন চলাচল বন্ধেরও পরামর্শ দেন তিনি।

দ্রুত মেয়াদোত্তীর্ণ লাইন পরিবর্তন ও সংস্কারের পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, লাইনের আয়ুষ্কাল সাধারণত ৩০ থেকে ৪০ বছর। প্রতি বছর নির্দিষ্ট সময়ে লাইনের ক্লিপ-ডি-স্ট্রেসিং না করায় সমস্যা আরও বাড়ছে।

এর আগে চলতি মাসের মাঝামাঝি তীব্র গরমে রেললাইন বেঁকে যাওয়ার শঙ্কায় গতি কমিয়ে সারা দেশে ট্রেন পরিচালনার নির্দেশ দেয় রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ। জানানো হয়, এলাকাভেদে বিভিন্ন গতিতে চলবে ট্রেন। রেলওয়ের পশ্চিমাঞ্চলের মহাব্যবস্থাপক অসীম কুমার তালুকদার কালবেলাকে বলেন, গরমে ট্রেনের গতি কমাতে একটা স্ট্যান্ডিং অর্ডার আছে। তবে স্থান-কাল-পাত্রের ওপর নির্ভর করে এই নির্দেশনা কার্যকর হয়।

বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মো. মোজাম্মেল হক চৌধুরী কালবেলাকে বলেন, বর্তমান সরকার রেলকে বিকশিত করার লক্ষ্যে গত ১৪ বছরে ৯৪ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছে। তারপরেও ৬০ শতাংশ রেলপথ ঝুঁকিপূর্ণ।

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

সৌদি পৌঁছেছেন ২৪ হাজারের বেশি হজযাত্রী

গণতন্ত্র-উন্নয়নে শেখ হাসিনা বিশ্বে রোল মডেল : রাষ্ট্রপতি

ঢাকার যেসব এলাকায় শনিবার গ্যাস কম থাকবে

৬ তারিখে বাজেট দেব, বাস্তবায়নও করব : প্রধানমন্ত্রী

দেবরের হাতে ভাবি খুন

বীজতলা ফেটে চৌচির, কৃষকদের কপালে চিন্তার ভাঁজ

যারা একবেলা খেতে পারত না, তারা চারবেলা খায় : প্রধানমন্ত্রী

আ.লীগ সরকার টেলিযোগাযোগ খাতকে আধুনিক ও যুগোপযোগী করেছে : প্রধানমন্ত্রী

ডিএমপির মাদকবিরোধী অভিযানে গ্রেপ্তার ৩৪

প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীকে মারধর, থানায় অভিযোগ

১০

জমির বিরোধের জেরে মসজিদে তালা দিয়ে অগ্নিসংযোগ, নিহত ১১

১১

সবজির বাজারে উত্তাপ, চড়া দাম

১২

ইতালিতে বাড়ছে বাংলাদেশি উদ্যোক্তা

১৩

ফের পেছাল কঙ্গনার ‘ইমার্জেন্সি’

১৪

৫২৩ হজযাত্রীর টাকা নিয়ে ২ এজেন্সি মালিক উধাও 

১৫

কুমিল্লায় বাণিজ্যিকভাবে আনারস চাষে সফলতা

১৬

অসহায় ও পথশিশুদের মুখে হাসি ফুটাল চবির তরুণ দুই উদ্যোক্তা

১৭

ইউরো চ্যাম্পিয়নশিপ / ২ বছর পর ফ্রান্স দলে কান্তে

১৮

তীব্র গরমে ঢাকার বাতাসের কী খবর?

১৯

বর্ষা গেল, বর্ষা এল তবু ব্রিজ হলো না

২০
X