রাজধানীর মিরপুরে অবস্থিত জাতীয় চিড়িয়াখানায় তিন সহস্রাধিক প্রাণীর বসবাস। প্রতিদিন হাজারো দর্শনার্থী ভিড় জমান এখানে। খাঁচায় বন্দি প্রাণীদের খুব কাছ থেকে দেখতে নানা কাণ্ড ঘটান অসচেতন দর্শনার্থীরা। নিরাপত্তা বেষ্টনী পার হয়ে মূল খাঁচার কাছে চলে যাওয়া যেন স্বাভাবিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। সতর্কতার পরও হিংস্র প্রাণীগুলোকে উত্ত্যক্ত করাও থেমে নেই। অন্যদিকে জনবল সংকটে দর্শনার্থীদের পর্যাপ্ত নিরাপত্তা দিতে হিমশিম অবস্থার কথা বলছে চিড়িয়াখানা কর্তৃপক্ষ। তাদের বক্তব্য, মাস্টারপ্ল্যান প্রকল্প পাস না হওয়ায় আটকে আছে নানামুখী উন্নয়ন কাজও।
আধুনিকতায় পিছিয়ে থাকলেও আয়তনে বিশ্বের চতুর্থ জাতীয় চিড়িয়াখানা। ১৮৬ একর জায়গায় অবস্থিত বিনোদনকেন্দ্রটিতে হিংস্র পশুদের খাঁচাগুলো যথেষ্ট নিরাপদ নয়। বিশাল এই চিড়িয়াখানা দেখভালের জন্য প্রয়োজনীয় জনবলের সংখ্যা ২৩৭ জনের থাকার কথা থাকলেও আছে মাত্র ১৩২ জন। যেখানে খাঁচার সংখ্যা ১৩৭ ও প্রাণী রাখার স্থাপনার সংখ্যা ২৩৭টি। সবমিলিয়ে এসব দেখাশোনা করেন মাত্র ৭২ জন।
গত বৃহস্পতিবার এক শিশু হায়েনার আক্রমণের শিকার হওয়ার পর আলোচনায় আসে চিড়িয়াখানার নিরাপত্তা ব্যবস্থা। ওই ঘটনার পর অবশ্য জোরদার করা হয়েছে নিরাপত্তা ব্যবস্থা। এর আগে বাঘের হামলায় শিশু ও ভালুকের হামলায় চিড়িয়াখানা কর্মীর মৃত্যুর ঘটনাও ঘটেছে এই চিড়িয়াখানায়।
গতকাল শনিবার সরেজমিন হায়েনার সেই খাঁচার সামনে দেখা গেল উৎসুক মানুষের ভিড়। বেশিরভাগ দর্শনার্থীই সেলফি তোলা ও ভিডিও করতে ব্যস্ত। নিরাপত্তা বেষ্টনীর নেট ধরে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায় তাদের সঙ্গে আসা শিশুদের। হায়েনার খাঁচার সামনে দুই ফুট দূরত্বে রয়েছে দেড় ফুট উচ্চতার নিরাপত্তা বেষ্টনী। নতুন করে খাঁচার সামনে ছয় ফুট উচ্চতার লোহার বেষ্টনী দেওয়া হয়েছে। গত শুক্রবার দিনভর চলে এ কাজ। পুরো চিড়িয়াখানা ঘুরে হাতেগোনা কয়েকজন নিরাপত্তা প্রহরীকে দেখা গেল। অভিযোগ রয়েছে, চিড়িয়াখানার নিরাপত্তাকর্মীরার সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করেন না।
দর্শনার্থী আরিফুল ইসলাম বলেন, নিরাপত্তায় যথেষ্ট ঘাটতি রয়েছে। দর্শনার্থীদের সচেতনতাও খুব কম। নিরাপত্তা বেষ্টনী থেকে দূরে থাকলে দুর্ঘটনার শঙ্কা কম।
নাজমা বেগম বলেন, চিড়িয়াখানায় বেড়াতে এসে বাচ্চাদের যেখানে সেখানে ছেড়ে দেওয়া ঠিক হবে না। সবসময় বাচ্চাদের খেয়াল রাখতে হবে। অনেকেই হিংস্র প্রাণীদের উত্ত্যক্ত করেন। এগুলো বন্ধ করতে হবে।
চিড়িয়াখানার এক নিরাপত্তাকর্মী কালবেলাকে বলেন, প্রায়ই লাফিয়ে খাঁচা টপকানোর চেষ্টা করে বাঘ। চার-পাঁচ দিন আগেও প্রচণ্ড গরমের মধ্যে এমন ঘটনা ঘটে। প্রত্যেক খাঁচার সামনে নেট রয়েছে। নেটে কেউ হাত দিতে পারবে না। বাইরে থেকে দেখা লাগবে।
নিয়ম অনুয়ায়ী, শিয়াল ও হায়েনার পাঁচটি খাঁচার জন্য তিনজন অ্যানিম্যাল কিউরেটর বা বিশেষ কর্মী থাকবেন। গত বৃহস্পতিবার ওই শিশুটির ওপর আক্রমণের সময় ওই তিন কর্মীর মধ্যে একজন পাশের খাঁচায় খাবার দিচ্ছিলেন। বাকি কে কোথায় ছিলেন, সে বিষয়ে স্পষ্ট তথ্য নেই কর্তৃপক্ষের কাছে।
চিড়িয়াখানার পরিচালক ডা. মোহাম্মদ রফিকুল ইসলাম তালুকদার বলেন, চিড়িয়াখানার তদন্ত কমিটি কাজ করছে। শিশুর আহত হওয়ার ঘটনাসহ নিরাপত্তার ফাঁকফোকর পর্যালোচনা করে তারা প্রতিবেদন দেবে। কর্মচারীদের গাফিলিত থাকলে সরকারি কর্মচারী চাকরি আইন-২০১৮-এর ধারা অনুযায়ী শাস্তির বিধান রয়েছে।
তিনি বলেন, ওই দিন কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে ঘটনাটি ঘটেছে। দুর্ঘটনার সময় দরজা খোলা ছিল কি না, কে খুলে রেখেছিল—এগুলো তদন্তে বেরিয়ে আসবে। নিরাপত্তা বেষ্টনীর কোনো দুর্বলতা আছে কি না, অর্থাৎ ফিজিক্যাল ব্যারিয়ারগুলো আরও শক্তিশালী করা প্রয়োজন। নিরাপত্তা প্ল্যানিং আরেও রিভিউ করতে হবে। আমরা অবকাঠামোগত নিরাপত্তা জোরদার করতে চাইছি। প্রত্যেক খাঁচায় দর্শনার্থীদের যদি গাইডের মাধ্যমে ভিজিট করাতে পারি সে ক্ষেত্রে নিরাপত্তা আরও নিশ্চিত হবে।
চিড়িয়াখানার আধুনিকায়নে নেওয়া মাস্টারপ্ল্যান এখনো অনুমোদনের অপেক্ষায়। ২ হাজার কোটি টাকার প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হলে নিরাপত্তা ও দর্শনার্থীদের সেবা—দুটিই বাড়বে বৃহৎ এই পর্যটন স্পটে। এ বিষয়ে চিড়িয়াখানার পরিচালক বলেন, কোথায় কোন স্থাপনা হবে এবং কোন স্থাপনা কী রকম হবে, মাস্টারপ্ল্যানে তা এসেছে। এই প্ল্যান বাস্তবায়ন করতে আর্থিক সংস্থানের জন্য একটি প্রকল্প সাবমিট করা হয়েছে। প্রকল্প প্রস্তাবটি কয়েকবার রিভিশন হয়েছে। এখন অনুমোদনের জন্য অপেক্ষায় আছে।
আহত শিশুর প্রসঙ্গে রফিকুল ইসলাম বলেন, শিশুটি সুস্থ। খাওয়া-দাওয়া করছে, খেলা করছে। এখন আর পেইন অনুভব করছে না।
মন্তব্য করুন