হাসান ওরিদ
প্রকাশ : ২৪ জানুয়ারি ২০২৫, ০৩:৩৭ এএম
আপডেট : ২৪ জানুয়ারি ২০২৫, ০৮:১২ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

গাজায় ৪৭০ দিনের যুদ্ধ বিশ্বকে যেভাবে বদলে দিয়েছে

গাজায় ৪৭০ দিনের যুদ্ধ বিশ্বকে যেভাবে বদলে দিয়েছে

গাজায় যুদ্ধবিরতি ঘোষণা হওয়ার আগেই বিশ্বে একটি অদৃশ্য রূপান্তর শুরু হয়ে যায় এবং এই যুদ্ধবিরতি নতুন এক বিশ্বব্যবস্থার রূপরেখা নির্ধারণের ঘোষণা দেয়, যেখানে যুক্তরাষ্ট্র মধ্যপ্রাচ্যে মূল প্রভাবশালী শক্তি হিসেবে টিকে থাকবে। যারা এ অঞ্চলে তাদের কর্তৃত্ব চ্যালেঞ্জ করার চেষ্টা করেছিলÑরাশিয়া, চীন এবং ইউরোপীয় ইউনিয়ন—তাদের প্রভাব হ্রাস পেয়েছে এবং উজ্জ্বলতা ম্লান হয়ে গেছে। মধ্যপ্রাচ্যে কোনো ঘটনাই ভবিষ্যতে যুক্তরাষ্ট্রের বাইরে, তাদের দিকনির্দেশনার বিরুদ্ধে বা তাদের স্বার্থের সঙ্গে বিরোধী অবস্থানে ঘটতে পারবে না।

এটি বলা যেতে পারে যে এটি যুক্তরাষ্ট্রের তৃতীয় যুগ। প্রথম যুগ শুরু হয়েছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর, যা ‘আমেরিকান শান্তি’ (Pax Americana) নামে পরিচিত। এটি ১৯৪৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে ‘কুইন্সি’ নামক জাহাজের ডেকে গঠিত এক চুক্তির মাধ্যমে শুরু হয়েছিল। দ্বিতীয় যুগ শুরু হয়েছিল উপসাগরীয় যুদ্ধের পর যখন যুক্তরাষ্ট্র ‘নতুন বিশ্বব্যবস্থা, গণতন্ত্র এবং মানবাধিকারের স্লোগান তুলেছিল। কিন্তু ১১ সেপ্টেম্বরের ঘটনার ফলে সেই দৃষ্টিভঙ্গি বদলে যায় এবং যুক্তরাষ্ট্র ‘সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধ’ পরিচালনার জন্য সক্রিয়ভাবে মধ্যপ্রাচ্যে জড়িয়ে পড়ে।

তৃতীয় যুগ শুরু হয়েছে গাজার যুদ্ধ বন্ধের ঘোষণার পর। এটি যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যপ্রাচ্য নীতির সঙ্গে বিচ্ছিন্ন নয়, যার মধ্যে রয়েছে ইসরায়েলের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, আব্রাহাম চুক্তির কাঠামোকে সক্রিয় রাখা এবং অঞ্চলের মিত্র আরব দেশগুলোর সঙ্গে সহযোগিতা বৃদ্ধি।

এ পরিবর্তন শুধু মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা নয়, বরং পুরো বিশ্বেও তাদের অবস্থানকে আরও মজবুত করেছে। সামরিক এবং কৌশলগতভাবে যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বশক্তির কেন্দ্রবিন্দু হয়ে থাকবে। ট্রাম্প প্রশাসনের দ্বিতীয় মেয়াদে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে একটি কৌশলগত পরিবর্তন দেখা যাবে, যার একটি বড় অংশ গাজার যুদ্ধের ফলাফলের ওপর ভিত্তি করে। গাজার যুদ্ধবিরতির ফলে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের গতিপথেও পরিবর্তন আসতে পারে এবং যুদ্ধের সমাপ্তির সম্ভাবনা উন্মুক্ত হতে পারে।

রাশিয়া ও চীন উভয়ই নিজেদের আঞ্চলিক কৌশলগত সমস্যাগুলোর দিকে মনোনিবেশ করবে। রাশিয়া দনবাস অঞ্চলে এবং চীন তাইওয়ানের ক্ষেত্রে নিজেদের প্রাধান্য ধরে রাখার চেষ্টা করবে। উভয় শক্তি তাদের উচ্চাকাঙ্ক্ষা ও প্রত্যাশাগুলো হ্রাস করার জন্য পুনর্বিবেচনা করবে।

গাজার যুদ্ধের অন্যতম বড় ফল হলো মধ্যপ্রাচ্যে ইরানের ভূমিকা হ্রাস পাওয়া এবং লেবাননে তাদের মিত্রদের দুর্বল হওয়া। এটি ইরাক ও ইয়েমেনে ইরানের প্রভাবেও প্রভাব ফেলবে। গাজার যুদ্ধ মধ্যপ্রাচ্যে ইরানের যুগের সমাপ্তির ইঙ্গিত দিয়েছে। ইরান যেভাবে ইসলামী বিপ্লবের পর মধ্যপ্রাচ্যের রাজনৈতিক সংস্কৃতি, শিয়া উপাদানগুলোকে সক্রিয় করা এবং এমনকি শিয়া সম্প্রদায়হীন এলাকায়ও প্রভাব বিস্তার করেছে, তা এই যুদ্ধের ফলে ক্রমেই কমে আসছে। ইরানের ভূমিকার এই পরিবর্তন সিরিয়ার পরিস্থিতিকেও প্রভাবিত করেছে। সিরিয়া ইরানের আধিপত্য থেকে মুক্তি পেয়েছে, বিশেষত হিজবুল্লাহর প্রভাব থেকে।

গাজার যুদ্ধ এবং এর পরবর্তী প্রভাব মধ্যপ্রাচ্যে একটি নতুন আরব ব্যবস্থার জন্য মঞ্চ প্রস্তুত করেছে, যেখানে সিরিয়া একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। একজন ফরাসি গবেষক বলেছেন, সিরিয়ার পরিবর্তন পূর্ব ইউরোপের ওপর বার্লিন প্রাচীর পতনের যে প্রভাব ফেলেছিল, তার সমতুল্য হতে পারে।

সিরিয়ার ক্ষমতার পরিবর্তন আরব বিশ্বের ওপরও প্রভাব ফেলবে। এই পরিবর্তনকে আরব বসন্তের সময় তিউনিশিয়া, মিশর বা লিবিয়ার পরিবর্তনের সঙ্গে তুলনা করা যাবে না। সিরিয়ার পরিবর্তন এক অনন্য ঘটনা, যার সফলতার সম্ভাবনা ব্যর্থতার চেয়ে বেশি। এর পেছনে কয়েকটি কারণ রয়েছে—১. সিরিয়ার জনগণের অসহনীয় কষ্ট এবং ধ্বংস, যা তাদের একত্রিত হওয়ার জন্য বাধ্য করেছে; ২. প্রতিবেশী দেশগুলোর স্বার্থ, যারা সিরিয়ার অস্থিতিশীলতাকে তাদের জন্য ক্ষতিকর মনে করে; ৩. ইউরোপীয় দেশগুলো, যারা সিরিয়ার শরণার্থী সমস্যার কারণে প্রত্যক্ষভাবে প্রভাবিত হয়েছে।

সিরিয়ার ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার তাদের পুনর্গঠনে সহায়তা করবে। তবে আরব দেশগুলোর ভূমিকাই হবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। সিরিয়া ইরানি প্রভাব থেকে মুক্ত হয়ে আরব ঐক্যে ফিরে এসেছে এবং এটি একটি নতুন আরব ব্যবস্থার ভিত্তি হতে পারে।

ইরানের প্রভাব কমে যাওয়া মানেই তুরস্কের প্রভাব বাড়বে, তা নয়। আরব বসন্তের সময় তুরস্ক যেভাবে প্রভাব বিস্তার করেছিল, তা পুনরুদ্ধার করা তাদের জন্য কঠিন হবে। এর পেছনে তুরস্কের অর্থনৈতিক সংকট এবং সৌদি আরব ও মিশরের কৌশলগত ভূমিকা রয়েছে। এ ছাড়া, অঞ্চলের রাজনৈতিক সংস্কৃতি বদলে যেতে পারে। প্রতিরোধের রাজনীতি হ্রাস পেতে পারে এবং আরব বিশ্বের সংস্কৃতি ক্রমেই বৈশ্বিক কাঠামোর সঙ্গে মিশে যেতে পারে। তবে এটি শক্তিশালী সরকারগুলোর ওপর নির্ভর করবে। ফিলিস্তিনের ভবিষ্যৎ ইসরায়েল কি ফিলিস্তিনি ইস্যুকে চিরতরে সমাধান করতে পেরেছে? গাজার যুদ্ধ আবারও প্রমাণ করেছে যে, ফিলিস্তিনি ইস্যু মধ্যপ্রাচ্যের মূল সমস্যা। এটি উপেক্ষা করার যে কোনো প্রচেষ্টা পুরো অঞ্চল এবং বিশ্বের নিরাপত্তার জন্য হুমকি হয়ে থাকবে।

যুদ্ধের পর প্রাধান্য পাবে গাজার পুনর্গঠন। একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলন আয়োজনের প্রয়োজন হবে, যেখানে দুটি বিষয় নিশ্চিত করা হবে: ১. ফিলিস্তিনি জনগণের স্ব-নিয়ন্ত্রণের অধিকার; ২. গাজার পুনর্গঠন। পুনর্গঠনের সঙ্গে স্ব-নিয়ন্ত্রণের অধিকার নিশ্চিত না হলে ফিলিস্তিনিদের অধিকার হরণের ঝুঁকি থেকে যাবে।

গাজার ধ্বংসস্তূপ থেকে একটি নতুন ইসরায়েল উঠে আসবে। কিন্তু তারা কি ফিলিস্তিনিদের অধিকার অস্বীকার করে নিজেদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারবে? গাজার যুদ্ধের সময় শিশু ও নারীদের ওপর চালানো সহিংসতার জন্য ইসরায়েলের ভাবমূর্তি নষ্ট হয়েছে। যুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে এ সহিংসতার উত্তর দিতে হবে ইসরায়েলকে।

গাজার যুদ্ধ স্থানীয় হলেও এর প্রভাব বৈশ্বিক। গাজার আগের ও পরের পরিস্থিতি এক নয়। ফিলিস্তিনিদের দুঃখ-দুর্দশা এবং গাজার ধ্বংসের মধ্য দিয়ে এক নতুন বিশ্বব্যবস্থা রূপ নিচ্ছে।

আলজাজিরা আরবি থেকে অনুবাদ করেছেন হাসিবুর রহমান

কালবেলা অনলাইন এর সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিডটি অনুসরণ করুন
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

ববি ছাত্রদলের তিনটি পদে নির্বাচন শনিবার, লড়বেন ১০ প্রার্থী

মৃত্যুর ফেরেশতা কি প্রাণীদেরও রুহ কবজ করেন? জানুন

মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা করা হবে আমাদের শপথ : সালাউদ্দিন আহমদ

শ্রীলঙ্কা সফরে যাচ্ছে পাকিস্তান, সূচি ঘোষণা

ঢাকায় স্থগিত পাকিস্তানি ব্যান্ডের কনসার্ট

খালেদা জিয়ার সুস্থতা কামনায় সারা দেশে বিশেষ দোয়া

বিপিএল ২০২৬: কোন দলের অধিনায়ক কে, যা জানা গেল

বেলজিয়াম / যুদ্ধাপরাধীদের বিরুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ গোপন তথ্য ফাঁস

শেখ হাসিনাকে ফিরিয়ে দিতে ভারতের অগ্রগতির কথা জানালেন পররাষ্ট্র উপদেষ্টা

মানবিক সংকটে স্বেচ্ছাসেবকদের ভূমিকাই জাতিকে এগিয়ে নিয়ে যায় : স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা

১০

গাজীপুর মহানগর পুলিশে বড় রদবদল

১১

নারী ইউরো চ্যাম্পিয়নশিপের আয়োজক জার্মানি

১২

শনিবার বিদ্যুৎ থাকবে না যেসব এলাকায়

১৩

বিলাসবহুল বাংলোতে রণবীর-আলিয়ার সুখের সংসার

১৪

খুবির ভর্তি পরীক্ষা শুরু ১৮ ডিসেম্বর, আসনপ্রতি লড়বেন ৯৭ জন

১৫

বাসের সঙ্গে সংঘর্ষে অটোরিকশার ৪ যাত্রী নিহত

১৬

এয়ার অ্যাম্বুলেন্স কী, খরচ কেমন হতে পারে?

১৭

ফুটবল বিশ্বকাপের ড্র : জেনে নিন কোন পটে কারা

১৮

শাজাহান খানের মেয়ে ঐশীর নামে দুদকের মামলা

১৯

জাবিতে চার আবাসিক হলের নাম পরিবর্তন

২০
X