১৯৪২ সালের আগস্ট মাস, যখন বিশ্বযুদ্ধের অগ্নিশিখা পৃথিবীকে দগ্ধ করছিল, যখন কলকাতার আকাশে জাপানি বোমারু বিমানের আতঙ্ক ছায়া ফেলেছিল, ঠিক সেই অস্থির সময়ের মাঝে পার্ক সার্কাসের এক বাড়িতে জন্ম নিলেন এক শিশু, যার কণ্ঠে একদিন ধ্বনিত হয় নগরসভ্যতার সমস্ত হাহাকার। শহীদ কাদরীর জন্মমুহূর্তেই যেন লুকিয়ে ছিল তার ভবিষ্যৎ কবিসত্তার বীজ। একদিকে যুদ্ধবিধ্বস্ত পৃথিবীর বেদনা, অন্যদিকে ঔপনিবেশিক শাসন থেকে মুক্তির আকাঙ্ক্ষা। তার শৈশব কেটেছে ইতিহাসের সেই উত্তাল সময়ে, যখন বাংলার মাটি স্পন্দিত হচ্ছিল ভাষা আন্দোলনের প্রস্তুতিপর্বে, আর সাহিত্যের আকাশে রবীন্দ্রনাথের পর নতুন এক ধারা সৃষ্টির অনুরণন শুরু হয়েছিল।
জন্মের পর মাত্র দশ বছর বয়সে ১৯৫২ সালে পরিবারের সঙ্গে ঢাকায় চলে আসা এই কিশোর দেখতে পেলেন এক নতুন নগরীর জন্ম। আর সেই নগরীই পরবর্তীতে তার কবিতার প্রধান চরিত্র হয়ে উঠল।
মাত্র এগারো বছর বয়সে 'পরিক্রমা' শিরোনামে প্রথম কবিতা লিখে তিনি যেন ইঙ্গিত দিয়েছিলেন তার কবিতার প্রধান বৈশিষ্ট্যের- এক অহংকারহীন যাত্রা, যে যাত্রায় নগরের প্রতিটি রাস্তা, প্রতিটি মানুষের মুখ একেকটি কবিতায় রূপান্তরিত হয়। এই প্রারম্ভিক সৃজনশীলতা পরবর্তীতে বাংলা কবিতাকে এক নতুন মাত্রা দান করে, যেখানে নগরের কোলাহল ও মানুষের অন্তর্গত হাহাকার এক অনন্য শিল্পরূপ লাভ করে।
ব্যস্ততাপূর্ণ নগরজীবনের অপরাহ্নে যখন ধূসরতা নামে, রাস্তার বাতিগুলো নিষ্প্রভ হয়ে আসে, শহীদ কাদরীর কবিতা তখন আমাদের হৃদয়ে সেই নাগরিক নিঃসঙ্গতার স্পর্শ এনে দেয় যা আমরা প্রতিদিন অনুভব করি কিন্তু ভাষা দিতে পারি না। তার কবিতার প্রতিটি শব্দ যেন কংক্রিটের ফাটলে গজিয়ে ওঠা অবাধ্য ঘাসের মতো- কঠিন পরিস্থিতিতেও প্রাণের জয়গান করে।
১৯৬৭ সালে প্রকাশিত 'উত্তরাধিকার' কাব্যগ্রন্থ বাংলা কবিতায় এক নতুন যুগের সূচনা করেছিল, যেখানে প্রতিটি কবিতা ছিল নগরসভ্যতার একেকটি জীবন্ত প্রতিচ্ছবি। ‘সহসা সন্ত্রাস ছুঁলো’- এই সরল কিন্তু গভীর অর্থবহ পঙ্ক্তি শুধু একটি কবিতার শুরু নয়, এটি আমাদের সমগ্র নাগরিক অস্তিত্বের উপর এক দার্শনিক প্রশ্নচিহ্ন।
কাদরীর কবিতায় নগরী কখনও প্রেমিকার রূপ নেয়, কখনও বা শত্রুর, যে দ্বন্দ্বের মধ্যে দিয়ে তিনি ফুটিয়ে তোলেন আধুনিক মানুষের অন্তর্দ্বন্দ্ব। তার শব্দচয়নে বিজ্ঞাপনের বোর্ড, ট্রাফিক জ্যাম, হোটেলের লবি, বারগুলোর নেশাগ্রস্ত আলো- এসব নাগরিক উপাদান রূপক হয়ে ওঠে বৃহত্তর মানবিক সংকটের। ‘বিদ্যুতের উড়ন্ত বল্লম!/বজ্র-শিলাসহ বৃষ্টি, বৃষ্টি : শ্রুতি বধির ক'রে/গর্জে ওঠে যেন অবিরল করাত-কলের চাকা’- প্রকৃতির এমন রূপায়ণ বাংলা কবিতায় অভিনব, যেখানে বৃষ্টি শুধু রোমান্টিক উপাদান নয়, বরং এক সন্ত্রাসী শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়।
১৯৭৪ সালে প্রকাশিত 'তোমাকে অভিবাদন প্রিয়তমা' কাব্যগ্রন্থে কাদরী প্রেমকে ব্যক্তিগত আবেগের গণ্ডি থেকে মুক্ত করে এক সর্বজনীন রূপ দিয়েছেন, যা বাংলা সাহিত্যে এক নতুন মাত্রা সংযোজন করে।
‘কেবল তোমাকেই চতুর্দিক থেকে ঘিরে-ঘিরে/নিশিদিন অভিবাদন করবে, প্রিয়তমা’- এই উক্তি যেখানে ব্যক্তিগত প্রেমের সীমানা পেরিয়ে সমগ্র সৃষ্টির প্রতি এক আধ্যাত্মিক ভালোবাসায় রূপ নেয়। তার কবিতায় প্রেম কখনোই শুধু আবেগ নয়, এটি হয়ে ওঠে রাজনৈতিক প্রতিবাদ, সামাজিক সমালোচনা এবং দার্শনিক অনুসন্ধানের মাধ্যম, যে বৈশিষ্ট্য তাকে বিশ্বসাহিত্যের সমান্তরালে স্থান দিয়েছে।
‘তুমি যদি থেকো আমার পাশে/তাহলেই কোনো ক্রন্দন থাকবে না কোথাও’ - এই ‘তুমি’ কেবল একজন প্রিয় মানুষ নয়, এটি সমগ্র মানবজাতি, এই পৃথিবী এবং সম্ভবত সেই শিল্পসত্তা যা আমাদের সকল ক্লেদ থেকে মুক্তি দিতে পারে। কবিতার এই সার্বজনীনতা তাকে ফেডেরিকো গার্সিয়া লোরকার সমকক্ষ করে তোলে, যদিও লোরকার প্রেমের কবিতা যেখানে আবেগপ্রবণ, কাদরীর প্রেমের কবিতা সেখানে বেদনাদগ্ধ বাস্তবতায় ভরা।
১৯৭৮ সালের ‘কোথাও কোন ক্রন্দন নেই’ কাব্যগ্রন্থে কাদরী নাগরিক জীবনের নিষ্পেষণ থেকে জন্ম নেওয়া সেই নিশ্চুপ কান্নার কথা বলেন যা কখনো শোনা যায় না, যে কান্না আধুনিক মানুষের অন্তর্গত শূন্যতার প্রতীক। স্বাধীনতা-পরবর্তী বাংলাদেশের রাজনৈতিক টানাপোড়েন তার কবিতায় এসেছে অনন্য এক শিল্পরূপে, যেখানে তিনি সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে প্রবেশ করে বের করে এনেছেন তার অন্তর্গত সত্য। ‘স্বাধীনতার শহর’ কবিতায় তিনি লিখেছেন: ‘স্বাধীনতা, তুমি কাউকে দিয়েছো সারাদিন টো-টো কোম্পানীর উদ্দাম ম্যানেজারী করার সুবিধা...’- এই পঙ্ক্তিগুলো যেন আমাদের স্বাধীনতার পরের সমাজের এক নিষ্ঠুর আয়না, যে আয়নায় প্রতিফলিত হয় শ্রেণী বৈষম্য ও রাজনৈতিক হতাশা। কিন্তু এই সমালোচনার মধ্যেও আছে এক গভীর দেশপ্রেম, যে প্রেম শব্দের আড়ালে লুকিয়ে থাকে, যা তাকে টি.এস. এলিয়টের ‘দ্য ওয়েস্ট ল্যান্ড’-এর সমতুল্য করে তোলে, যদিও এলিয়টের কবিতা যেখানে পুরোপুরি হতাশাবাদী, কাদরীর কবিতায় রয়ে যায় এক সুপ্ত আশা।
২০০৯ সালে প্রকাশিত ‘আমার চুম্বনগুলো পৌঁছে দাও’ কাব্যগ্রন্থে প্রবাসজীবনের অভিজ্ঞতা ও মাতৃভূমির প্রতি গভীর টান ফুটে উঠেছে, যেখানে তিনি নিউইয়র্কের বরফঢাকা রাত্রিতেও বাংলার রোদ, নদীর জল, গ্রামের মাটির গন্ধকে ধরে রেখেছেন। ‘আমার চুম্বনগুলো পৌঁছে দাও/শ্রাবণে আষাঢ়ে রোরুদ্যমান বিব্রত বাংলায়’- এই আহ্বানে শুধু ব্যক্তিগত আবেগ নেই, আছে এক সমগ্র জাতির প্রতি গভীর মমত্ববোধ, যে বোধ তাকে বিশ্বসাহিত্যের অন্যান্য প্রবাসী কবিদের থেকে স্বতন্ত্র করে তোলে। এই কাব্যগ্রন্থের কবিতাগুলোতে তিনি যেমন নাগরিক জীবনের ক্লেদ তুলে ধরেছেন, তেমনি রেখেছেন গ্রামীণ জীবনের স্মৃতিচারণা, যে দ্বৈততা তার কবিতাকে দিয়েছে এক বিশেষ মাত্রা।
বিশ্বসাহিত্যের দিকে তাকালে আমরা দেখি, বোদলেয়ার যেমন প্যারিসের পথে পথে খুঁজে ফিরেছেন ‘লে ফ্লর দ্যু মাল’, এলিয়ট যেমন লন্ডনের ধূসর আকাশে দেখেছেন ‘দ্য ওয়েস্ট ল্যান্ড’- এর ধ্বংসস্তূপ, শহীদ কাদরীও তেমনই ঢাকার রাস্তায় খুঁজে পেয়েছেন আধুনিক মানুষের সংকটের ছবি। তবে কাদরীর কবিতায় যে স্বতন্ত্রতা তা হলো- এখানে হতাশার গভীরে লুকিয়ে আছে এক প্রচ্ছন্ন আশা, যে বৈশিষ্ট্য তাকে সিলভিয়া প্লাথের কবিতা থেকে পৃথক করে। প্লাথের কবিতার মতো আত্মধ্বংসী প্রবণতা না থাকলেও কাদরীর কবিতায় আছে এক গভীর মানবিক বোধ, যা পাঠককে হতাশার গহ্বর থেকে টেনে তুলে আশার আলো দেখায়।
কাদরীর কবিতার একটি বৈশিষ্ট্য হলো শব্দচয়নের অসাধারণ দক্ষতা, যেখানে তিনি সাধারণ শব্দকে অসাধারণ অর্থে ব্যবহার করতে জানতেন। ‘জানি, এক বিবর্ণ গোষ্ঠীর গোধূলির যে বংশজাত আমি/বস্তুতই নপুংসক, অন্ধ, কিন্তু সত্যসন্ধ্যা দুরন্ত সন্তান’ - এই সরল পঙ্ক্তিতে তিনি আধুনিক মানুষের বংশপরম্পরার যে চিত্র এঁকেছেন তা একইসাথে ব্যক্তিগত ও সামষ্টিক। তার কবিতার গঠনশৈলী, ছন্দের ব্যবহার, উপমার প্রয়োগ- সবই এক অনন্য শিল্পসত্তার স্বাক্ষর বহন করে, যে সত্তা তাকে বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে এক স্বতন্ত্র অবস্থান দান করেছে। তার কবিতায় ব্যবহৃত ‘পাপ, অন্ধকার, সন্ত্রাস, শয়তান, মৃত্যু, মাতাল, লম্পট, জরা, কৃমি, ভিখেরী, বেশ্যা, দালাল, জুয়াড়ি, কীট, কবর এবং নপুংশকেরা’ শব্দগুলো শুধু শব্দ নয়, এগুলো নগরসভ্যতার প্রতীকী চরিত্র।
২০১৬ সালের ২৮ আগস্ট নিউইয়র্কে তার মৃত্যুর পরও তার কবিতা আমাদের সঙ্গে কথা বলে, বিশেষ করে আজকের ডিজিটাল যুগে যখন নগরজীবন আরও বেশি বিচ্ছিন্ন ও যান্ত্রিক হয়ে উঠছে। ‘প্রেমিক মিলবে প্রেমিকার সাথে ঠিক-ই/কিন্তু শান্তি পাবে না, পাবে না, পাবে না...’ - এই লাইনগুলো আজও আমাদের হৃদয়ে অনুরণন তোলে। কারণ এগুলো শুধু প্রেমের কথা বলে না, বলে আমাদের সমগ্র অস্তিত্বের কথা। সমালোচক আব্দুল মান্নান সৈয়দ যথার্থই বলেছেন, ‘তার প্রথম বইয়ে কাদরী ছিলেন আরো ঘনবদ্ধ ও প্রগাঢ়, এখন একটু শিথিল ও বিস্তারিত; প্রথম গ্রন্থে কাদরী ছিলেন যাকে বলে ‘সিরিয়াস’ ও গম্ভীর, এখন লঘুতর ও হাস্যোদ্বেল।’
শহীদ কাদরীর কবিতা শেষ পর্যন্ত আমাদের সেই শিক্ষাই দেয় যা তিনি ‘তোমাকে অভিবাদন প্রিয়তমা’ কাব্যগ্রন্থে লিখেছিলেন: ‘তুমি যদি থেকো আমার পাশে/তাহলেই কোনো ক্রন্দন থাকবে না কোথাও’। এই সহজ সরল পঙ্ক্তির গভীরে যে দার্শনিক তত্ত্ব নিহিত আছে, তা হলো - মানবিক সম্পর্ক ও সংহতিই পারে আমাদের নাগরিক নিঃসঙ্গতা থেকে মুক্তি দিতে। তার কবিতার পাতায় পাতায় আমরা খুঁজে পাই আমাদেরই প্রতিচ্ছবি- বিবর্ণ, ক্লান্ত, কিন্তু এখনও আশায় ভরা। শহীদ কাদরী শুধু একজন কবি নন, তিনি নাগরিক নিঃসঙ্গতার এক মহাকবি, যার সৃষ্টি ভবিষ্যত প্রজন্মের কবিদের জন্য এক অনন্য প্রেরণা হয়ে থাকবে। যে প্রেরণা আমাদের শেখায় কিভাবে নগরের কোলাহলের মধ্যেও খুঁজে নিতে হয় নিজের অন্তর্গত সুর।
কলমে- বাহাউদ্দিন গোলাপ, ডেপুটি রেজিস্ট্রার, বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়
মন্তব্য করুন