বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর সালেহ উদ্দিন আহমেদ বলেছেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে বারবার সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করা। এর থেকে উত্তরণ করতে হলে ভেবেচিন্তে গভীরে গিয়ে তারপর সিদ্ধান্ত নিবেন এবং এ সিদ্ধান্তে অটল থাকবেন। না হলে ব্যবসায়ীদের আস্থা থাকবে না কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ওপর।
বৃহস্পতিবার (১৬ মে) রাজধানীর প্যান প্যাসিফিক সোনারগাঁও হোটেলে ‘কেমন বাজেট চাই’ অনুষ্ঠানে অংশ নিয়ে সাবেক এ গভর্নর এসব কথা বলেন।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর বলেন, ব্যাংক সম্পর্কে স্বল্প পরিসরে বলা যাবে না। তবে সরকারি বাজেট এবং যে কোনো কোম্পানির বাজেটের মধ্যে অনেক পার্থক্য রয়েছে। সরকারি বাজেট সরকারের আয়-ব্যয় ছাড়াও প্রাইভেট সেক্টর এবং ব্যক্তিগত সেক্টরে ইফেক্ট ফেলবে। এ দৃষ্টিতে কিন্তু বাজেটটা দেখতে হবে। মূল চ্যালেঞ্জটা হচ্ছে এখন মানুষের জীবিকার সংগ্রাম আসতে আসতে পলিসি মেকারদের আড়ালে চলে যাচ্ছে। ইনফ্লেশন নিয়ে কথা হচ্ছে, ইনফ্লেশন না এটা সামাজিক উন্নয়নের ব্যাপারটা আসছে।
ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ আরও বলেন, বাজেটে সামাজিক উন্নয়ন ও মূল্যস্ফীতিকে গুরুত্ব দিতে হবে।
তিনি বলেন, কয়েকটা বড় ইন্ডাস্ট্রি ছাড়া আমাদের ঐরকম বড় শিল্প গড়ে ওঠেনি। আমরা হংকং হতে পারব না, সিঙ্গাপুরও হতে পারব না। সুতরাং সার্ভিস সেক্টর আমরা এগোতে পারবো না। সুতরাং আমাদের শিল্প খাতকে গুরুত্ব দিতে হবে। ছোট ও মাজারের শিল্পকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিতে হবে। যেখান থেকে কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে। বাজেটের পলিসি হতে হবে জনবান্ধব এবং শিল্প বান্ধব।
তিনি বলেন, আমার বক্তব্য হচ্ছে শিল্পের পথের কাঁটাগুলোকে সরিয়ে দিতে হবে। কেউ যদি শিল্প প্রতিষ্ঠান করতে যায় তাকে প্রতিষ্ঠান গড়া সহজ করে দিতে হবে। আমাদের এখানে প্রতিটি ঘরে প্রতিটি চেয়ারে এবং প্রতি টেবিলে টাকা দিতে হয়। তাই বিদেশি বিনিয়োগ আসে না। বিদেশি বিনিয়োগ আনতে হলে এ অবস্থার উন্নতি করতে হবে।
সালেহউদ্দিন বলেন, ব্যাংক খাতের সমস্যাগুলো অজানা নয়। আর সমাধানও অজানা নয়। সে ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে আরও শক্ত হতে হবে এবং আরও কঠোর হতে হবে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে বারবার সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করা। আজকে এক সিদ্ধান্ত আবার কয়েকদিন পর আরেক সিদ্ধান্ত। এর থেকে উত্তরণ করতে হলে ভেবেচিন্তে গভীরে গিয়ে তারপর সিদ্ধান্ত নিবেন এবং এই সিদ্ধান্তে অটল থাকবেন। না হলে ব্যবসায়ীদের আস্থা থাকবে না কেন্দ্রীয় ব্যাংকের উপর। বাজারেরও আস্থা থাকবে না। এতে সবকিছুই লাগাম ছাড়া হয়ে পড়বে। এজন্য মুদ্রানীতি এবং রাজস্ব নীতির সমন্বয়ের বিকল্প নেই।
২০২১-২২ এ আমাদের চাহিদা থাকার পরও টাকার দর ধরে রাখা হয়েছিল। এতে আমাদের ক্ষতি হয়েছে। টাকার দর এখন একসঙ্গে অবমূল্যায়ন করতে হয়েছে। তাহলে আমাদের ১২ বিলিয়ন ডলার খরচ করে লাভটা হল কি? এটা কি ভাল ডিসিশন ছিল? মোটেও না। আমার মনে হয় যারা পলিসি মেকার তাদের এ বিষয়ে জবাবদিহি করতে হবে।
অর্থনীতিবিদ ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেছেন, আমাদের যে বাজেট দেয়া হয় তার মধ্যে ৬০ ভাগই অবকাঠামো ও যোগাযোগ ব্যবস্থার ওপর বরাদ্দ রাখা হয়। যেখানে ৩০ শতাংশ ই অতি মূল্যায়িত হয়। আওয়ামী লীগের ইস্তেহার ও এসডিজি লক্ষ্যমাত্রায় স্বাস্থ্য ও শিক্ষা খাতে যে বরাদ্দ রাখার কথা হয়েছিল তা অর্ধেকও বাস্তবায়ন হয়নি। এক কথায় সরকার মুখে যেটা বলে সার্বিকভাবে অনেক ক্ষেত্রেই তা বাস্তবায়িত হয় না।
তিনি বলেন, বর্তমানে সবচেয়ে বড় সমস্যা জবাবদিহিতা। আমাদের কোন ক্ষেত্রেই জবাব দিতে নাই। তাই জবাবদিহিতা দরকার। একদিকে ট্যাক্স দিব না, একচেঞ্জ রেট ঠিক করবো না সুদের হার ঠিক করবা না। কিন্তু দুবাইতে ৩৯৪ জনের সম্পদ বাড়বে। এজন্য তো ১৯৭১ সালে দেশ স্বাধীন করিনি।
এ মুহূর্তে সবচেয়ে কঠিন পরিস্থিতির মধ্যে পড়েছে দেশ। আমাদের অর্থনীতিতে এ মুহূর্তে আরও এক বড় সমস্যা হলো প্রকৃতিতে মন্দা দেখা দিয়েছে। সরকারের অর্থনীতিতে সমস্যা হলো রাজস্ব বাড়েনি। এ মুহূর্তে সরকারের খরচ বাড়ানোর কোন অবস্থা নেই। বিদেশি ঋণ শোধ করার মতো অবস্থা নেই।
এ অর্থনীতিবিদ বলেন, আমাদের রাজনীতি যদি নিয়ন্ত্রণ করতে না পারি তাহলে শরীরে অন্যান্য জায়গায় সমস্যার সৃষ্টি হচ্ছে। গতবার থেকে এবার কী এসেছে। আপনারা যদি দেখেন গত ১০ বছরে আমরা ব্যক্তি পর্যায়ে রাজস্ব সেভাবে বাড়েনি। আজকে যদি করোনার কথা বলেন, তাহলে অর্থনীতির বিবেচনা ঠিক হলো না।
ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, গতবার আমি যখন আলোচনা করেছি তখন আমি বলেছি এবং যা কথাগুলো বলব আইএমএফআইয়ের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে, আমাদের সাথে অনেক সময় আইএমএফআইয়ের সাথে মিলবে না, কিন্তু আমাদের দেশের অর্থনীতিবিদের মধ্যে আমরা মোটামুটি একটা ঐক্যমতে এসেছি। সেটা হলো মূল্যস্ফীতি ও সমষ্টিক অর্থনীতির। এটা আমরা যেভাবে বলি না কেন, এটা বিনিময় হার দিয়ে বলি, পণ্য মূল্য দিয়ে বলি অথবা সুদের হার দিয়ে বলি। সামষ্টিক অর্থনীতির স্থিতীশীলতা ১ নম্বর বিষয় হিসেবে সবার কাছে প্রতিপালিত হবে। কারণ এটা অনেকটা শরীরে ডায়েবেটিকের মত।
ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, গত ১৫ বছরের হিসেব যদি ধরেন, তাহলে এত জটিল ও আর্থিক বাজেট হয়েছে বলে আমার মনে হয় না। এই জটিল আর্থিক পরিস্থিতি আরও জটিল হয়েছে কারণ হলো আন্তর্জাতিক পরিস্থিতির কারণে। সেটা আপনি পণ্য মূল্যই বলেন আর বাজারে মন্দার কথাই বলেন।
ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, এ পরিস্থিতি আরও জটিল হয়েছে আবহাওয়াগত কারণে। আমাদের বিভিন্ন ধরনের প্রতিক্রিয়া আমরা লক্ষ্য করছি এটা অর্থনীতির নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া নিয়ে এসেছে। পৃথিবীতে এখন যে ধরনের রাজনীতি হচ্ছে তার ফলে আমাদের আঞ্চলিক রাজনীতি এবং ভূ-কৌশলগত বিভিন্ন ধরনের পরিস্থিতি আমাদের অর্থনীতিকে প্রভাবিত করছে। সেহেতু সাধারণভাবেই যদি আপনি বলেন, এই বাজেট অত্যন্ত জটিল পরিস্থিতির ভিতরে আসছে। তাই এই বাজেট অন্য যে কোন বছরের থেকে কঠিন এবং সর্বোপরি বাংলাদেশ এই মুহূর্তে আইএমএফএর সাথে একটি শর্তযুক্ত ঋণের মধ্যে রয়েছে। সমস্ত প্রতিশ্রুতি প্রতিপালন করাটা এখন বাধ্যবাধকতা হয়েছে। তাহলে এই পরিস্থিতিতে আগামী বাজেটে আমরা কী চ্যালেঞ্জের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছি।
গত দেড় দশক ধরে প্রচারিত হচ্ছে বাজেট নিয়ে এনটিভির এই আলোচিত অনুষ্ঠানটি। সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিত যেমন সংসদে রেকর্ড সংখ্যকবার বাজেট উপস্থাপন করেছেন, তেমনি এনটিভির এই আয়োজনেও প্রধান আলোচক হিসেবে অংশ নিয়েছিলেন টানা ১০ বার। এ সময় প্রধানমন্ত্রীর অর্থনৈতিক উপদেষ্টা ড. মশিউর রহমান বলেছেন, আসন্ন ২০২৪-২০২৫ অর্থবছরের জাতীয় বাজেটকে জনবান্ধব করতে স্টেকহোল্ডারদের দেওয়া প্রস্তাবনাগুলো বিবেচনায় নেওয়া হবে। পাশাপাশি বাজেট বাস্তবায়নে সরকারের বিভিন্ন বিভাগ ও সংস্থাগুলোতে সক্ষমতা বাড়ানোর পদক্ষেপ নেওয়া হবে।
আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারের প্রতি ইঙ্গিত করে ড. মশিউর রহমান বলেন, আমরা সামাজিক সুরক্ষাসহ দেশের আর্থ-সামাজিক অগ্রগতি ও উন্নতির লক্ষ্যে পদক্ষেপের কথা থাকবে আসন্ন বাজেট প্রস্তাবনায়। বাজেট তৈরির আগে বিভিন্ন মহল থেকে অনেক প্রস্তাবনা আসে। প্রত্যেকেই নিজ নিজ চিন্তাভাবনা থেকে এসব প্রস্তাবনা দেওয়া হয়। রাজস্ব আয় বাড়িয়ে অর্থনৈতিক সক্ষমতা বাড়ানোর জন্য সব ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া হবে।
এনবিআরের নানা ধরনের হয়রানির বর্ণনা দিয়ে বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিকেএমইএ) নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, দেশে অর্থনৈতিক অবস্থা করুণ। সরকার এনবিআরকে রাজস্ব বাড়াতে চাপ দিচ্ছে। আর এনবিআর নানা ফন্দি করে ব্যবসায়ীদের গলা কাটছে।
এনবিআরের অত্যাচার ও নির্যাতনে অনেক ব্যবসায়ী তাদের ব্যবসা গুটিয়ে নিচ্ছেন বলে উল্লেখ করে হাতেম আলী বলেন, প্রতি বছর ট্যাক্স রিটার্ন দাখিল করার পরও এনবিআর কর্মকর্তারা তিন বছর আগের ফাইল অহেতুক সামনে এনে ব্যবসায়ীদের মোটা অঙ্কের টাকা জরিমানা করছে।
আমদানি পণ্যে অ্যাডভান্স ইনকাম ট্যাক্স (এআইটি) দেওয়ার বিষয়ে ব্যবসায়ী নেতা হাতেম আলী বলেন, পণ্য আমদানিতে সরকার নানা ধরনের কর আরোপের পাশাপাশি অগ্রিম করও নিচ্ছে। অথচ এ অগ্রিম কর পরবর্তীতে ব্যবসার সঙ্গে সমন্বয় করা হচ্ছে না। এতেও ব্যবসায়ীরা মারাত্মকভাবে ক্ষতির মুখে পড়ছেন।
অর্থপ্রতিমন্ত্রী ওয়াসিকা আয়শা খান বলেন, আমরা বঙ্গবন্ধুর কৃষি বিপ্লবকে সামনে রেখে একটি পলিসি নির্ধারণ করবো, যাতে দেশের তৃণমূল পর্যায়ের মানুষ উপকৃত হয়। একই সঙ্গে দেশের আর্থসামাজিক অবস্থার উন্নতিতে পদক্ষেপ নেওয়ার কথা থাকবে আসন্ন বাজেটে।
প্রতিমন্ত্রী আরও বলেন, কর্মসংস্থান সৃষ্টি করে বেকার সমস্যা দূর করার জন্য সরকারের নেওয়া লক্ষ্য ও কর্ম পরিকল্পনা বাস্তবায়নের নির্দেশনাও থাকবে আসন্ন বাজেট প্রস্তাবনায়।
অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন প্রধানমন্ত্রীর অর্থনৈতিক উপদেষ্টা ড. মশিউর রহমানসহ সরকারের একাধিক নীতিনির্ধারক। এবারের আয়োজনে প্যানেল আলোচক হিসেবে ছিলেন অর্থনীতিবিদ ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য, বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ ও পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের চেয়ারম্যান ড. জায়েদি সাত্তার। অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন এইফবিসিসিআইয়ের সভাপতি মাহবুবুল আলম।
মন্তব্য করুন